অদ্বৈত মল্লবর্মণ একটি নদীর নাম
>
তিতাস একটি নদীর নামখ্যাত কথাকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ। নিজের লেখায় বলেছেন নিম্নবর্গীয় মানুষের কথা। ১৬ এপ্রিল ছিল তাঁর মৃত্যুদিন। প্রচ্ছদে রয়েছেন তিনি, আছে তাঁর কিছু দুষ্প্রাপ্য কবিতাও।
একবার আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, একাত্তর টেলিভিশন থেকে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম—এই দুটো উপন্যাসে জেলেজীবন ও সমাজচিত্র উপস্থাপনের মৌলিকতা আর আন্তরিকতায় কোনটাকে সেরা বলে মনে করেন?
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির কোনো এক রাতের অনুষ্ঠান ছিল এটি। সাহিত্য অনুষ্ঠানই ছিল। অনুষ্ঠানে ছিলেন শামসুজ্জামান খান, সেলিনা হোসেন, লুৎফর রহমান রিটন এবং একজন প্রকাশক—তাঁর নাম এখন মনে নেই আমার। প্রশ্নটা করেছিলেন মিথিলা ফারজানা, তিনিই অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন। আমাকে চট্টগ্রাম থেকে ওই অনুষ্ঠানে যুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল।
কালক্ষেপণ করিনি আমি। উত্তরটা যে আমার জানা ছিল। বলেছিলাম, অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নাম জেলেজীবনের পাঁচালি। শুধু পদ্মা নদীর মাঝি কেন, পরে গঙ্গা, গহিন গাঙ, গঙ্গা একটি নদীর নাম, অবগাহন—এসব জেলেজীবনভিত্তিক যে যে উপন্যাস রচিত হয়েছে, এদের কোনোটিই তিতাস-এর সমতুল্য নয়। নদীপাড়ের কৈবর্তজীবনের অনুপুঙ্খ দলিল বলা যেতে পারে তিতাসকে। আমার মতে, অদ্বৈতের তিতাস এখনো একক এবং তুলনাহীন।
আমার উত্তর অনুষ্ঠানের কেউ মেনে নেননি। শামসুজ্জামান খান ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়েছিলেন। সেলিনা হোসেন অসমর্থনের মৃদু হাসি হেসেছিলেন। রিটন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, এই উত্তরের জন্য তাঁরা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না।
কিন্তু প্রকৃত উত্তর তো এটিই—জেলেজীবনের বিশ্বস্ত, অকৃত্রিম উপস্থাপন যদি দেখতে চান কেউ, তা শুধু তিতাস-এই খুঁজে পাওয়া যাবে। অন্যান্য উপন্যাসে খামতি থেকে গেছে। তিতাস–এর চরিত্ররা কল্পনার রসে জারিত নয়, এখানকার ঘরবাড়ি-উঠান, নৌকা-জাল-মাছ-পথঘাট-নদীপাড়—সবই বাস্তব এবং জীবন্ত। এই উপন্যাসে আমি আমার ফেলে আসা জীবনকে দেখতে পাই। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলেপাড়া যে গোকর্ণঘাট হয়ে তিতাস-এ চিত্রিত হয়েছে!
যা হোক, আমার উত্তরটির প্রতিক্রিয়া ওই অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, আমার শহর চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পর, রাত ১১টা হবে তখন, আমার ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল। ওপার থেকে যিনি কথা বললেন, তাঁকে আমি চিনি, দাশগুপ্ত মশাই। বয়স আমারই মতন, সাহিত্যচর্চা করেন। কোনো ভূমিকা ছাড়া সরাসরি বললেন, ‘সাহস তো কম নয় আপনার! বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর জাইল্যারে স্থান দিলেন! অল্পবিদ্যায় ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন, না? ছাড়ুন এসব, নইলে...?’ দাশগুপ্তবাবু একটু থামার পর বলেছিলাম, ‘আমার যা বিশ্বাস, তা-ই বলেছি। আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন না। আর হ্যাঁ, এ রকম ধমকে আর কত দিন পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখবেন আমাদের?’
‘তবে রে...।’ ওপাশ থেকে গর্জে উঠেছিলেন দাশগুপ্তবাবু।
এরপরে জল অনেক দূর গড়িয়েছিল। চট্টগ্রাম শহরে আমার ‘জিনা হারাম’ করে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর বর্ণবাদী ছোবলে আমি রক্তাক্ত হয়েছিলাম। যাক, ওটা ভিন্ন একটা অধ্যায়। এই ঘটনায় আমার একটা বড় প্রাপ্তি ঘটেছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণকে আমি আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলাম।
এই লেখা লিখতে লিখতে আরেকজনের কথা মনে পড়ে গেল, তিনি শান্তনু কায়সার। সবাই জানেন, এ দেশে অদ্বৈতকে নতুন করে পরিচয় করিয়েছেন শান্তনু কায়সার। তাঁর লেখাজীবনের সিংহভাগ তিনি ব্যয় করেছেন অদ্বৈতের জন্য। অদ্বৈত মল্লবর্মণের বাবার নাম সবাই জানেন, কিন্তু সেদিন পর্যন্ত তাঁর মায়ের নাম জানতেন না কেউ। শান্তনু কায়সারই আবিষ্কার করেছেন অদ্বৈতের মায়ের নামটি। অদ্বৈত-গবেষণার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন এপার বাংলায়-ওপার বাংলায়। তো শান্তনু কায়সারও আমার ওপর রুষ্ট হয়েছিলেন একদা। পরে অবশ্য তাঁর আর আমার মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছিল। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অদ্বৈত স্মরণ মেলার কারণে।
১৯৯৯ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম আমি, মুক্তকণ্ঠ-এর ‘খোলা জানালা’য়, নাম ছিল ‘পদ্মা-তিতাস-গঙ্গা; ধীবরজীবনভিত্তিক তিনটি উপন্যাস: পর্যালোচনার ভূমিকা’। তিনটি উপন্যাসের ভাষা নিয়ে বলতে চেয়েছিলাম আমি। লেখাটি পড়ে বেশ অখুশি হয়েছিলেন শান্তনু কায়সার। তাঁর অসন্তুষ্টির কথা পরবর্তী সংখ্যায় চিঠি আকারে জানিয়েছিলেন। তাঁর উষ্মা লেখাটির অপরিপক্বতাকে ছাড়িয়ে আমার গাঁ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল। চিঠিটির মোদ্দা বক্তব্য ছিল, এ আবার কে? অদ্বৈতকে নিয়ে লিখেছে! ওই থেকে অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রতি আমার ভালোবাসার শুরু। দাশগুপ্তে এসে সেই ভালোবাসা আরও গাঢ় হলো।
একসময় দুটো বই আমার হাতে এল—অচিন্ত্য বিশ্বাস সম্পাদিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র এবং অচিন্ত্য বিশ্বাসেরই লেখা অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও তিতাস একটি নদীর নাম। বই দুটো আমার সামনে ‘অদ্বৈতের দরজা’ খুলে দিল। জানতাম, অদ্বৈত চারটি উপন্যাস লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। জানলাম, এগুলো ছাড়া তিনি চারটি ছোটগল্প, ছয়টি কবিতা, অনেক প্রবন্ধ, চিঠিপত্র এবং ‘ভারতের চিঠি—পার্লবাককে’ নামের অসাধারণ এক রাজনৈতিক লেখা লিখেছেন। দ্বিতীয় বইটিতে অদ্বৈতের নিবিড় একটা পাঠ নেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করলেন অচিন্ত্য বিশ্বাস।
সেই থেকে অদ্বৈত আমার সঙ্গী, আমার অনুপ্রেরণা। এখন অনেকে আমার লেখাজোখা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে অদ্বৈতের কথা মনে করিয়ে দেন। বলি, অদ্বৈতের লেখা আমার প্রাণরস; বলি, তিতাস একটি নদীর নামই আমাকে জলপুত্র, দহনকাল, প্রস্থানের আগে, কৈবর্তকথা, নোনাজলে ডুবসাঁতার লিখতে প্রাণিত করেছে।
তবে আরেকজনের কথা ভুলি কী করে! তিনি ব্যাসদেব, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। অদ্বৈত যেমন জেলেনির গর্ভে জন্মেছেন, আমিও তেমনি। কৃষ্ণদ্বৈপায়নও সে রকম। মৎস্যগন্ধা নামের এক জেলেকন্যার সন্তান এই ব্যাসদেব। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ হলেও গীতাকেই প্রকৃত ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া হয়। এই শ্রীমদ্ভাগবতগীতা, মহাভারত এবং আরও আঠারোটি পুরাণ রচনা করেছেন দ্বৈপায়ন। মহাভারত মহাকাব্য এবং পৃথিবীতে স্মরণীয় সাহিত্যকর্মের একটি। সেই সূত্রে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ঐতিহ্য ব্যাসদেব আর আমার পুরোধা ব্যাসদেব আর অদ্বৈত।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ পরলোকগমন করার ৫৬ বছর পর লিখতে বসলাম আমি। সাধে যে কলম ধরলাম, তা কিন্তু নয়। আমার প্রথম উপন্যাস যখন বেরোয়, তখন আমার ৫৫। বর্ণবাদিতার শিকার হয়েই লিখতে হলো আমাকে। অদ্বৈতও বর্ণবাদী করাত থেকে রেহাই পাননি। তিতাস-এ তার স্পষ্ট উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। তাঁর সঙ্গে আমার মিল আছে যেমন, গরমিলও প্রচুর। দারিদ্র্য আমাদের দুজনকেই কুরে কুরে খেয়েছে। প্রধান গরমিল এটা যে সাঁইত্রিশে মারা গেলেন কবি-স্বভাবী অদ্বৈত, আর সাতষট্টিতেও দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি আমি।
তাঁর ‘মোদের রাজা মোদের রাণী’ কবিতাটি পড়ে ভালো লাগেনি আমার। বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতাম, ‘স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মাত্র ১২ বছর আগে ব্রিটিশ রাজরানির বন্দনা করে এই কবিতা লিখলেন কেন?’ তবে ‘ত্রিপুরালক্ষ্মী’ কবিতাটি আমার এই বেদনা ভুলিয়ে দেয়। কবিতাটি আত্মজৈবনিক ঢঙে লেখা হলেও দরিদ্র বাঙালির জীবনবৃত্তই যেন এই কবিতায় তৈরি করেছেন অদ্বৈত। একটু উদাহরণ—
‘অনশনে, অর্ধাশনে জীর্ণ শীর্ণ কঙ্কালের মতো
রয়েছে পড়িয়া,
নাহি মা প্রাণের সাড়া নাহি
উৎসবের ধারা
প্রাণে আছে যেন মরমে মরিয়া।’
২০০৩ সালে আমার নবীনগর সরকারি কলেজে পোস্টিং হয়। নবীনগর ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই একটি উপজেলা। তিতাস নদের শাখাপাড়েই কলেজটি। সকালের দিকে কলরোল থাকলেও দুপুরের পর কলেজটি জনমানবহীন। কলেজ হোস্টেলের চতুর্থ তলায় একা থাকি আমি। জানালা খুললেই তিতাস নদ। শীতল জল। কাকচক্ষুর মতো কালো। সবুজের চাদর বিছানো দুপাড়ে। তিতাস আমায় ডাকে, আয় আয়। বিকেলে নদপাড়ে গিয়ে বসি। অদূরেই ঘাট, গঞ্জ। গঞ্জের কোলাহল। ঘাট থেকে বোট ছাড়ে। যায় কোথায়? কোথায় আবার—মউল্লা, উরকুলিয়া, কৃষ্ণনগর গোঁসাইপুর, ভৈরবনগর—এসব গাঁয়ের ঘাটে! আর, আর কোথায় যায় বোটটি? বোটের আড়কাঠি আবু তাহের বলে, ‘আর যায় গোকর্ণঘাটে। ওটাই বোটের শেষ গন্তব্য।’ ‘কোন গোকর্ণঘাট?’ শুধাই আমি। আবু তাহের অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। ভাবে, পাগল নাকি!
অদ্বৈতের জন্মভিটায় গিয়েছিলাম আমি, গোকর্ণঘাটের মালোপাড়ায়, ভদ্দরনোকদের কাছে যা গাবরপাড়া। সঙ্গে ছিলেন নবীনগর কলেজেরই এক অধ্যাপক, মোক্তার হোসাইন। এক দুপুরে চড়ে বসেছিলাম বোটে। নানা গাঁ-গেরাম ছাড়িয়ে, বহুদূরান্তের জলপথ মাড়িয়ে বিকেল নাগাদ গোকর্ণঘাটে নেমেছিলাম। হাতের কাছে জেলেপাড়াটি। লালমোহন নামের এক প্রবীণ পথ দেখিয়ে মালোপাড়ায় ঢুকিয়েছিলেন। তিনি মালো কি না, জিজ্ঞেস করায় তেড়ে উঠেছিলেন লালমোহন। বলেছিলেন, ‘মালো না আমি! আমাদের পদবি মল্লবর্মণ না, শুধু বর্মণ।’
একটু পরেই অদ্বৈতের জন্মভিটার সামনে দাঁড় করিয়ে লালমোহন বলেছিলেন, ‘এইডাই অদ্বৈত মল্লবর্মণের ভিডা।’ মুচকি হেসেছিলাম একটু। নিশ্চয় গভীর কোনো সামাজিক বেদনায় তিনি একটু আগে তাঁর সম্প্রদায়–পদবি অস্বীকার করেছিলেন।
দেখেছিলাম কালো মাটির একচিলতে ভিটায় ছনে ছাওয়া একটা জীর্ণ ঘর দাঁড়িয়ে আছে। একটা টিংটিঙে অধিক বয়সী নারকেলগাছ ঘরটির পাশে। বুঝতে পারছিলাম না, কে কার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—ঘরটি গাছের গায়ে, না গাছটি ঘরের গায়ে। ভাবতে ভালো লাগছিল, নারকেলের চারাটি অদ্বৈত রোপণ করেছিলেন। সেবারই সুনীলের সঙ্গে দেখা আমার। একটু আগে তিতাস থেকে ফিরেছে সে। সঙ্গে জাল। আমাকে অদ্বৈতের জন্মভিটার মাটি ছুঁতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেছিল সুনীল।
মনোমোহিনী বলেছিলেন, ‘সুনীল আমার ছাওয়াল। আমি অদ্বৈতের লতায়-পাতায় বউদি হই। আত্মীয়ের দাবিতে আমরা ওই ভিটাতে থাকি।’
আঁধার ঘন হতে শুরু করেছিল। মোক্তার সাহেব তাগাদা দিয়েছিলেন, ‘চলেন স্যার, আমাদের যে অনেক দূর যেতে হবে!’
২০০৩ সালের পর অনেকটা বছর কেটে গেল। তাই বলে অদ্বৈত আমাকে ছাড়েননি। অদ্বৈত ছাড়েননি মানে অদ্বৈত-অনুরাগী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ বারবার আমাকে ডেকে নিয়েছে।
এর মধ্যে ২০১৫ সালে আমাকে আগরতলায় যেতে হলো, সে অদ্বৈত মল্লবর্মণেরই কল্যাণে। অদ্বৈতের ১০১তম জন্মবর্ষ পালিত হচ্ছিল আগরতলার কেসতলিতে। সাতচল্লিশের পর, একাত্তরের সময় লাকসাম-কুমিল্লা-আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৈবর্তরা ওই কেসতলিতে জড়ো হয়েছিল। রুদ্রসাগরকে ঘিরে জেলেদের ঘরবসতি গড়ে উঠেছিল। দেশছাড়া-ছন্নছাড়া মানুষগুলো নিঃসম্বল অবস্থায় ওখানে গিয়েছিল। সঙ্গে করে কিছুই তারা নিতে পারেনি সত্যি, কিন্তু হৃদয়ে করে নিয়ে গিয়েছিল অদ্বৈত মল্লবর্মণকে। অনুষ্ঠানে এত বিপুল মানুষ দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম আমি। জিজ্ঞেসও করে বসেছিলাম, ‘অদ্বৈত কখনো কেসতলিতে আসেননি, অদ্বৈতের জীবন ও সাহিত্যকর্মের সঙ্গে এই কেসতলির কোনো যোগসূত্র নেই, তারপরও অদ্বৈতের জন্মানুষ্ঠানে এ-ত মানুষ!’
পাশে বসা তফসিলি কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী রতন ভৌমিক বলে উঠেছিলেন, ‘ভালোবাসা দাদা, অদ্বৈতকে ভালোবাসেন বলেই এঁরা এখানে জড়ো হয়েছেন।’
অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে গল্প লিখেছি একটা—‘তিতাসপাড়ের উপাখ্যান’। গল্পটির পেছনে একটু ইতিহাস আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবি জয়দুল হোসেন, মানবর্ধন পাল আমায় ভালোবাসেন খুব। ওই ভালোবাসা মনির হোসেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। একবার মনির অদ্বৈতের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করলেন। চট্টগ্রাম থেকে আমাকেও ডাকলেন। আমি কবি আইউব সৈয়দকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা একদিকে উল্লাসের, অন্যদিকে মর্মবেদনার। যাতনা আর আনন্দেরই ফসল ওই গল্প।
যতবারই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাই, অন্তত একবার ঘুরে আসি গোকর্ণঘাটের জেলেপাড়ায়। সেবারও, মানে ২০১৭-তেও না গিয়ে পারিনি। অন্তর বলেছে—যাও, যাও শংকর। ভালোবাসা অন্তরের গলায় জোর জুগিয়েছে।
সেবার যেতে যেতে বেলা হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে বন্ধু মানবর্ধন পাল। সঙ্গী-সাথি নিয়ে মনির হোসেন তো ছিলেনই। পাড়ার গলির মুখে অদ্বৈতের মূর্তি বলে যেটাকে দেখানো হলো আমায়, ভিরমি খেলাম। কিছু জড়ো করা চুন-সুরকির গায়ে ঘন কালো রঙের প্রলেপ।
যাহোক, অদ্বৈতের জন্মভিটাটা তো দেখতেই হয়। গিয়ে দেখলাম, আগেকার ছনের ঘরের জায়গায় টিনের দোচালা। ঘরে ঢোকার পইঠাটা বাঁধানো। একচিলতে উঠান যে ছিল, যেখানে আমি প্রথমবার গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে আরেকটি ঘর, বেশ শক্তপোক্ত। সুনীলের সঙ্গে সেবারও দেখা। সে আরও বেশি হাড়জিরজিরে হয়ে গেছে। কিন্তু ওই সময়ের তার ক্ষীণকায় সন্তানেরা বেশ পুষ্ট হয়ে উঠেছে। ছোট্ট ঘরটি বুঝি রান্নাঘর। বেশ ভাজিভুজির আওয়াজ পাচ্ছিলাম।
স্বভাব যায় না মলে—আমারও সেই রকম অবস্থা। যেকোনো জেলেপাড়ায় গেলে আমি জেলেসন্তানদের লেখাপড়ার খোঁজ নিই। সেদিনও তা-ই নিচ্ছিলাম। সামনে তখন মালোপাড়ার ছোট-বড় বাচ্চারা আর দু-চারজন প্রবীণ। স্বভাবদোষে বলছিলাম, ‘তোমরা লেখাপড়া করবে সবাই। দেখো, আমিও মালো। লেখাপড়া করেছি বলে এই দেখো আমার গায়ে ভালো জামাকাপড়। চাকরিও পেয়েছি আমি ওই লেখাপড়া করার কারণে।’
হঠাৎ কানে কর্কশ এক নারীকণ্ঠ ভেসে এল, ‘ভাষাণ দিয়েন না, ভাষাণ দিয়েন না। উফ্ ভাষাণ শুইনতে শুইনতে কান ঝালাপালা হইয়ে গেল!’ উঠানে দাঁড়ানো এক প্রবীণ গর্জে উঠলেন, ‘থামো! তুমি সুনীলের পুতের বউ। কার ভিডায় আছ তোমরা? অদ্বৈত জন্মাইছিলেন বইলেই মানুষ এই গোকর্ণ ঘাটের জাইলাপাড়ায় আহে।’
সেই দিন মাথা নিচু করেই মালোপাড়া থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি। এই কাণ্ড দেখে স্বর্গ থেকে ছুটি নিয়ে আসা অদ্বৈত মল্লবর্মণও ব্রাহ্মণবাড়িয়া দেখা অসমাপ্ত রেখে স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন। ‘তিতাসপাড়ের উপাখ্যান’ গল্পের উপসংহারে লিখেছিলাম আমি:
আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম-এর পর তাঁর আর কোন সাহিত্যকর্মের কথা বলবেন আপনি?’
আমি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছোটগল্পের কথা বলব। চারটি গল্প তাঁর বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। দু-একটি নতুন গল্প এর মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু এগুলো এখনো অদ্বৈতের বলে প্রমাণিত হয়নি। স্বীকৃত গল্প চারটি হলো ‘সন্তানিকা’, ‘কান্না’, ‘বন্দীবিহঙ্গ’ ও ‘স্পর্শদোষ’। ‘সন্তানিকা’র পটভূমি অজানা এক মফস্বল। ‘কান্না’ গল্পে গোকর্ণঘাট-নবীনগর স্পষ্ট। সব গল্পকে ছাড়িয়ে গেছে ‘স্পর্শদোষ’ গল্পটি। কুকুর ও মানুষের সম্পর্ককে ছাড়িয়ে ‘স্পর্শদোষ’ শেষ পর্যন্ত মানবিক মূল্যবোধের গল্প হয়ে উঠেছে।
অদ্বৈত মল্লবর্মণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘মানিকের পদ্মা নদীর মাঝির পর জেলেদের নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন?’ বিচক্ষণ অদ্বৈত উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মানিক তো বাওনেরা পোলা, আমি জাউলার পোলা।’ আমাকেও কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, ‘জেলেজীবন নিয়ে এত উপন্যাসের পর জলপুত্র, দহনকাল লিখতে গেলেন কেন?’ আমি স্বগত উত্তর দিই, ‘আগেরগুলো নদীপাড়ের জেলেদের নিয়ে, জলপুত্র, দহনকাল সমুদ্রপাড়ের জেলেদের নিয়ে।’ স্পষ্ট করে বলি, ‘জেলেদের নিয়ে আমি আর লিখব না, যদি ওদের জীবনবৃত্তান্ত লিখবার জন্য বাংলাদেশে অন্তত দুজন ঔপন্যাসিক কলম ধরেন।’ বড় দুঃখে একদিন লিখেছিলাম—
গঙ্গা-পদ্মা-তিতাসপাড়ে,
মাছমারাদের জীবন বাড়ে।
বর্তমানের মল্ল-বসু-মানিক
হিমি-বিলাস-মালা জীবন
লিখুন না আজ খানিক।
কথাটা হয়তো আবেগতাড়িত ঠেকবে অনেকের কাছে, তারপরও লিখছি, অদ্বৈত মল্লবর্মণ আমার আজন্মলালিত উজ্জ্বল স্মৃতি, আমার হৎপিণ্ডছোঁয়া মানচিত্র। অদ্বৈত মল্লবর্মণ একটি নদীর নাম। তাঁর লেখাগুলো আমার অস্থিরতার তুমুল গভীরে স্বস্তির শিশিরবিন্দু। অদ্বৈত আমার নিত্যদিনের আনন্দমেলার ঝুমঝুমি। মল্লবর্মণ জলদাসের রত্নখচিত সৌন্দর্য।
জানা–অজানার অদ্বৈত মল্লবর্মণ
● অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিখ্যাত উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম তাঁর জীবৎকালে প্রকাশিত হয়নি। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, এখন আমরা তিতাস একটি নদীর নাম–এর যে রূপ দেখতে পাই, সেটি পুরো উপন্যাস নয়, অদ্বৈতের মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধু এবং পুঁথিঘর প্রাইভেট লিমিটেডের কর্ণধার সুবোধ চৌধুরী উপন্যাসটির সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি না-ছেপে, বাহুল্য ভেবে সম্পাদনা করে, এমনকি কিছু কিছু বাদ দিয়ে এটি প্রকাশ করেন।
● অদ্বৈত মল্লবর্মণের পিতা অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিতাস নদসংলগ্ন গোকর্ণ গ্রামের হতদরিদ্র জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই লেখকের কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর যে ছবিটি সব জায়গায় এখন ছাপা হয়, সেটি হাতে আঁকা স্কেচ।
● অদ্বৈত মল্লবর্মণেরা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর আগেই সবাই মারা যান। আর তিনি মারা যান অবিবাহিত অবস্থায়। ফলে এখন তাঁর কোনো উত্তরাধিকার বা বংশধর জীবিত নেই।
● পুরো জীবনটাই অদ্বৈত কাটিয়েছেন ক্ষুধার যন্ত্রণা ও অসুস্থতা নিয়ে। উপোস থেকে খালি পেটে, খালি পায়ে কয়েক মাইল হেঁটে স্কুলে গিয়ে নিম্ন শ্রেণির জন্য নির্দিষ্ট স্থানটিতে বসে ক্লাস করতেন। কিন্তু বরাবর ভালো রেজাল্ট ছিল তাঁর। ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম শ্রেণি (১৯৩৩) পেয়েছিলেন। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলেও দারিদ্র্যের জন্য আইএ পাস করা হয়নি। এরপর কলকাতায় যান ভাগ্যান্বেষণে। প্রথমে মাসিক ত্রিপুরা, পরে জাতীয়তাবাদী সাপ্তাহিক নবশক্তি, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক আজাদ, নবযুগ, কৃষক ও সাপ্তাহিক দেশ প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করেছেন।
● অদ্বৈতর জন্মস্থান গোকর্ণ গ্রামের সবাই ছিলেন ভয়ানক দরিদ্র। তবু গ্রামবাসীরা মেধাবী বলে চাঁদা তুলে অদ্বৈতকে শিক্ষাগ্রহণের জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, শিক্ষিত হয়ে অদ্বৈত তাঁদের সমষ্টিগত দুঃখ-দুর্দশা নিরসনে ভূমিকা রাখবেন। অদ্বৈতও তাঁদের হতাশ করেননি, স্ব–শ্রেণির দুঃখ–জর্জরিত মানুষের জীবনকাহিনি তিনি লিখে গিয়েছেন মৃত্যুর হাত বেঁধে রেখে।
● ১৯৪৮ সাল থেকেই গুরুতরভাবে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন অদ্বৈত। সে সময় সবার আগে দেশ কার্যালয়ে গিয়ে কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসতেন তিনি। যক্ষ্মারোগের কারণে পারতপক্ষে কারও সামনেই পড়তে চাইতেন না এ লেখক।
● জীবদ্দশায় অধিকাংশ বর্ণহিন্দু বড় কবি-সাহিত্যিকই অদ্বৈত মল্লবর্মণকে হীন চোখে দেখতেন। তাঁকে দিয়ে অনুবাদ, ফিচার রচনা—এসব কাজ করাতেন। কিন্তু মৃত্যুর পরে তাঁর সাংবাদিক, অনুবাদক, প্রুফ-সংশোধক পরিচয়ের মৃত্যু ঘটে। তিনি জাগরূক হন ‘কথাশিল্পী’ রূপে।
● ভারতের চিঠি—পার্লবাককে (১৯৪৪)—এটি ছাড়া আর কোনো বই দেখে যেতে পারেননি অদ্বৈত। এটিও একটি চিঠি, মাত্র ২৫ পৃষ্ঠার ছোট বই। অদ্বৈতর সব রচনাই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। তাঁর মৃত্যুর পর তিতাস একটি নদীর নাম এবং অন্য দুটি ছোট্ট উপন্যাস (রাঙামাটি ও সাদা হাওয়া), ৫টি গল্প, ১৪টি কবিতা, ১৩টি প্রবন্ধ–নিবন্ধ–ভূমিকা-টীকা ও নবশক্তির কয়েকটি সস্পাদকীয় প্রভৃতি নিয়ে হাজার পৃষ্ঠার রচনাবলি প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এসব রচনার বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ব্যতিরেকে কেবল তাঁর তিতাস একটি নদীর নাম–এর লেখকসত্তাই সুপরিচিত।
● বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক আরভিংস্টোনের উপন্যাস লাস্ট ফর লাইফ–এর অনুবাদ জীবন–তৃষা নামে অদ্বৈতকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নিয়েছিল দেশ কর্তৃপক্ষ। বলা ভালো, আরভিংস্টোনের এই উপন্যাস ছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়ের খনিশ্রমিকদের জীবনকাহিনি নিয়ে।
সূত্র: অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনী ও অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাবলি
গ্রন্থনা: ইসরাইল খান