বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—বাংলা সাহিত্যের চার কালজয়ী লেখক। সেই সময়ের সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নিজেদের গল্প-উপন্যাসে তাঁরা কীভাবে এঁকেছিলেন নারী চরিত্রের শক্তিমত্তাকে? লেখকদের নির্বাচিত গল্প-উপন্যাসের গুটিকয়েক চরিত্র অবলম্বনে সংক্ষিপ্ত পরিসরে জানাচ্ছেন ফারজানা লিয়াকত।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
রেনেসাঁ-উত্তর ইউরোপের সামাজিক পরিবর্তনের ছোঁয়া উপমহাদেশের নারী ও নারীর প্রতি পুরুষের মনস্তত্ত্বের ওপরেও পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (২৭ জুন ১৮৩৮—৮ এপ্রিল ১৮৯৪) সাহিত্যের নারী চরিত্রের ওপরেও পড়েছে সেই প্রভাব। ব্যক্তিজীবন, সমাজ-সংসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নিজ দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারীর চিরাচরিত মনোভাব আমূল বদলে যায় তাঁর লেখায়। দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের আয়েশা সেবা করতে গিয়ে ভালোবেসে ফেলে শত্রুপক্ষের বিধর্মী জগৎসিংহকে; এবং পরিবারের চাপানো বাগদান অস্বীকার করে। সেই সময়ের বাস্তবতায় এ চরিত্রের নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সিদ্ধান্ত আধুনিক সমাজের এক অনন্য উদাহরণ।
অন্যদিকে বিষবৃক্ষর অনাথ ও বিধবা কুন্দনন্দিনী তৎকালীন হিন্দু সমাজের চাপানো কৃচ্ছ আর বঞ্চনাকে না মেনে হয়েছে বিদ্রোহী। পেতে চেয়েছে সেই সব কিছু, যা থেকে বঞ্চিত থাকত বিধবারা। আবার সামাজিকভাবে অবৈধ সম্পর্কের জালে দ্বিধান্বিত নগেন্দ্র একবার যখন কুন্দনন্দিনী আরেকবার সূর্যমুখীতে দিশেহারা, বঙ্কিম তখন উপস্থাপন করেছেন দৃঢ়চেতা দুই নারী চরিত্রকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে ১৮৬১—৭ আগস্ট ১৯৪১) পাঠককে একসঙ্গে অনেকগুলো শক্তিশালী নারী চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন। ছোটগল্প ‘দেনা পাওনা’য় নিরুপমা চরিত্রটি তৎকালীন সমাজের সবচেয়ে ভীতিকর সামাজিক ব্যাধি ‘পণপ্রথা’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ‘আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম? না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না’—নিরুপমা এভাবেই বাবার কাছে আকুতি জানায় পণের টাকা না দিতে। আবার ‘নষ্টনীড়’ গল্পে চারুলতা সুখী হওয়ার বাসনায় সামাজিকভাবে অস্বীকৃত সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়েছে। এতে আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, তবে আত্মপ্রবঞ্চনার গ্লানি একেবারেই নেই।
অন্যপক্ষে চোখের বালি উপন্যাসে বিনোদিনী ভোগে-ভালোবাসায়, কোমলে-কঠিনে চিরাচরিত অবলা নারীর চরিত্রকে অস্বীকার করেছে অবলীলায়। আবার আধুনিক নারী চরিত্রের জন্ম দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করে শুধু পশ্চিমা ধাঁচের নারী চরিত্র গড়ে তোলেননি, চরিত্রদেরকে অনন্যরূপে প্রতিষ্ঠাও দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে শেষের কবিতার লাবণ্য বা গোরার সুচরিতার কথা তো বলাই যায়।
মীর মশাররফ হোসেন
মীর মশাররফ হোসেনের (১৩ নভেম্বর ১৮৪৭—১৯ ডিসেম্বর ১৯১১) সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস বিষাদ–সিন্ধু। এখানে প্রণয়াকাঙ্ক্ষী এজিদের বাহুবলের প্রদর্শনীর পাশাপাশি আরেক বলিষ্ঠ চরিত্র হলো জায়েদা। নিজের অধিকারের দাবি এবং স্বপত্নীর প্রতি তীব্র ঘৃণা তাকেও করেছে এজিদের মতো পরাক্রমশালী। অপরদিকে জয়নাবের নিষ্ক্রিয় এবং অনড় চরিত্রের রূপায়ণ প্রশংসা করার মতো। অন্যান্য বইয়েও নিপুণভাবে নারীকে চিত্রণ করেছেন মীর। যেমন, তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস উদাসীন পথিকের মনের কথায় বর্ণনা করেছেন সাহসী নারী জমিদার প্যারীসুন্দরীর কথা। কর সাহেব কেনীর ভয়ে যখন নারী–পুরুষ নির্বিশেষে তটস্থ, তখন প্যারীসুন্দরী আবির্ভূত হলেন উদ্ধারকর্তা হিসেবে। ফসলের জমিতে নীলচাষের অত্যাচারে জর্জরিত প্রজার দুঃখে কাতর প্যারীসুন্দরীর সাহসী এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপে নারীর শক্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সময় কেনীর স্বীকারোক্তিই এর প্রমাণ, ‘প্যারীসুন্দরীর টাকা অনেক, জমিদারিও আমার অপেক্ষা অনেক বেশি, বুদ্ধিও বেশি, সাহসও বেশি। জমিদারের মেয়ে জমিদার তাহার কথাই স্বতন্ত্র।’
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কঠিন নারী চরিত্র সৃষ্টিই নয়, নারীর পক্ষে এবং নারীর সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধেও তেজি, সাহসী এবং অনেকটা ‘চরমপন্থী’ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬—১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮)। নারীর মূল্য তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। নারীর প্রতি সমাজের অনাচার ও প্রবঞ্চনাকে প্রবলভাবে চপেটাঘাত করেছেন তিনি। বৈধব্যের অতৃপ্তির পাশাপাশি বিধবার উত্তরণের পথনির্দেশেও সরব ছিলেন এ লেখক। যদিও বেশির ভাগ লেখনীতে বিধবা নারীর মুক্তি একমাত্র প্রেমে—এই ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারেননি তিনি। আবার দেনা-পাওনা উপন্যাসে দেখা যায়, ষোড়শীর ঋজু চরিত্রের ভারে উদ্দেশ্যহীন ব্যভিচারী জমিদার জীবনানন্দ পর্যুদস্ত হয়েছে অনেকবার, তবে শেষমেশ স্বামীসঙ্গেই মুক্তি মিলেছে ষোড়শীর। চরিত্রহীন-এর কিরণময়ী বা পথনির্দেশ–এর হেমনলিনীর জীবন শুধুই প্রথাগত প্রেমনির্ভর। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা বা পরনির্ভরতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও তারা যে সামাজিক অনাচারের শিকার, তা-ও চোখ এড়ায় না সচেতন পাঠকের।