সেকালের হজ
আজ থেকে তিন–চার দশক আগেও বাঙালি মুসলমানের জন্য হজ পালন করা প্রায় দুঃসাধ্য বিষয় ছিল। এই মহান তীর্থযাত্রার ভাগ্য অনেকেরই ছিল না, যদিও মুসলমানমাত্রই স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা একদিন জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দেবেন হেজাজের পথে। রাসুল (সা.)–এর স্মৃতি খুঁজে ফিরবেন মক্কা-মদিনার অলিতেগলিতে। কাবার কালো গিলাফ আর হাজরে আসওয়াদের স্পর্শে পবিত্র করবেন নিজেদের, প্রাণের নবী (সা.)–এর রওজা মোবারকে নিবেদন করবেন নিজের ভালোবাসার অর্ঘ্য। একদা কাজী নজরুল ইসলাম হয়তো বাঙালির সেই অভিব্যক্তিই পেশ করেছিলেন নিজের কবিতা ও গানে, ‘মদিনায় যাবি কে কে আয় আয়/উড়িল নিশান, দ্বীনের বিষাণ বাজিল যাহার দরওয়াজায়।’
তবে সেকালে এ স্বপ্ন পূরণ হতো হাতে গোনা কিছু মানুষের—যাঁদের অর্থবিত্ত ছিল, শরীরে তাকত ছিল আর ছিল দৃঢ় মনোবল, কেবল তাঁরাই পৌঁছাতে পারতেন কাঙ্ক্ষিত সেই মঞ্জিলে। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন অতি অল্প। সমাজে এসব ভাগ্যবান হাজির কদর ছিল খুব। কোনো বংশে একজন হাজি থাকা মানে সেই বংশের শান-শওকত কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া। এমনও হয়েছে গ্রামের কেউ হজ করার ফলে সেই গ্রামের পুরোনো নাম পালটে ‘হাজিপুর’, ‘হাজিগঞ্জ’, ‘হাজিপাড়া’ ইত্যাদি হয়ে গেছে।
গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত হজের পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল খুবই জটিল আর দীর্ঘ। হজের প্রস্তুতি নিতেই চলে যেত বছরের পর বছর। হজযাত্রীরা নিজেদের সব ধরনের বৈষয়িক বিষয়–আশয় থেকে মুক্ত করে তবেই যাত্রা করতে চাইতেন হজের উদ্দেশে। ফলে ছেলেমেয়ের বিয়েশাদি, সহায়-সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা ও আর্থিক লেনদেনের পাট চুকিয়ে তার পরেই না বাইতুল্লাহর মুসাফির। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই বয়স করেই হজে যেতেন, যুবা অবস্থায় তেমন কেউ যেতেন না। এর অবশ্য কিছু কারণ ছিল। অনেকেই ভয়ে থাকতেন যে আর ফিরে আসতে পারবেন না। বিপৎসংকুল দীর্ঘ যাত্রার কারণে রোগশোকে অনেকেই পথিমধ্যে মারা যেতেন, কেউ কেউ হারিয়েও যেতেন। ফলে ভাবতেন, যাব যেহেতু একেবারেই যাই। কেউ কেউ মক্কা বা মদিনায় থেকে সেখানে মারা যাওয়ার আশাও পোষণ করতেন। কারও আবার ফিকির ছিল, হজ করে আসার পর সব দুনিয়াদারি ছেড়ে দেব সুতরাং শেষ বয়সে গেলেই ভালো (!)। এ নিয়ে কবি আল মাহমুদ তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অঞ্চলের লোকজনই বয়স হলে হজে যায় অথচ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ছেলেমেয়েরা বিয়ের সাথে সাথেই হজ করতে যায়। কী যে দারুণ লাগে দেখতে।’
তখন হাজি সাহেবদের বাড়ি থেকে বিদায় দেওয়া হতো বেশ ঘটা করে। আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশী—সবাই ভেজা চোখে ঘাট বা স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতেন। এবং সবাই তাঁদের নিজ নিজ নাম উচ্চারণ করে নবী (সা.)–এর প্রতি সালাম দিতেন। হাজি সাহেবের ওপর দায়িত্ব থাকত তিনি যেন মদিনায় গিয়ে নবীজির রওজায় সালামটুকু পৌঁছে দেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের আনাচকানাচ থেকে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে, গরু-মহিষের গাড়িতে চেপে বা দাঁড়টানা নৌকায় করে তখনকার বোম্বে বন্দরে (এখন মুম্বাই) এসে পৌঁছাতেন হাজিরা। বোম্বাই পর্যন্ত ছিল পেশাদার পথপ্রদর্শক। তখন বোম্বেতেই অনেকের সফরের সমাপ্তি ঘটত। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তেন, কেউ আবার জাহাজ মিস করতেন। ফলে সেখানেই তাঁরা রয়ে যেতেন, বাকি হাজিরা ফিরে আসা পর্যন্ত। বাকিরা এলে তাঁদের সঙ্গে ঘরে ফিরতেন। এঁদের বলা হতো বোম্বাই হাজি।
হজযাত্রার উদ্দেশে সে সময় বোম্বে থেকে জাহাজ প্রথমে রওনা হতো পাকিস্তানের করাচিতে। সেখান থেকে জাহাজে উঠতেন আরও হজযাত্রী। এরপর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আরব উপদ্বীপের এডেন বন্দরে ভেড়ান হতো জাহাজ। পথে ঝড়ঝঞ্ঝার দুর্ভোগ তো ছিলই।
বাঙালি হাজিদের মধ্যে খান বাহাদুর আহছানউল্লা হজে গিয়েছিলেন ১৯১২ সালে। হজ থেকে ফিরে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখে গেছেন আমার জীবন ধারা নামক বইয়ের ‘আমার হজ’ অধ্যায়ে। এখানে পাওয়া যায় ভয়ংকর সমুদ্রযাত্রার বিবরণ, ‘আমি করাচি বন্দরে গিয়ে জাহাজে উঠি। জাহাজের প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণি ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণি ছিল না। প্রথম শ্রেণির টিকিটের দাম ৪৫০ টাকা। প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জাহাজের দোতলায় থাকার জায়গা দেওয়া হলো। আমাদের সঙ্গে প্রচুর চাল, ডাল, ঘি, চিনি ও চা ছিল। আমাকে রান্নার ভার দেওয়া হলো। আমি দুপুরে খিচুড়ি রাঁধতাম। রাতে আমার একজন সহযাত্রী ইন্সপেক্টর সাহেব রুটি তৈরি করতেন। মঞ্জিলে মঞ্জিলে কেবল জ্বালানি কাঠ ও পানি খরিদ করা হতো। পথিমধ্যে মাছ দুষ্প্রাপ্য ছিল। তবে ছাগলের মাংস পাওয়া যেত। জাহাজ সোকোট্টার (ভারত মহাসাগরে চারটি দ্বীপের একটি মালা, ইয়েমেনের অংশ) কাছে পৌঁছালে সমুদ্রে গর্জন শুরু হয়। উত্তাল তরঙ্গে জাহাজ দুলে ওঠে। আমাদের কামরার কাচের সব বাসনপত্র ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। অন্ধকারের ভেতর আমি হাঁটু গেড়ে জাহাজের শিকল ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। ডেকের যাত্রীরা বমি ও মলমূত্র ত্যাগ করে দেয়।’
তবে মাঝেমধ্যে আবার এই সমুদ্রযাত্রা সুখকর হয়ে উঠত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে। জাহাজ সাধারণত উপকূল থেকে কিছুটা দূরে দিয়ে যায়। রাতে উপকূলে অনেক বিজলি বাতি নজরে পড়লে বোঝা যেত যে কোন নগরী অতিক্রম করা হচ্ছে। বিভিন্ন শহর-নগর অতিক্রমকালে মাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হতো। বঙ্গোপসাগরে সূর্যাস্তের সময় হাজার হাজার হাঙর দেখা যেত। বিরাট আকারের তিমি ভেসে উঠত জাহাজের কাছে এসে। উড়ুক্কু মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে কখনো পড়ত জাহাজের পাটাতনে। সে ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ‘সমুদ্রপথে হজ গমন অভিজ্ঞতা’ নামের একটি লেখায় হজ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা এভাবেই বিবৃত করেছেন অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম।
হজ শেষে বাড়ি ফিরে এসব গল্প করতে করতেই মাস ছয়েক কাটিয়ে দিতেন হাজি সাহেবরা। কতসব গল্প যে থাকত তাঁদের ঝুড়িতে!
এডেনে যাত্রাবিরতির পর ইয়েমেনের উপকূলীয় দ্বীপ কামারানে কোয়ারেন্টাইনের জন্য নামিয়ে দেওয়া হতো হাজিদের। কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে অবস্থানের সময়সীমা হাজিদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে কখনো এক সপ্তাহ কখনো এক মাস করা হতো। কোয়ারেন্টাইন শেষে জাহাজে করে অবতরণ করা হতো জেদ্দায়। পথিমধ্যে ইয়ালামলাম নামক স্থানে ইহরাম বাঁধতে হতো। এটা ভারতীয় উপমহাদেশের মিকাত (হজের নিয়ত ও ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত এলাকা)।
জেদ্দায় অবতরণের পর হাতে সময় থাকলে কাফেলা রওনা হতো মদিনার দিকে। কিন্তু হাতে যদি সময় না থাকত তবে তাঁরা রওনা হতো কাবার পথে—মক্কায়। সেকালে সবচেয়ে কষ্টকর ছিল মরুর এ যাত্রাপথ। একে তো সূর্যের তাপ, অন্যদিকে বেদুইন দস্যুদের অত্যাচার। সুযোগ পেলেই অতর্কিত হামলা চালাত দস্যুরা।
খান বাহাদুর আহছানউল্লা জানাচ্ছেন, ‘জাহাজ জেদ্দা বন্দরে পৌঁছাল। এরপর আমরা উটের পিঠে উঠে মদিনা শরিফ অভিমুখে যাত্রা শুরু করি। মদিনা শরিফ এখান থেকে ২৫০ মাইল দূরে। পথে অনেক মঞ্জিল রয়েছে। প্রত্যেক মঞ্জিলে জ্বালানি কাঠ ও মসকভরা পানি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় কফি, খেজুর আর তরমুজ। বাদ-জোহর কাফেলা চলত। শেষরাতে এসে মঞ্জিলে পৌঁছাত। আমাদের কাফেলায় ৩০০টি উট ছিল। শত্রুভয়ে কাফেলা পথে থামত না। মঞ্জিলে পৌঁছানোর পর গোসল, পায়খানা-প্রস্রাব ও খাওয়াদাওয়া সম্পন্ন হতো। আমরা কয়েকটি মঞ্জিল খুব কষ্ট করে পৌঁছালাম। রাত নামলেই শত্রুরা বন্দুক ও তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসত। তাদের টাকা দিয়ে খুশি করতে হতো। এদের উৎকোচ দিতে গিয়ে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লাম। আমরা তাদের সঙ্গে লড়াই করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। একজন হারামি (শত্রু) এসে তলোয়ার দিয়ে আমাদের কাফেলা যাত্রীর আঙুল কেটে দেয়।’
তখন কেবল যে দস্যু বা বেদুইনদের হামলা ছিল তা নয়, ছিল পানি ও খাবারের সংকট। প্রায়ই কাফেলার খাবার শেষ হয়ে যেত। সে সময় কাফেলার লোকজন আরব লোকদের বাড়ি গিয়ে উঠত। আরবরা অবশ্য আপ্যায়নে কখনো কার্পণ্য দেখাতেন না—সেকালের বিভিন্ন হাজির স্মৃতিকথায় এমনই উল্লেখ আছে।
মক্কায় পৌঁছার পর সুবিধামতো জায়গায় তাঁবু গেড়ে হজের মূল কার্যাদি পালন করতেন হাজিরা। কাবা শরিফ তাওয়াফ করা, জামারায় শয়তানকে উদ্দেশ্য করে পাথর নিক্ষেপ, সাফা-মারওয়া সায়ী করা ইত্যাদি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে প্রকাশিত ১৯৫৩ সালের এক ছবিতে দেখা যায়, হাজিরা বাজার থেকে দরদাম করে কোরবানির জন্য দুম্বা কিনছেন। আরেক ছবিতে দেখা যায়, মিনার ময়দানে খোলা আকাশের নিচে তাঁরা খাবার পাকাচ্ছেন, যা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব।
হজের সময় মক্কা শহরে আলাদা একটা উৎসবের আমেজ দেখা দেয়। সেকালেও দিত। আরবরাও বেশ আনন্দে থাকত তখন। বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর সফরনামায় উল্লেখ করেন, তিনি ১৩২৫ সালে হজ পালন করেন। তাঁর বর্ণনায় ভিন্ন রকম এক মক্কার দেখা পাওয়া যায়: হজের সময়ে হাজারো মুসলমান পুণ্যার্থীর ভিড়ে রীতিমতো গমগম করে পুরো নগর। এ সময় অকাতরে দানখয়রাত করেন হাজিরা। দান করার সময় কোনো দরিদ্র লোককে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলে তার মুখে সোনার মোহর গুঁজে দিচ্ছেন হাজিরা—এমন দৃশ্যও দেখেছেন ইবনে বতুতা।
হজের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার পর কাফেলা যাত্রা করত মদিনা অভিমুখে। আবারও মাইলের পর মাইল মরুযাত্রা। যেখানেই পানি আর ছায়ার সন্ধান পাওয়া যেত, সেখানেই যাত্রাবিরতি করত কাফেলা। খানিক বিশ্রামের পর আবার পথচলা শুরু—সকাল আর বিকেলবেলাতেই কেবল উট চলত। দুপুরের সময়টাতে নেওয়া হতো বিশ্রাম। এভাবে মদিনায় পৌঁছার পর নবী (সা.)–এর রওজায় লুটিয়ে পড়তেন সবাই, রওজা দর্শনে কেউ কেউ এতটাই আত্মহারা হয়ে উঠতেন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন তাঁরা। মদিনা জিয়ারত শেষে অতঃপর আবার যাত্রা শুরু হতো ঘরের দিকে। তখন কাফেলার জনসংখ্যা আর আগের মতো থাকত না, অনেকেই মারা যেতেন।
ছয়–সাত মাস পরে জমজমের পানি আর মদিনার খেজুর নিয়ে কোনো এক সন্ধ্যায় হজ থেকে ফিরে আসা হাজিরা হাজির হতেন পরিবার–পরিজনের কাছে। নতুন হাজি ফিরেছেন শুনলেই পাড়া-প্রতিবেশী জড়ো হতো তাঁকে দেখতে। চাঁদের আলোয় উঠানে পাটি বিছিয়ে তাঁর কাছ থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত মক্কা–মদিনার গল্প। আর এভাবেই সেকালে গ্রামে–গ্রামে, মহল্লায়–মহল্লায়—মানুষের মুখে মুখে রচিত হতো হজের অপূর্ব ভ্রমাণাখ্যান।
সূত্র: আমাটর জীবনধারা, খান বাহাদুর আহছানউল্লা, রাসুল সা.–এর পদপ্রান্তে, মোস্তফা জামান আব্বাসী, ‘সমুদ্রপথে হজ গমন অভিজ্ঞতা’, অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম, ‘ইবনে বতুতার হজযাত্রা’ ও উইকিপিডিয়া