বাংলাদেশের লোকগানের প্রামাণ্য দলিল

বাংলা লোকসংগীতের একটি বড় দুর্বলতা হলো স্বরলিপি না থাকায় সুর ও গানের কথার বিকৃতি ঘটে অনেক বেশি। ফলে অনেক গান হারিয়ে যায় চিরতরে। বাংলা লোকগানের স্বরলিপি নিয়ে উল্লেখযোগ্য একটি কাজ হয়েছে ফোক মেলোডি অব বাংলাদেশ: বাংলাদেশের লোকজ সুর বইয়ের মধ্য দিয়ে। ইফতেখার আনোয়ারের সম্পাদনায় বাংলাদেশের খ্যাতনামা লোককবি বা সংগীত রচয়িতাদের বহুল জনপ্রিয় ও প্রতিনিধিত্বমূলক একগুচ্ছ গানের সংকলন এটি। বইটি তিনটি ভাষায়—বাংলা, ইংরেজি ও ফরাসি—প্রকাশিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক পাঠকদের কাছেও একে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

বাংলাদেশের লোকগান শুধু সংগীত নয়, বরং এ দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানুষের জীবনধারার এক শক্তিশালী প্রকাশ। আলোচ্য বই এই ঐতিহ্যবাহী সংগীতকে সংরক্ষণ ও বিশ্বদরবারে তুলে ধরার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। বইটি মূলত আন্তর্জাতিক স্বরলিপি ও ধ্বনিবিদ্যা ব্যবহার করে লেখা হয়েছে। মূলত এই ধ্বনিবিদ্যা বা ফনেটিকস ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা লোকগানের আন্তর্জাতিকীকরণের এক সফল প্রচেষ্টা বলা যায় বইটিকে। 

এই সংকলনে মোট ২০৪টি লোকগান ও স্বরলিপি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে লোকগান সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে উঠেছে। বিশেষত, যাঁরা লোকগান চর্চা বা গবেষণা করেন, তাঁদের জন্য এটি একটি অপরিহার্য গ্রন্থ।

বইয়ে যে গানগুলো সংকলিত হয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসংগীতের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব গানের মধ্যে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, মুর্শিদি, মারফতি ও বাউলগান রয়েছে। লালনসংগীত থেকে শুরু করে সংকলনটি শেষ হয়েছে হরষনাথ গাঙ্গুলীর গান দিয়ে। বলা যায়, বাংলার প্রায় সব পরিচিত লোকসংগীত রচয়িতার গানই স্থান পেয়েছে এখানে। প্রতিটি গানের কথা, সুর ও গীতিকারের পরিচিতির সঙ্গে সম্পাদক এ বইয়ে প্রতিটি গানের মূলভাব ও বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করেছেন। বইটির বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এতে গানের মূল লিরিক সংকলিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বাউল রশিদ উদ্দিনের লেখা ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া/ এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই’ গানটি যেভাবে প্রচলিত হয়েছে, তা থেকে এর মূলকথা অনেকটাই ভিন্ন, যা বইটিতে পাওয়া যায়। এমন বৈশিষ্ট্য একে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

বইয়ে সম্পাদকের একটি মনোজ্ঞ ভূমিকা রয়েছে। এখানে তিনি ভিন্ন ভাষাভাষী সংগীতকার, সংগীতানুরাগী সবার কথা ভেবে বাউলগান, ভাটিয়ালি বা হাওর অঞ্চলের গান, ভাওয়াইয়া, মাইজভান্ডারি প্রভৃতি সংগীত সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা যেমন করেছেন, তেমনি তুলে ধরেছেন বাংলা লোকগানে ব্যবহৃত নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের পরিচিতিও। রয়েছে বাংলা লোকগান যেসব তাল–লয়ে গাওয়া হয়, সেসবের সহজ–সাবলীল আলোচনাও। 

নোটেশনের মধ্য দিয়ে সুর, লয় আর তালের সংযোজন ঘটিয়ে বিশ্বদরবারে পৌঁছানোর একটি সুন্দর প্রচেষ্টা ও লোকগানের গতিপ্রণালি, গঠনবিন্যাস, প্রকারভেদ, সুরধারা, সুরবিন্যাস, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে আলোচনাও বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। 

এ বইয়ের সম্পাদক ও সংকলক হিসেবে ইফতেখার আনোয়ারের বড় কৃতিত্বের জায়গাটি হলো, গানগুলোর স্বরলিপি বা স্টাফ নোটেশনের কাজটি করা। ভীষণ কষ্টসাধ্য এবং একই সঙ্গে ধৈর্য ও যোগ্যতার সঙ্গে এ কাজ করতে তিনি বেশ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের লোকসংগীতের মূল ধারাগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে এবং আমাদের উন্নত লোকসাহিত্যের সঙ্গে বিশ্ববাসীর পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি গান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ছিলেন সচেতন। ভিনভাষী পাঠক যেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, প্রাকৃতিক অবস্থা, সময় পরিসর, গীতিকার ও গানের কথা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং সুরের বৈচিত্র্য উপলব্ধি করতে পারেন, এমনভাবেই গানগুলো বাছাই করা হয়েছে। 

বইটির প্রকাশক আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকা, যা মূলত ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচারের জন্য পরিচিত। কিন্তু এই বই প্রকাশের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের সংগীত ও সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে।  

প্রতিটি গানের সঙ্গে স্বরলিপি সংযুক্ত করার ফলে গানগুলো সঠিকভাবে গাওয়া ও শেখার সুবিধা হয়েছে। বিশেষত বিদেশি গবেষক, সংগীতশিল্পী ও সংগীতপ্রেমীদের জন্য বইটি আকর হতে পারে, একইভাবে এ দেশের লোকগানের প্রতি আগ্রহীও করে তুলতে পারে।

ফোক মেলোডি অব বাংলাদেশ: বাংলাদেশের লোকজ সুর কেবল সংগীতশিল্পীদের জন্য নয়, বরং গবেষকদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোকগানের স্বরলিপি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য এটি একটি দুর্লভ সম্পদ। বাংলাদেশের লোকসংগীত নিয়ে যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য। বইটি শুধু একটি গানের সংকলন নয়, বরং বাংলাদেশের লোকগানের একটি প্রামাণ্য দলিল। 

ফোক মেলোডি অব বাংলাদেশ: বাংলাদেশের লোকজ সুর

সম্পাদনা: ইফতেখার আনোয়ার

প্রকাশক: আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকা; প্রকাশকাল: ২০২৪; ৫৯১ পৃষ্ঠা; 

দাম: ৩ হাজার ৫০০ টাকা। 

বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে