বইপ্রেমী ও শিল্পপ্রেমীদের পদচারণে মুখর ঢাকার মৎস্য ভবন থেকে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত। করোনাভাইরাসের শঙ্কা একদিকে সরিয়ে রেখে ঢাকা শহরে ফেব্রুয়ারি মাস বরাবরের মতোই একটি উৎসবের মাস হিসেবে দেখা দিয়েছে। ধূলিধূসরিত এ শহরে একদিকে বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে বসেছে বইয়ের মেলা, অন্যদিকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে একটি আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীর জন্য। বইমেলায় ঢোকার আগে একটু শিল্পকলা একাডেমিতে ঢুঁ মারলে দেখতে পাবেন দেশি-বিদেশি শিল্পীদের পদভারে মুখর জাতীয় চিত্রশালা। এখানে প্রস্তুতি চলছে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ঢাকা আর্ট সামিটের।
২০১২ সাল থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে ঢাকা আর্ট সামিট। এ বছর বসছে এই আন্তর্জাতিক মাল্টি ডিসিপ্লিনারি আর্ট সামিটটির পঞ্চম আসর। বাংলাদেশসহ ৪৪টি দেশের পাঁচ শতাধিক শিল্পী অংশ নিচ্ছেন এই আর্ট সামিটে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট আয়তনের জাতীয় চিত্রশালা এবং সংলগ্ন একটি স্কল্পচার গার্ডেনে আয়োজন করা হয়েছে ঢাকা আর্ট সামিটের পঞ্চম আসরের। এক ছাদের নিচে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন শিল্পীর বিভিন্ন মেজাজ ও মাত্রার শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ করে দিতে ২০১২ সাল থেকে এ আয়োজন করে আসছে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন। এবারের এই সামিটে অংশ নিচ্ছেন পৃথিবীর ৪৪টি দেশের চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, কিউরেটর, শিল্প–সমালোচক, শিল্প সংগ্রাহক, স্থপতি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে শিল্পকলার জগতে এত ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় আয়োজন বেশ বিরল বলা চলে।
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার প্রতিটি তলা ঘুরে দেখা গেল, দেশি-বিদেশি শিল্পীদের শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা চলছে। কাঠের কাঠামোয় পেরেক ঠোকার শব্দ, ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশনের বড় স্ক্রিন থেকে ভেসে আসা শব্দ যেমন পাওয়া গেল, তেমনি পাওয়া গেল তাজা রঙের ঘ্রাণ। একাগ্র মনে শিল্প নির্মাণে ব্যস্ত শিল্পীদের যেমন চোখে পড়ল, তেমনি দেখা গেল সহকারীদের সঙ্গে শিল্পকর্মের বিভিন্ন ভাবনা বিনিময়রত শিল্পীদের। ২২ থেকে ৪০ বছর বয়সের শিল্পীদের পদভারে মুখর জাতীয় চিত্রশালায় কথা হলো ইথিওপিয়ার বংশোদ্ভূত আমেরিকান-জার্মান শিল্পী ওলানি ইওনেটের সঙ্গে। ‘ইটস ম্যাসিভ’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি জানালেন, এত বৈচিত্র্যময় আয়োজনের অংশ হতে পেরে তিনি আনন্দিত।
ঢাকা আর্ট সামিটের প্রস্তুতি দেখতে এসে চোখ আটকে গেল সিনেমার ব্যানারে। চলচ্চিত্রের দুর্দিনে সিনেমার ব্যানার চিত্র বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে গেলেও এর নির্মাণশৈলীর গুণে এটি ভিন্ন মাত্রায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলা চলে। এর আগে গত বছরের জুনে প্যারিসের প্যালেই ডি টোকিও গ্যালারিতে বাংলাদেশের সিনেমার ব্যানার দিয়ে থিম তৈরি করা হয়েছিল ‘সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস’ নামের একটি প্রদর্শনীতে। ১৫৫ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সিনেমার ব্যানার নির্মাণ করা হচ্ছে এবারের ঢাকা আর্ট সামিটের একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এই প্রকল্পটি নির্মাণ করছেন অ্যান্টনিও আলাম্পি, বনভেনিটউ এস বি এনডিকুঙ, ওলানি ইওনেট ও শাওন আকন্দ। প্রবীণ সিনেমার ব্যানার শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েবের নেতৃত্বে ১৪ শিল্পী আঁকছেন এই সিনেমার ব্যানারটি। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে এই সিনেমার ব্যানারে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে আফ্রিকা, ভারত উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। সিনেমার ব্যানার শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, তিনি ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সিনেমার ব্যানার আঁকলেও এত দীর্ঘ ব্যানার আগে কখনো আঁকেননি।
জাতীয় চিত্রশালার প্রতিটি তলায় বিভিন্ন ভাবনার, বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ করছেন শিল্পীরা। কোথাও একক প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে গ্যালারি, কোথাও যৌথ নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। ঢাকা আর্ট সামিট সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের একটি অলাভজনক পদক্ষেপ। এই সামিট আয়োজন করে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পচর্চার ওপর আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করা প্রায় ৫০০ শিল্পীর মধ্যে ২৯০ জনই বাংলাদেশের শিল্পী। এর মধ্যে আছে ১২টি আর্টিস্ট গ্রুপ। বাংলাদেশের তরুণ ও অভিজ্ঞ শিল্পীদের আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ আয়োজনে প্রদর্শনী ছাড়াও থাকবে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, একক ও দলবদ্ধ বক্তৃতা। থাকবে শিল্পকলাবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী। ডায়ানা ক্যাম্পবেল বেটানকোর্টের কিউরেটিংয়ে দ্বিবার্ষিক ঢাকা আর্ট সামিটের উদ্বোধন হবে ৭ ফেব্রুয়ারি, চলবে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সামিট উন্মুক্ত থাকবে দর্শকদের জন্য।
জাতীয় চিত্রশালার প্রতিটি তলা ঘুরে শিল্পীদের প্রস্তুতি দেখতে দেখতে মনে হলো, শিল্পকলার আন্তর্জাতিক মানের আসর পরিচালনার দক্ষতা এবং সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ঢাকা আর্ট সামিট, এশিয়ান বিয়েনাল কিংবা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হওয়া আন্তর্জাতিক আর্টক্যাম্পগুলো তারই প্রতিফলন।