কেমন করে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ
আজ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণদিবস। এই দিনে জানা যাক কবির লেখালেখির প্রক্রিয়া, কেমন করে লিখতেন তিনি?
দীর্ঘ জীবনের ব্যথা-বেদনা, সাংসারিক কর্তব্য, জমিদারির তদারকি সামলে যে মানুষটা নিরলসভাবে লিখে গেলেন, তিনি কেমন করে লিখতেন, এক জীবনে এত বিস্তর লেখা তৈরির কৌশলই-বা কী ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের? তা জানলে বিস্মিত হতে হয়। মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ প্রসঙ্গে একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃত করছি। ‘কবিতা আমার বহুকালের প্রেয়সী। বোধ হয় যখন আমার রথীর মতো বয়স ছিল, তখন থেকে আমার সঙ্গে বাগ্দত্তা হয়েছিল।’ চিঠিটি কবি লিখেছিলেন মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীকে। ১৮৯৩ সালের মে মাসের ৮ তারিখ। তখন রথীন্দ্রনাথের (রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান রথীন্দ্রনাথ) বয়স সাড়ে চার বছর। বলা দরকার, রথীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৮৮ সালের ২৭ নভেম্বর।
রবীন্দ্রনাথ খাতায় লিখতে শুরু করেন সাত বছর বয়সে। তখন তিনি নর্মাল স্কুলের ছাত্র। নীল কাগজের একটি ফুলস্কেপ খাতা উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। সেই খাতাতেই পেনসিল দিয়ে পদ্য লেখেন। লিখেই পড়ে শোনান বড় দাদা সোমেন্দ্রনাথকে। সোমেন্দ্রনাথও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন। নতুন কিছু লিখলে বাড়ির সবাইকে ডেকে বলেন, রবি কবিতা লিখেছে, শুনবে এসো। তেমনই একদিন ন্যাশনাল পেপারপত্রের সম্পাদক নবগোপাল মিত্র এলেন বাড়িতে। সোমেন্দ্রনাথ তাঁকে বললেন, নবগোপাল বাবু, রবি একটা কবিতা লিখেছে, শুনুন না। কবি গলা ছেড়ে আবৃত্তি করে শোনালেন। নবগোপালবাবু হেসে বললেন, বেশ হয়েছে।
১৮৭৪ সাল। প্রথমবারের মতো বাবার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে এলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে লেখার উপকরণ হিসেবে সঙ্গে আছে কেবল একটা পেনসিল ও পুরোনো লেট্স ডায়েরি। মনে নানা রকম ভাবনা আসে। শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতেই কবির মনে হলো, গাছের ছায়ায় বসে কবিতা লিখলে অনায়াসে কবিত্ব করা যায়। ভাবনামতো গাছগাছালির ছায়ায় বসে লিখতে শুরু করলেন। ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ শিরোনামের বীররসাত্মক কবিতাটি ওই সময়ে লেখা। ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ লিখতে রবিঠাকুরের সময় লেগেছিল সাত দিন।
কবি বিলেতে যাবেন। তার আগে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তখন আহমেদাবাদের জজ। রাজকীয় প্রাসাদে থাকেন, এলাহি কারবার। প্রাসাদের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে সবরমতী নদী। নদীর জলের কলকল শব্দ আর প্রকৃতির নিরূপম মনোলোভায় কবি মন পুলকিত হয়ে উঠল। ১৭ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ চাঁদের আলোয় ছাদে বসে নিজের সুরের প্রথম গানগুলো রচনা করলেন।
‘কবি-কাহিনী’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাওয়ার কিছুদিন পর কলকাতা থেকে এটি প্রকাশিত হয়। পুরোনো লেট্স ডায়েরির পর একটি খাতায় কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। ওই খাতাটিতেই ‘কবি-কাহিনী’র খসড়া রূপটি পাওয়া যায়। খসড়ায় উল্লেখ করা তারিখ অনুযায়ী ‘কবি-কাহিনী’ লিখতে তাঁর সাত দিন সময় লেগেছিল।
‘কবি-কাহিনী’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাওয়ার কিছুদিন পর কলকাতা থেকে এটি প্রকাশিত হয়। পুরোনো লেট্স ডায়েরির পর একটি খাতায় কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। ওই খাতাটিতেই ‘কবি-কাহিনী’র খসড়া রূপটি পাওয়া যায়। খসড়ায় উল্লেখ করা তারিখ অনুযায়ী ‘কবি-কাহিনী’ লিখতে তাঁর সাত দিন সময় লেগেছিল।
যাহোক, মাঝেমধ্যে কবির মনে বিচিত্র খেয়ালের সঞ্চার হতো। তেমনই এক দিনের ঘটনা। লিখতে লিখতে মনে হলো, ফুলের রস দিয়েই তো কবিতা লেখা যায়! যে ভাবা সেই কাজ। বাগান থেকে মালি ফুল তুলে এনে দিলেন। কিন্তু ফুল চিপলে সামান্য রস বেরোল, যা কবিতা লেখার জন্য যথেষ্ট নয়। উপায় ভাবতে ভাবতে কবি ফুল চেপার জন্য কল তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। মিস্ত্রি ডাকা হলো। কবির নির্দেশনায় মিস্ত্রি কল তৈরি করলেন। কিন্তু কল দিয়ে কার্যসিদ্ধি হলো না। কলের পেষণে ফুল পিসে গেলেও কবিতা লেখার মতো যথেষ্ট রস বেরোল না। অগত্যা আশাহত হয়ে কবি কলমের আঁচড়ে সৃষ্টিতে নিমগ্ন হলেন।
কবির জীবনে শিলাইদহ পর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—এ কথা সবার জানা। এখানে কবি সৃষ্টিসুখের সন্ধান পেয়েছিলেন। শিলাইদহের আশপাশ নৌকায় ঘুরে ঘুরে তিনি যেমন ঋতুবৈচিত্র্য আর প্রকৃতির অকৃপণ উদারতা উপভোগ করেছেন, তেমনই ঘুরতে ঘুরতেই কলম ও কালির আঁচড়ে ফলিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের সোনালি ফসল। রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’ থেকে উদ্ধৃত করছি। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার ধারণা, বাবার গদ্য ও পদ্য দুই রকম লেখারই উৎস যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, এমন আর কোথাও হয়নি। এ সময় তিনি অনর্গল কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প লিখে গেছেন—এক দিনের জন্যও কলম বন্ধ হয়নি।’
একইভাবে প্রবহমান গঙ্গাও প্রভাবিত করেছিল কবিকে। কবিতাসহ বেশ কিছু গদ্য আর ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাস গঙ্গার ধারে বসেই তিনি লিখতে শুরু করেন। আর উপন্যাসটি লেখার জন্য কবি গিয়ে ওঠেন চৌরঙ্গীর কাছে ১০ নম্বর সদর স্ট্রিটে জ্যোতি দাদাদের বাড়িতে। তখন ক্রমেই ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ লেখার কাজ এগিয়ে চলেছে। এর মধ্যে একদিন প্রবল কৌতূহলে কবি আন্দোলিত হলেন। দুপুর ও বিকেলজুড়ে সৃষ্টি করলেন বাংলা সাহিত্যের অমর কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’।
কবি যে কেবল লিখেই সন্তুষ্ট হতেন, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা ও বন্ধুদের গলা খুলে নিজের লেখা পড়ে শোনানোও ছিল পছন্দের কাজ। এ ছাড়া তিনি নিজের বইয়ের প্রুফ দেখার কাজও তৃপ্তির সঙ্গে করতেন। প্রুফ দেখতে দেখতে যেমন নতুন লেখা সৃষ্টি হতো, তেমন অপছন্দ হলে লেখা বাদও দিতেন। ‘ভগ্নহৃদয়’ শিরোনামের কবিতাটির কথায় বলা যাক। কবিতাটি বিলেতে বসে লিখেছিলেন কবি। যদিও প্রথম মুদ্রণে কবিতাটি গ্রন্থভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে আর প্রকাশ করতে দেননি। এমনকি ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস পুরোনো বইগুলো পুনঃপ্রকাশের সময় কবিতাটিকে গ্রন্থভুক্ত করলে, প্রিন্ট অর্ডার দেওয়ার সময় প্রুফের পাতায় কবি লিখলেন, ‘রাবিশ; দোহাই ধর্মের এটা ছাপিয়ো না।’
প্রুফ দেখার মতো বই মুদ্রণের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কাগজ, ছাপা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবতেন। বন্ধু প্রিয়নাথকে লেখা একটি চিঠিতে তার প্রমাণ মেলে। কবি লিখেছেন, ‘তুমি পত্রপ্রাপ্তিমাত্র কাউন্ডার ব্রাদার্সদের একটা অনুরোধ করবে? ...যে রকম কাগজে ‘ক্ষণিকা’ ছাপা হয়েছে, সেই রকমের ৩৫ পাউন্ড ডিমাই সাইজ কাগজ ২ রিম তৎসহ ওই ঠিকানাতেই পাঠাতে পারবেন? দাম পেতে বিলম্ব হবে না অর্থাৎ আগামী বাংলা মাসের আরম্ভেই পাবেন। আমার গল্পাবলি ছাপতে সবসুদ্ধ বোধহয় ৭০–৭৫ রিম ২৪ পাউন্ড ও আট রিম ৩৫ পাউন্ড দরকার হবে। আশা করি, কাউন্ডার ব্রাদার্সদের কাছে পেতে কোনো ব্যাঘাত হবে না।’
সাহিত্যজীবনের অনেকটা সময় রবীন্দ্রনাথ সুর ও সংগীতে আচ্ছন্ন হয়ে কাটিয়েছেন। অবলীলায় সুরে সুরে রচনা করেছেন অজস্র গান। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথও স্নানের সময় গুন গুন করে গাইতে পছন্দ করতেন। কেবল পছন্দ করতেন বললে ভুল বলা হবে। স্নানের সময় মুখে মুখে গাইতে গাইতে রচনাও করেছেন। ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে’ বিখ্যাত গানটি স্নানের সময় গুন গুন করতে করতে অনেক দিন ধরে একটু একটু করে তিনি তৈরি করেছিলেন।
তাঁর দিন শুরু হতো ভোর চারটা থেকে। কিন্তু টেবিলে বসেই লিখতে শুরু করতেন না। আধঘণ্টা বা তারও বেশি সময় চুপ করে বসে ভাবতেন। তারপর লিখতে শুরু করতেন। এই চর্চা কেবল শান্তিনিকেতনেই নয়, সমগ্র সাহিত্যজীবনেই কবি পালন করে গেছেন। আরও কিছু বিষয় মেনে চলতেন তিনি। দীর্ঘদিন এক জায়গায় বসে লিখতে অস্বস্তি হওয়ায় বাড়ির ভেতরেই কখনো ঘর বদল করতেন, তো কখনো ঘরের আসবাবের স্থান বদল করে নিতেন। একইভাবে এক খাতা ও কলমেও দীর্ঘদিন লিখতেন না তিনি। সময়ে সময়ে খাতা, কলম, পেনসিল পাল্টে নিতেন।
কোনো লেখা শেষ করার পর রবীন্দ্রনাথ কেমন বোধ করতেন? এর উত্তর নিজেই দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘যতক্ষণ একটা লেখা চলতে থাকে ততক্ষণ মনটা বেশ শান্তিতে থাকে,Ñসেটা শেষ হয়ে যাবামাত্রই আবার একটা নতুন বিষয়ের অন্বেষণে নিতান্ত দিশেহারার মত, লক্ষ্মীছাড়ার মত, চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে হয়।’
আবারও শান্তিনিকেতনে ফিরি। কবির পরিণত বয়সের বেশির ভাগ সময় শান্তিনিকেতনেই অতিবাহিত হয়েছে। তিনি এখানে ছোট একটা ঘরে বসে লিখতেন। লেখালেখির জন্য ছোট ঘর বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, ছোট ঘরে লিখে আমি আরাম পাই, ওতে মন ছড়িয়ে না থেকে বেশ সংহত হয়ে জমাট বেঁধে থাকে। ভাবতে অবাক লাগে, প্রহরের পর প্রহর একনাগাড়ে লিখে গেছেন তিনি। কোনো কোনো দিন খাওয়ার বিরতিটুকুও নেননি। তাঁর দিন শুরু হতো ভোর চারটা থেকে। কিন্তু টেবিলে বসেই লিখতে শুরু করতেন না। আধঘণ্টা বা তারও বেশি সময় চুপ করে বসে ভাবতেন। তারপর লিখতে শুরু করতেন। এই চর্চা কেবল শান্তিনিকেতনেই নয়, সমগ্র সাহিত্যজীবনেই কবি পালন করে গেছেন। আরও কিছু বিষয় মেনে চলতেন তিনি। দীর্ঘদিন এক জায়গায় বসে লিখতে অস্বস্তি হওয়ায় বাড়ির ভেতরেই কখনো ঘর বদল করতেন তো কখনো ঘরের আসবাবের স্থান বদল করে নিতেন। একইভাবে এক খাতা ও কলমেও দীর্ঘদিন লিখতেন না তিনি। সময়ে সময়ে খাতা, কলম, পেনসিল পাল্টে নিতেন।
তা ছাড়া আবহাওয়া, ঋতু পরিবর্তন ইত্যাদি কবির সাহিত্য সাধনায় কখনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। বাইরে প্রচণ্ড রোদ, দাবদাহ, বৃষ্টি—লেখার সময় কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ করতেন না তিনি। একমনে লিখছেন তো লিখছেন। এ প্রসঙ্গে কবি নিজেই বলেছেন, ‘আমি জানি কাব্য, গান প্রভৃতি রচনা সম্বন্ধে বসন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতু আমার পক্ষে অনুকূল। শীতের সময়ে অন্য কাজে উৎসাহ হয় গদ্য, প্রবন্ধ লেখা, বক্তৃতা দেওয়া আমার পক্ষে সহজ হয়।’ তেমনিভাবে লেখার সময় তাঁর কাছে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। লেখার সময় কেউ আসলে তাঁর সঙ্গে গল্প করে, পুনরায় কবি লিখতে শুরু করতেন। এই সবকিছু মিলিয়েই আমাদের রবীন্দ্রনাথ এভাবেই লিখতেন।