তিতাসের বুনো হাঁস—এই শিরোনামের উপন্যাসটির প্রচ্ছদের শীর্ষে লেখা আছে এমন কথা, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবন ও সময়কেন্দ্রিক উপন্যাস’। এই কথা বলার পর পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না যে এই উপন্যাস কী নিয়ে লেখা হয়েছে। এটি এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিরাট ব্যাপার নয়, কিন্তু আকর্ষণ কিংবা মনোযোগের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই শিরোনামের ভেতর দিয়েই এই বিষয় স্পষ্ট হয় যে ঔপন্যাসিক মাসউদ আহমাদ এই উপন্যাসে একই সমান্তরালে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও তাঁর সময়কে উপস্থাপন করেছেন। আমি যে ‘আকর্ষণ’ ও ‘মনোযোগের’ প্রসঙ্গে কথা বললাম, সেটি একটি বিচারে দেখতে গেলে বিষয়টি দিনের সূর্যের মতো স্পষ্ট হবে যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস-কালপরিক্রমায় নানা কারণে প্রথম সারির গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
প্রথম আলাপ, উপন্যাসটির শিরোনাম চমৎকার। সঙ্গে এর প্রচ্ছদও। যে কেউ এই দুটি বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যেতে চান এখন। কিন্তু এই উপন্যাসের শিরোনামটি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। শিরোনামের প্রথম শব্দ ‘তিতাস’, ভৌগোলিক বিবেচনায় বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি নদী। কিন্তু এই শিরোনামের ‘তিতাস’ শব্দের মাধ্যমে প্রচ্ছদের শীর্ষে লেখা অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘জীবন ও সময়কে’ যে স্থানিক বাস্তবতা ধারণ করবে, তার প্রসঙ্গই পুনঃস্থাপিত হয়েছে এবং তৎকালীন তিতাসপাড়ের জনপদে বেড়ে ওঠা ও বড় হওয়া অদ্বৈত মল্লবর্মণকে তুলনা করা হয়েছে বুনো হাঁসের সঙ্গে। যাঁর আছে সামগ্রিক শুভ্রতা, কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠার পরিচয় রাজকীয় প্রাঙ্গণে নয়, তিতাসের পারে, যা প্রতীকতায় মূর্ত হয়েছে বুনো শব্দের শাব্দিক ব্যঞ্জনায়।
উপন্যাসটি সামগ্রিকভাবেই অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনের সামগ্রিকতা নিয়ে লেখা হয়েছে। এবং জন্ম-বেড়ে ওঠা-লেখক হওয়া এবং অকালে মৃত্যুবরণের বিষয় এই উপন্যাসের প্রধানতম বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। উপন্যাসের বয়ানের বিষয় কিন্তু ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়নি। বরঞ্চ কাহিনি-বর্ণনার একটি উল্লম্ফনধর্মিতা পাঠক বেশ ভালোমতোই টের পাবেন পড়তে গিয়ে। এতে সুবিধা আর অসুবিধা দুটিই আছে। এতে পাঠকের ভালো-মন্দের বিষয়ও লুকিয়ে আছে। উপন্যাসের কাহিনির যাত্রা শুরু হয়েছে তৎকালীন পূর্ব বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাটের মালোপাড়া থেকে। আর শেষ হয়েছে কলকাতার নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীপাড়ার বাড়িতে, তাঁর মৃত্যুর খবর দিয়ে। আরও একটু আছে, মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি যে পত্রিকায় চাকরি করেছিলেন, সেই পত্রিকাকেন্দ্রিক মৃত্যুর এক বছর পর একটি শোকসভাকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে রয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনের ঘটে যাওয়া বিচিত্র ঘটনাবলি। কুমিল্লা শহরে পড়তে যাওয়া, সেখান থেকে একেবারেই চালচুলোহীনভাবে কলকাতায় গিয়ে ওঠা এবং কর্মের সূত্রে বিচিত্র পত্র-পত্রিকা অফিসে চাকরি করা এবং কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের সঙ্গে সম্পর্কের কাহিনি এই উপন্যাসে আছে। আর আছে লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ হওয়ার ঐকান্তিক লড়াই।
বিশ শতকের বিশ-ত্রিশের দশকের পূর্ব বাংলার প্রান্তিক এক মালোপাড়ার সন্তানের জীবন-জোয়ার ঠেলে কায়ক্লেশে লেখাপড়া শিখে পেটের দায় মেটাতে পত্র-পত্রিকা অফিসে কলম-পেষার চাকরি করে সাহিত্যিক হওয়ার যে পরিভ্রমণ, তার একটি জ্বলিত বাস্তব সাহিত্য-উপকরণ আর উদাহরণ হিসেবে এই উপন্যাসকে বিবেচনা করা সম্ভব। আর সাহিত্যিক পদ্ধতিতে একজন মহৎ সাহিত্যিককে স্মরণ করার চল বহু আগ থেকেই নানাভাবে আছে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এই চল বেশি দিনের পুরাতন নয়। আর এই ধরন আর ধারণায় মাসউদ আহমাদ বেশ নামও করেছেন তাঁর কাঞ্চনফুলের কবি লেখার মাধ্যমে। তিতাসের বুনো হাঁস এই ধারায় তাঁর আরেকটি সংযোজন। যে উপন্যাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ লেখক হওয়া সত্ত্বেও কম গুরুত্ব পাওয়া অদ্বৈত মল্লবর্মণকে আবার গড় বাঙালি পাঠকের মনে করিয়ে দিতে পারবে। আর এই সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়ের পূর্ব বাংলা আর কেন্দ্র কলকাতা—এই দুই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বর্ণনা আর এই মানুষেরা যে আর্থমসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় জীবন যাপন করছিল, তার বর্ণনায় উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষ করব। এই উপন্যাসের ভাষা নিয়ে। এই উপন্যাসের ভাষা অনেক ক্ষেত্রে ‘আক্ষরিকতার ভাষা’ হিসেবে হাজির হয়েছে। ভাষার সরলতা দোষের নয়। এমন সরল ভাষার লেখকের বহু দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু এই উপন্যাসে মানুষ ও জনপরিসরের বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন সব সরল উক্তি ঔপন্যাসিক করেছেন, যা মেনে নেওয়া যেকোনো বুদ্ধিমান পাঠকের জন্য নানা কারণে দুষ্কর হবে। যেমন তিনি একটি অংশে বলছেন, ‘গ্রামের জীবন সুন্দর। নির্ঝঞ্ঝাট। নিস্তরঙ্গ।’ কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ কি এই বাক্য তিনটির সত্যতা মেনে নেবে? তাহলে প্রায় একই সময়ের বাস্তবতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেন পল্লী-সমাজ লিখলেন? প্রশ্নের উত্তর আছে পাঠকের কাছে।
তিতাসের বুনো হাঁস
মাসউদ আহমাদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৫; প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল; ১৭৬ পৃষ্ঠা;
দাম: ৪৭০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে