স্মৃতির প্রচ্ছদ

শিল্পী: সমর মজুমদার

বৃদ্ধ নারীর পিছু হেঁটে চলছে একটি গরু, কাঁধে ভার তুলে গ্রাম্য পথে হেঁটে চলেছেন ফেরিওয়ালা, পরম যত্নে একঝাঁক হাঁসের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন রমণী, জলাশয়ে কিশোরী তার বাবার সঙ্গে মাছ ধরছে—গ্রামীণ দৈনন্দিন জীবনের এমন দৃশ্য দেয়ালে সারিবদ্ধভাবে ঝুলে আছে রাজধানীর লালমাটিয়ার ভূমি গ্যালারিতে।

ছোট ছোট ড্রয়িং। প্রতিটি ড্রয়িংয়ে গ্রামবাংলার নিসর্গ, মানুষ ও লোকসংস্কৃতির ইঙ্গিতপূর্ণ গল্পগাথা। এ গল্প সচিত্র নয়, ইঙ্গিতবহ। যেন বইয়ের প্রচ্ছদের মতোই শিল্পীর শৈশবস্মৃতির একেকটি অধ্যায়ের প্রচ্ছদ। আর প্রচ্ছদশিল্পী সমর মজুমদারের এই প্রদর্শনী যেন তাঁর স্মৃতি-বিস্মৃতি অনুস্মৃতিতে সাজানো। আদতে শিল্পীর দেখা নিসর্গ, নারী, প্রকৃতি ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক কিছুই প্রযুক্তির কল্যাণে খোদ গ্রাম থেকেই হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই এসব চিত্র একধরনের ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠেছে। বেশির ভাগ ছবিতে নারী অবয়বের উপস্থিতি। কর্মরত, গল্পরত কিংবা প্রসাধনরত যে অবস্থায়ই নারীকে উপস্থাপন করেছেন শিল্পী, তার অভ্যন্তরীণ ভাবভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ প্রাঞ্জল হয়েছে। জমিনের শূন্য স্পেস আর কালির রেখা একে অপরে জড়াজড়িতে চিত্রজমিনে অর্ধবিমূর্ত আবহ সৃষ্টি হয়েছে। সস্তা কাগজ, কালি আর পোস্টার রং ব্যবহারেও রয়েছে এই চিত্রাঙ্কনের নন্দনতাত্ত্বিক গভীরতা।

‘সং অব দ্য সোল’ শিরোনামের সিরিজচিত্রের কাজগুলো সস্তা কাগজ ও কালিতে আঁকা। এসব কাজে ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র, আলপনা, গ্রামীণ লোকজ মোটিফের ছাপ সুস্পষ্ট; যা রূপ, রং আর বিমূর্ততায় আধুনিকবাদী হয়ে ওঠে। হাতে গোনা কয়েকটি কাজে রঙের ছোঁয়া আছে। স্নেহ, আদর, অনুরাগ, আনন্দ ফোটাতে নেই বর্ণবিলাস। শিল্পী কালো রঙে বুনেছেন রঙিন স্মৃতি। সামান্য রঙের ব্যবহারে অসামান্য অনুভূতির প্রকাশ শিল্পীর বিশেষ দক্ষতা।

অনেকটা পুতুল ঢঙের কাঠামো নির্মাণ করে শিল্পী ভঙ্গির মধ্যে একটা সারল্য যোজনা করেছেন। দেহকাঠামো নির্মাণে শিল্পীর একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে। সেই ভঙ্গিই বিষয়ের সারসংক্ষেপ প্রাঞ্জলভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। ফলে আহ্লাদ, অনুরাগ, ভালোবাসা, সরলতা, প্রকৃতির আলাপনের স্মৃতির ধোঁয়াশায় এক অন্তর্দৃষ্টিতে ফিরে যাওয়া যায়। সংক্ষিপ্ত রেখায় অভিব্যক্তিপূর্ণ ভাবভঙ্গি সৃষ্টি শিল্পীর কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর ব্যবহৃত উপকরণের সারল্য দর্শককে মাটির গন্ধের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সেই গন্ধের উৎস ধরে দর্শকেরা গ্রামীণ সমাজে ডুব দিতে পারবেন।

মলয় বালা