জহির রায়হানের অগ্রন্থিত গল্পঃ মনের মতো বউ
৩০ জানুয়ারি লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস। এ দিনেই প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হবে তাঁর অগ্রন্থিত গল্প সংকলন যখন যন্ত্রণা। প্রকাশিতব্য সেই বই থেকে ছাপা হলো একটি গল্প।
আধ-ময়লা খাকি শার্টটা গায়ে চড়িয়ে দিয়ে, ভাঙা আয়নাটার ভেতর আর এক প্রস্থ নিজের চেহারাটা দেখে নিল মাহের আলী। লোকে বলে, চেহারাটা নাকি ওর বড় রুক্ষ। কোমলতার কোনো ছোঁয়াচই নেই ওতে। তার ওপর চিবুকের গোড়ার পোড়া দাগটা বড় বিশ্রী ঠেকে চোখে।
আয়নায় মুখটা দেখে নিয়ে, চিরুনিটা মৃদু বুলিয়ে নিল সে চুলের ভেতর। তারপর পুলিশি বুটের খুট খুট শব্দ তুলে দাওয়ায় বেরিয়ে এল মাহের আলী। উঠোনে বসে ঘুটে বানাচ্ছিল মা, পায়ের শব্দে একবার ফিরে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। মাহের আলীও একঝলক তাকাল সেদিকে। তাকিয়ে মুখ বিকৃত করল।
কাল বিকেলে বিয়ের ব্যাপার নিয়ে মায়ের সাথে ভীষণ ঝগড়া হয়ে গেছে ওর। রাতে কেউ কারও সাথে কথা বলেনি।
সকালেও না।
দুপুরেও না।
‘যাক, কথা না বললে তার বয়ে গেল।’ হনহন করে রাস্তায় বেরিয়ে এল মাহের আলী।
সন্ধ্যা নেবে না আসতেই ধূলিঝড় উঠল শহরের বুকে। ঝোড়ো হাওয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে দ্রুত উৎক্ষিপ্ত হলো ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে। ছেঁড়া কাগজ, শুকনো পাতা আর টুকরো কাপড় বাতাসে ভেসে উড়তে থাকল। আর উড়ল ধুলা আর বালু। রাস্তায় চলমান পথিকরা নাকে রুমাল চেপে ধরল, যাদের রুমাল নেই, তারা দুই হাতে নাক ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস চালাল। আশপাশের বাড়ির জানালাগুলো খুটখাট দুমদাম শব্দে বন্ধ হতে থাকল, কোথাও বা মেয়েলি কণ্ঠের চিত্কার শোনা গেল। ‘বিন্তিয়া রে-এ, ও রে ও বিন্তিয়া, খিড়কি সব বন্ধ কার দো। বাহারসে কিচড় ঘরমে আ রাহি হ্যায়। বিন্তিয়া–রে-এ, তু কাঁহা গৈল বা।’
‘আরি আরি-ই-ই, তু কিউ চিল্লাতা হ্যায় রে, ম্যায় আয়ি-ই-ই,’ প্রতিপক্ষের ঝাঁজা গলার উত্তর শোনা গেল একটু পরে।
ধূলিঝড় বাড়ল। আরও বাড়ল। পুলিশের ছোট হাবিলদার মাহের আলী তার লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে থাকল সামনের দিকে। দীর্ঘ ঋজু দেহটা তার সামনের দিকে অল্প একটু ঝোঁকানো। রোমশ হাত জোড়া ময়লা প্যান্টটার পকেটে পোরা। সে হাঁটছিল আর দুই ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু মৃদু শিস দিচ্ছিল। হঠাৎ পাশের দোতলা বাড়ির কার্নিশ থেকে একরাশ ময়লা এসে গায়ের ওপর পড়ল তার। দূর দূর করে ছিটকে এক পাশে সরে গেল মাহের আলী। তারপর আগুনভরা দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকাল সে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না সেখানে। ধূলিঝড়ে আচ্ছন্ন চারদিক। অদূরে হিন্দুস্তানি রেস্তোরাঁয় ফিল্মের গান চালিয়েছে ওরা—মেরি জান সস্তে কি সস্তে।
সেদিকে চোখ পড়তে রাগটা কিছু শান্ত হয়ে এল মাহের আলীর। গানের সাথে তাল মিলিয়ে আবার শিস দিতে শুরু করল সে। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে রেস্তোরাঁয় এসে ঢুকল মাহের আলী।
বাইরে ঝড় ওঠায় রেস্তোরাঁটায় খদ্দেরের ভিড় খুব বেড়ে গেছে। তিলফোঁটা জায়গা নেই ভেতরে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল মাহের আলী। সন্ধানী দৃষ্টিতে কাকে যেন খুঁজে বেড়াল সে। তারপর ভ্রু দুটো কুঁচকে কোণের দিকে তাকাতেই ঠোঁটে হাসি ঝলকে উঠল তার। যাকে দেখে এ হাসি, সে তখন চুপচাপ বসে আপন মনে চারের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে। বার্ধক্যজর্জরিত মুখে চিন্তার কোনো লেশ নেই। আপনভোলা বুড়ো। বুড়োর সামনের চেয়ারটা খালি হতে খপ করে তার ওপর বসে পড়ল মাহের আলী, ‘কী বুড়ো, তোমায় আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান। আর তুমি এখানে বসে বসে চুকচুক করে চা খাচ্ছ?’
‘খাচ্ছি তো তোমার কী হয়েছে? আমার গাঁটের পয়সা। তুমি তো আর পয়সা দিতে যাচ্ছ না।’
মাহের বলল, ‘আরে রাগ করছ কেন? আমি এমনি ঠাট্টা করলুম।’ বলে বুড়োর গায়ের ওপর হাত বুলিয়ে দিল সে। তারপর নিজের জন্য এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল।
চায়ের পেয়ালায় প্রথম চুমুক দিয়েই গলাটা খাঁকরে নিল মাহের আলী। তারপর বুড়োর দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে বলল, ‘দেখো বুড়ো, আজ–কাল করে অনেক ঘুরিয়েছ আমায়। আর আমি মোটেই দেরি করতে রাজি নই। কী আশ্চর্য, আমার সাথের ইয়ার–দোস্তরা সব বিয়েশাদি করে ছেলের বাপ হয়ে গেল, আর আমি এখনো বউয়ের মুখ পর্যন্ত দেখতে পেলাম না।’ বলে পকেট থেকে দুটো বিড়ি বের করে একটা বুড়োর দিকে এগিয়ে দিয়ে আর একটা নিজে ধরাল সে। ‘দেখো, আমি এ হপ্তা শেষ হবার আগেই বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি। এর কিন্তু এক চুলও নড়চড় হবে না। তুমি চটপট আমায় একটা মেয়ে খুঁজে দাও।’
‘তুমি আর জ্বালিয়ো না আমায়, বুঝলে?’ বুড়ো শুয়োরের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল, ‘এক বছর ধরে তোমায় আমি সাত-সাতটা মেয়ের খোঁজ এনে দিয়েছি। দিয়েছি কি না, বলো না?’
‘হ্যাঁ, তা তো দিয়েছ। তা কি আমি অস্বীকার করছি নাকি?’
‘ব্যস, এবার আমায় বলো। এই যে সাত-সাতটে মেয়ে আনলাম, একটাও মনের মতো হলো না তোমার। একটা না একটা খুঁত বের করলেই তুমি। এখন তোমার জন্যে কি বেহেশত থেকে হুর-পরি নিয়ে আসব আমি?’
‘আহা, আমি কি বলছি যে তুমি বেহেশত থেকে হুরপরি নিয়ে আসো? তবে হ্যাঁ, বউ আমার মনের মতো হতে হবে। যেমনটি তোমায় বলেছি, ঠিক তেমনটি।’
‘হ্যাঁ। ও রকম একটা আমি নিজ হাতে তৈরি করে নেব আরকি?’ বুড়ো আবার ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল।
তাকে শান্ত করার জন্য মাহের বলল, ‘রাগ করো কেন বুড়ো? আজকাল কী যে স্বভাব হয়েছে তোমার! কথায় কথায় রেগে যাও। নাও, আর একটা বিড়ি খাও। চা খাবে নাকি? না কেন। খাও-খাও।’ আরও দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিল মাহের আলী। তারপর বুড়োর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, ‘আচ্ছা তুমিই বলো, দুনিয়াতে এসেছি, একটা ভালো ঘরে আসতে পারিনি। একটা ভালো চাকরি পাইনি। চেহারাটাও কত কুৎসিত। একটু ভালো খাব, ভালো করে থাকব, সে সম্বলও নেই। ধন বলো, টাকাপয়সা বলো, সে তো ঠনঠন। এ অবস্থায় যদি একটা মনের মতো বউও না পাই, তবে কী নিয়ে বেঁচে থাকব এ পৃথিবীতে?’
‘হ্যাঁ ভাই, তা তো সাচ কথাই বলেছ।’ বুড়োর কথায় দরদ ঝরে পড়ল এতক্ষণে। একটু কেশে নিয়ে বুড়ো বলল, ‘দেখো, মেয়ে একটা আমার খোঁজে এখন আছে। যেমনটি তুমি চাও, প্রায় ঠিক তেমনটিই বলা চলে। যদি তুমি দেখতে চাও, দেখাতেও পারি। তবে হ্যাঁ, বিয়ে যদি ঠিক হয়, তাইলে এক কুড়ি টাকা দিতে হবে আমায়। এ থেকে এক পয়সাও কম দিলে চলবে না। বোঝো তো বাপু, এই করেই খাই আমি, এটাই আমায় পেশা।’
‘তার জন্যে তুমি ঘাবড়িয়ো না বুড়ো। বউ যদি আমার মনের মতো হয়, তাইলে টাকা দিতে কিপটেমি করব না আমি, আমার এক কথা।’
শুনে খুব খুশি হলো বুড়ো, খুদে চোখ দুটো দিয়ে পিটপিট করে তাকাল তার দিকে। তারপর বলল, ‘তাহলে আর দেরি কেন, এখনই চলো না, দেখে আসবে মেয়েটাকে। বেশি দূর তো নয়, রিকশায় গেলে ১৫ মিনিটের রাস্তা। তা ছাড়া আজ রোববার, খান সাহেবকেও বাসায় পাওয়া যাবে।’
‘খান সাহেব? তিনি আবার কিনি?’
‘কিনি মানে? তাঁর বাসাতেই তো কাজ করে মেয়েটা।’
‘বলো কী, মেয়েটা বাসার চাকরানি নাকি?’ মাহের আলী মুষড়ে পড়ল।
বুড়ো বলল, ‘তুমি আস্ত একটা গাধা। ওসব বাড়িতে যারা কাজ করে, তাদের চাকরানি বলে না। বলে আয়া। কাজকর্ম কিছু নেই, শুধু সাহেবের কাচ্চাবাচ্চাগুলোকে ঠেলাগাড়ি নাকি বলে ওতে চড়িয়ে চড়িয়ে বেড়ানো। আয় মাসের শেষে গুনে গুনে বিশটা টাকা বেতন। আর যেসব কাপড়চোপড় পরে ঘুরে বেড়ায় না, ওসব কাপড়চোপড় তোমার ওই কেরানি বাবুদের মেয়েরাও পরতে পারে না। বুঝলে?’
বুড়োর কথায় মনটা আনন্দে ভরে উঠল মাহের আলীর। বুকপকেট থেকে একটা চিরুনি বের করে পরিপাটি করে চুলগুলো আঁচড়ে নিল সে। ‘তাহলে চলো, এখনই যাওয়া যাক।’ তারপর পোশাকটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘কাপড়চোপড়গুলো কেমন ময়লা হয়ে গেছে না। বদলে নেব নাকি?’
‘আরে থাক থাক, ওতেই চলবে।’ বুড়ো মুখ বিকৃত করল।
ধূলিঝড় তখন থেমে গেছে। মেঘগুলো সব সরে গিয়ে আকাশে দু-একটা তারা চিকচিক করছে। প্রকৃতি হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিল, এখন শাস্ত। একেবারে শান্ত।
রিকশায় চড়ে কিন্তু বুড়ো নতুন কথা পাড়ল। বলল, ‘তোমার মায়ের মত নিয়েছ তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ মত না নিয়ে কি তোমার কাছে এসছি নাকি।’ মাহের আলীর কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ল।
বুড়ো বলল, ‘দেখো বাপু পরে আমায় ফ্যাসাদে ফেলো না। কাল সকালে তোমার মা এসে কাঁদাকাটি করছিল আমার কাছে। বলছিল, তুমি যা আয় করো, তা দিয়ে ভালো করে সংসার চলে না। তার ওপর বিয়ে করে সংসারে আর একটা পেট বাড়িয়ে চালাবে কী করে? তা ছাড়া তোমার ছোট বোন সখিনাটাও তো বিয়ের লায়েক হয়ে পড়ে আছে। তাকে বিয়ে না দিয়ে তুমি করা... মানে এসব বলছিল আর কি।’
হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল মাহের আলী। কপালের শিরাগুলো ফুলে ফুলে উঠল। মুখটা কালো জামের মতো মিশকালো হয়ে গেল তার। নিচের ঠোঁটটাকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইল সে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘হুঁ, তাইলে সত্যি সত্যিই সে পিছু লেগেছে আমার।’
বুড়ো বলল, ‘কী বললে?’
মাহের আলী রেগে উঠল, ‘কিছু না।’
খান সাহেবের বাড়িটা দেখে খুশিই হলো মাহের আলী। তার চেয়ে আরও খুশি হলো যখন বুড়ো হাত বাড়িয়ে দেখাল। ‘ওই-ওই দেখো মিয়া। যার কথা বলছিলাম। ওই তো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।’
মাহের তাকিয়ে দেখল, একটা ফুটফুটে বেবিকে কোলে নিয়ে নিয়ন বাতির আলোতে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। গায়ের রং তার কালো হলে কী হবে, দেহের বাঁধুনি তার সত্যিই সুন্দর। সরু পাড়ের একখানা শাদা শাড়ি আর ব্লাউজ, মজবুত দেহটাকে সাপটে জড়িয়ে আছে।
ওরা এগিয়ে আসতেই মেয়েটা ফিরে তাকাল সেদিকে। চোখে চোখ পড়ল। ভ্রুজোড়া স্বল্প বাঁকাল সে।
বুড়ো বলল, ‘কী নাতনি, কেমন আছ? ভালো তো?’
মেয়েটা অপূর্ব অঙ্গভঙ্গি করে বলল, ‘ভালো’ বলে অকারণ একটুকরো হাসি ছড়াল সে। বেগুনি ঠোঁট দুটোর ফাঁকে দুপাটি ঝকঝকে দাঁত হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল।
বুড়ো জিজ্ঞেস করল, ‘সাহেব কোথায়?’
বুকের কাপড়টা একটু খসে পড়ে ছিল। সেট আবার সযত্নে তুলে দিয়ে আয়া জবাব দিল, ‘সাহেব? একটু আগেই তো এলেন বাইরে থেকে। আছেন ভেতরে।’
খবর দেবার অনেকক্ষণ—অনেকক্ষণ পরে সাক্ষাৎ মিলল খান সাহেবের। মেমসাহেবও বেরিয়ে এলেন তাঁর সঙ্গে। স্টিমারের ডেকের মতো করে তৈরি করা বারান্দাটায় দুটো ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন তাঁরা। পাগড়ি পরা একটা বয় দুটো ছোট টুল এনে বসতে দিল মাহের আলী আর বুড়োকে।
বুড়ো অতি বিনয়ের সাথে প্রথমে দু–চারটা কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করল, তারপর পাড়ল আসল কথা। তাঁদের আয়ার জন্য একটা ভালো পাত্র জোগাড় করে দিতে বলেছিলেন মেমসাহেব। সে সবকিছু বিচার-বিবেচনা করেই একজন পাত্র নিয়ে এসেছে সাথে করে। আলাপ-আলোচনা করে, দেনাপাওনা নিয়ে যদি উভয় তরফের মিল হয়, তাইলে এ-বিয়ে স্বচ্ছন্দে হতে পারে। তার দিক থেকে কিছু বলতে গেলে বলতে হয়, এমন খাসা বর আজকালকার বাজারে পাওয়া বড় কঠিন।
এ তরফ থেকে মাহের আলী যেমন একটু আধটু ‘হু-হা’ ছাড়া আর কিছুই বলল না, তেমনি আবার অপর তরফ থেকে খান সাহেবও কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না। মেমসাহেবই সওয়াল-জওয়াব করে বললেন, ‘দেখো, আজ পাঁচ বছর ধরেই মেয়েটা আমার কাছে আছে। ওর বুড়ো বাবা ওর সমস্ত দায়িত্ব আমার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছে। বয়স হয়ে গেছে মেয়েটার। তাই ভাবছিলাম, একটা বিয়েশাদি দিয়ে দিই। তা পাত্র যা দেখছি, তাতে অপছন্দের কিছুই নেই। তবে কিনা এটা কথা আছে।’
‘বলুন—বলুন। স্বচ্ছন্দে বলুন।’ বুড়ো নড়েচড়ে বসল একটু।
মেমসাহেব বললেন, ‘কথাটা হচ্ছে, মেয়েটা এখন মাস–মাস বিশ টাকা করে বেতন পায় আমার কাছ থেকে। টাকাটা আমরা ওর বুড়ো বাপকেই দিই। বিয়ের পরেও যত দিন ওর বাবা বেঁচে থাকবে, তত দিন তাঁকেই দেব আমরা টাকাগুলো, মরে গেলে পরে...।’ বলে একটা হাই তুললেন তিনি। ‘আর হ্যাঁ, বিয়ের পরও মেয়ে আমাদের বাসাতেই থাকবে। তবে, মাঝে মাঝে দু–চার দিন স্বামীর বাড়ি গিয়ে বেড়িয়ে আসবে বৈকি। বলো, এ শর্তে রাজি আছ তোমরা?’ মেমসাহেব ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালেন মাহের আলীর দিকে।
মাহের আলী প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়ে বুড়োর দিকে তাকাল। তারপর তাকাল রেলিংয়ের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে। রংটা কালো হলে কী হবে, চেহারাটা যেন খুঁদে খুঁদে তৈরি করা হয়েছে তার। নাক, চোখ, মুখে অপূর্ব কমনীয়তা, স্নিগ্ধ চাহনি। মাহের আলী চোখ ফেরাল। তারপর একটু ভেবে বুড়োর কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘রাজি।’
কিন্তু রাজি হলেই তো আর হলো না।
কথা পাকাপোক্ত হতে বেশ সময় নিল ওরা।
গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে মনটা আবার কেমন খুঁতখুঁত করে উঠল মাহের আলীর। মেয়েটা কালো না হয়ে যদি ফরসা হতো তাহলেই ভালো হতো। আর তা না হয়ে অন্তত যদি শ্যামলা হতো, তবু চলত, কিন্তু... থাকগে, যা আছে তা–ই ভালো।’ আপন মনে বিড়বিড় করে উঠল মাহের আলী।
বুড়োকে বিদায় করে যখন বাসায় ফিরে এল, তখন বেশ রাত হয়েছে। মা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ছিল, পাশেই পিদিমের আলোতে বসে বসে পরনের কাপড়টা সেলাই করছিল সখিনা। ও ভেতরে ঢুকতে উভয়েই ওর দিকে ফিরে তাকাল একপলক। এতক্ষণ কী যেন আলাপ করছিল ওরা, ওকে দেখেই থেমে গেল। মাহের আলীও কিছু বলল না। দাওয়ায় বিছানো খাটিয়াটার ওপর চুপচাপ এসে বসল সে।
বাতাসটা হঠাৎ একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেমন একটা ভ্যাপসা গরম লাগছিল। তার ওপর কেউ কোনো কথা না বলায় পরিবেশটাও কেমন গুমোট মনে হচ্ছিল ওর। কাপড়টা ছেড়ে কিছুক্ষণ খাটিয়ার ওপর চুপচাপ শুয়ে রইল সে। বার কয়েক এপাশ–ওপাশ গড়াগড়ি দিল। তারপর উঠে বসে ওদের শুনিয়ে শুনিয়েই বলল, ‘উ!’ এমন গরম পড়ছে। অথচ একটা কেউ নেই যে একটু পাখা করে। যাক, কষ্ট আর কদিন। বিয়েটা তো ঠিক করেই এলাম। এবার শুধু বসে বসে দিন গোনা।’ বলার ফাঁকে একঝলক মা আর সখিনার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল সে। মা গম্ভীর, সখিনা সেলাই ছেড়ে দিয়ে হাতের নখ খুঁটছে। মায়ের গাম্ভীর্যে গা জ্বালা করে উঠল মাহের আলীর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘অমন মুখ ভার করাকে কি আমি ভয় করি নাকি? ইস, যেন সারাটা জীবন এমনিই থাকব আর কি আমি। মুখ ভার করলে কী হবে, সব ঠিক করে এসেছি। একেবারে পাকাপোক্ত ব্যাপার। আগামী সোমবারেই বিয়ে। ইস যেন কাউকে গ্রাহ্য করি আর কি আমি।’ বলে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে আগুন ধরাল মাহের আলী।
মা হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে একনজর তাকাল ওর দিকে। তারপর অস্পষ্ট গলায় কী বলে হনহন করে ঘরের ভেতর চলে গেল।
সখিনা সেলাই থেকে মুখ তুলে একবার মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে আর একবার ভাইয়ের দিকে তাকাল, তারপর ভর্ৎসনা করে বলল, ‘ছিঃ ভাইয়া, মাকে কষ্ট দিতে তোমার একটুও বাধে না?’
‘তুই চুপ কর। তোকে কে পটরপটর করতে বলছে।’ মাহের আলী রেগে উঠল।
ধমক খেয়ে চুপ করে গেল সখিনা।
রাতে ভালো ঘুম হলো না মাহের আলীর। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবী বধূর কথাই হয়তো বারবার করে ভাবল সে।
পরদিন দুপুরে ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরবার পথে বুড়োর সাথে দেখা হয়ে গেল মাহের আলীর। দেখা হতেই বুড়ো বলল, ‘এই যে, তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। পথে দেখা হয়ে গিয়ে ভালোই হলো।’
‘কেন, কী ব্যাপার?’ মাহের আলীর কণ্ঠে উত্কণ্ঠা।
বুড়ো কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বিমর্ষ গলায় বলল, ‘তোমার কপালটাই খারাপ! বিয়েটা বোধ হয় হলো না ওখানে।’
‘কেন কেন?’ মাহের আলীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। গলাটা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেল। বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। বুড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘অমত তো কারোরই ছিল না, কিন্তু ...।
‘কিন্তু—কী?’ বুড়োর দুই কাঁধে হাত রেখে একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিল মাহের আলী।
বুড়ো বলল, ‘যাকে বিয়ে করতে চাও, সে–ই তো বেঁকে বসেছে এখন।’
‘তার মানে?’
‘মানে আবার কী?’ বুড়ো খেঁকিয়ে উঠল, ‘তোমার একটা পছন্দ-অপছন্দ আছে মিয়া। মেয়েটার কি তা নেই? মেয়েটা বলেছে...।’
‘কী বলছে?’ মাহের আলীর প্রায় কাঁদবার উপক্রম হলো।
বুড়ো বলল, ‘বলছে, মনের মতো বর না পেলে ঘর করে কোনো আরাম আছে নাকি। ও মিনসের মুখ দেখলেই গা আমার ঘিনঘিন করে ওঠে। ওর কাছে আবার বিয়ে বসব কী!’
সংগ্রহ ও ভূমিকা: কাজী জাহিদুল হক
কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হলেও প্রথম জীবনে লেখালেখির মধ্য দিয়েই সংস্কৃতির বৃহত্তর অঙ্গনে পা রাখেন জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২)। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি এমন কিছু গল্প–উপন্যাস রচনা করেছেন, বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে যা তাঁকে স্থায়ী আসন দিয়েছে।
এখানে পত্রস্থ হওয়া ‘মনের মতো বউ’ গল্পটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯৫৫ সালে (১৩৬২ বঙ্গাব্দ), জহুর হোসেন চৌধুরী সম্পাদিত সংবাদ–এর ঈদসংখ্যায়। পরে এ গল্পটি আর কোনো গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
জহির রায়হানের মৃত্যুর পর তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র ছোটোগল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ-এ গ্রন্থিত গল্পগুলোসহ মোট ১৯টি গল্প নিয়ে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের গল্পসমগ্র। বিভিন্ন সংকলনে এ পর্যন্ত তাঁর গ্রন্থিত গল্পের সংখ্যা ২২টি। কিন্তু এ কথাশিল্পীর অনেক গল্প এখনো অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। অগ্রন্থিত সেই সব গল্পের সমন্বয়ে আমার সম্পাদনায় প্রথমা প্রকাশন থেকে অচিরেই বের হবে জহির রায়হানের অগ্রন্থিত গল্প সংকলন যখন যন্ত্রণা।
‘মনের মতো বউ’ গল্পটি ওই সংকলনে স্থান পেয়েছে। এ গল্পে লেখক গত শতকের পঞ্চাশের দশকের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে যেমন তুলে ধরেছেন, একইভাবে নারীর স্বাধীন সত্তাকেও গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন।
গল্পটি এখানে মুদ্রণের সময় বর্তমানে প্রচলিত বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।