রফিক আজাদের কবিতাবিশ্ব

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী কবি ও গীতিকার বব ডিলানের একটি গান ষাটের দশকে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। গানটির কয়েকটি লাইনের অনুবাদ এমন, ‘কেমন লাগে বল/ কেমন লাগে/ নিজেই নিজের হতে/ বাড়ির ঠিকানা নেই/ সবার অচেনা/ কিংবা পথের পাথর।’
ফরাসি সাহিত্যিক ও অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের একটা কথার অনুরণন যেন শোনা যায় এই গানে। সার্ত্রে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। যার কারণে মানুষ আজ নিঃসঙ্গ। কেননা তাঁর নিজের ভেতরে বা অন্য কোথাও এমন কিছু নেই, যাকে সে আঁকড়ে ধরতে পারে।’
কোথাও যখন কিছুই নেই, মানুষ তো তখন নিজেই নিজেরই নিয়ন্তা। রাষ্ট্র, সমাজ, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য সবই ঠুনকো তখন তার কাছে। যার ফলে গোটা পৃথিবীর বিপরীতেই দাঁড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। ষাটের দশকে পৃথিবীজুড়ে তরুণদের মাঝে অনেকটা এমন অনুভূতি কাজ করছিল। যার ফলশ্রুতিতে জন্ম নিয়েছিল প্রতিসংস্কৃতি বা কাউন্টার কালচারের। এই দশকের কবি রফিক আজাদ সেই প্রতিসংস্কৃতিরই প্রতিনিধি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
সাধারণ পাঠকের কাছে তিনি ‘ভাত দে হারামজাদা’ কিংবা ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’র কবি। এমন জনপ্রিয় দু-চারটি কবিতার বাইরে রফিক আজাদ তেমন পঠিত নন। অনেকে স্লোগানসর্বস্ব বলে অভিধা দেন। কিন্তু ষাট আর সত্তরের উত্তাল সময়প্রবাহকে হৃদয় দিয়ে বুঝতে হলে নিজের রুচিকে এক পাশে সরিয়েই পড়তে হবে তাঁর কবিতা। চলতেই হবে তাঁর অসম্ভবের পায়ে পায়ে।
১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে স্বপ্নভঙ্গ হয় তাঁর। আবিষ্কার করেছিলেন নিরাশার এক শহর, দুঃখ ভারাক্রান্ত পৃথিবী। নিজেকে তাই দুঃখী প্রজন্মের কবি বলে ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমরা সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মধ্বংসী, মৃত্যুপরায়ণ, বিষণ্ন। আমাদের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু সিগারেট...’
এ যেন রাবীন্দ্রিক আশাবাদ সরিয়ে এক নেতির পৃথিবীর উন্মোচন। যে পৃথিবীতে সৃষ্টি হবে নতুন কবিতা। ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের’ মতো অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীর রূপ-মাধুর্য আবিষ্কারের সুযোগ কই এখানে। বরং ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের পাপের জগৎ যেন অনেক বেশি কাছের। তাঁর সমসাময়িক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক ও সিকদার আমিনুল হকের কবিতায়ও এই উপলব্ধির অনুরণন আছে। এঁদের কিছু আগে লিখতে শুরু করলেও শহীদ কাদরী ও শামসুর রাহমানের নন্দনের জগৎও পূর্বসূরিদের চেয়ে ধীরে ধীরে আলাদা হতে থাকল। তাঁরাও নতুন করে সবকিছু শুরুর ঘোষণাই দিলেন।
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত রফিক আজাদের প্রথম কবিতার বই অসম্ভবের পায়ের ‘চোর’ কবিতাটির কয়েকটি লাইন এমন, ‘এইতো সময় হলো, এসো তুমি বেরিয়ে এবার—/ হে ব্যাঘ্র, বিবর থেকে উজ্জ্বল ভাঁটার মতো, চোখে/ বস্ত্রের বাহুল্যহীন গ্রিজ-মাখা দেহে,/ শাবল-গাঁইতি হাতে বিড়ালের মতো মৃদু-পায়ে/ সন্তর্পণে, এক্ষণি বেরিয়ে পড়ো: এইতো সময়।/ হে শিল্পীর জ্যেষ্ঠ সহোদর, মধ্যরাত্রির সন্তান,/ যখন ঘুমোয় ওরা, মধ্যরাতে-তোমার সাহসী/ অভিযান শুরু: শাবল-গাঁইতি দিয়ে উপড়ে ফ্যালো/গৃহস্তের ঘরের দেয়াল-সিঁধ কেটে; সুকৌশলে/ তোমার অভ্যস্ত হাতে দুমড়ে ফেলজানালার শিক/ ঢুকে পড়ো অবহেলে, ক্ষীণলোকে, যে কোনো বাড়িতে—’।
এ যেন এলিয়ে পড়ে, কাঙাল হয়ে নয়, গাঁইতি দিয়ে আঘাত করে সব ভেঙে মানুষের জীবন দেখার আহ্বান। একই সঙ্গে সব বাধা উপড়ে ফেলে, সব সংস্কার ও মূল্যবোধ পায়ে দলে এই নব-নান্দনিক অভিযানে শামিল হওয়ার ডাক দিচ্ছেন তিনি।
ষাটের দশকে রফিক আজাদ এমন এক স্রোতের ভেতরেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন। বস্তুত বব ডিলানের গানের বাণীর মতো ঠিকানাহীন হয়ে উঠেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন নিজেরই চালক। নিজেকে ভীষণভাবেই প্রেম ও যৌনতার নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন। এবং সরল দ্বিধাহীন সে যাত্রার অনুপুঙ্খ বিবরণও উঠে এসেছিল তাঁর কবিতায়, যা ষাটের দশকের প্রতিসংস্কৃতিরই চিহ্ন।
‘হরিচরণের কাছে, আপাতত, কোনো ঋণ নেই:/ যতদিন পৃথিবীতে তোমরা রয়েছ, ততদিন/ প্রয়োজন নেই কোনো ব্যাকরণ কিংবা অভিধানে;/ সত্যি কথা বলতে গেলে, এমনকি, দরকার নেই/ কোনো ফুলে। কেননা, নারীর নগ্ন শরীরের মতো/ ঘ্রাণময়ফুল আমি এ জীবনে কখনো শুঁকি নি।/ যে সৌগন্ধ্য রয়েছে নারীর, সে রকম গন্ধবহ/ ফুলের সাক্ষাৎ আমি এখনো পাই নি কোনো ফুলে।’ ‘নারী: আমার অভিধান’ (চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, ১৯৭৭)
রফিক আজাদ শান্তি ও সাম্যের কথা বলেছেন। পাশাপাশি প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। যেমন দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর সমসাময়িক পৃথিবীর অন্য কবিরাও। অসম্ভবের পায়ে থেকে বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে পর্যন্ত ১৬টি কাব্যগ্রন্থে এর নজির আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
‘এটম বোমার থেকে দু’বছর বড় এই—আমি/ ধ্বংস ও শান্তির মধ্যে মেরু-দূর প্রভেদ মানি না।/ ক্ষীয়মাণ মূল্যবোধ, সভ্যতার সমূহ সংকটে/ আমি কি উদ্বিগ্ন খুব?-উদ্বিগ্নতা আমাকে সাজে কি?/ রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনীতি, নেতা, নানাবিধ আইনকানুন/ নিয়ন্ত্রিত করে যাচ্ছে যথারীতি প্রকাশ্য জীবন/ ভিতর-মহল জেঁকে বসে আছে লাল বর্ণমালা।-‘অন্তরঙ্গে সবুজ সংসার’(সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে, ১৯৭৪)।
রাষ্ট্র ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করাই ছিল ষাটের দশকের প্রধান লক্ষণ। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন, সাদা-কালো বিভেদ, পুঁজিবাদী বিশ্বের অসাম্য, পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত আগ্রাসন এমন মনোভাবের জন্ম দিয়েছিল তরুণ প্রজন্মের মাঝে। তখনো বিশ্বায়নের হাওয়া না লাগলেও বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছিল। তবে সেটা ঘটেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। প্রধানত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে।
চেকস্লোভাকিয়ার একটা ঘটনার কথা জানা আছে। কমিউনিস্ট শাসিত দেশটিতে ষাটের দশকে এক অদ্ভুত আইন পাস হয়েছিল। তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার বিধান জারি করেছিল এই মর্মে, লম্বা চুলের কোনো তরুণ পানশালা, সিনেমা হল এমনকি গণপরিবহনে চড়তে পারবে না। এখানেই শেষ নয়, ১৯৬৬ সালের এক দিনে জোর করে চার হাজার তরুণের চুল কেটে দেয় সেই দেশের পুলিশ বাহিনী। সরকারি গণমাধ্যমগুলো ‘ভ্যাগাবন্ড’ নাম দেগে দিয়েছিল এদের গায়ে। কিন্তু এই তরুণেরাই ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছিল।
এই ঘটনার সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু শহীদ কাদরীর ‘সেলুনে যাওয়ার আগে’ কবিতাটি ঠিক মনে পড়বে পাঠকের, ‘আমার ক্ষুধার্ত চুল বাতাসে লাফাচ্ছে অবিরাম/ শায়েস্তা হয় না সে সহজে, বহুবার/ বহুবার আমি তাকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম/ পাড়াতে চেয়েছি। “বর্গীরা আসছে তেড়ে,/ঘুমাও ঘুমাও বাছা!” কিছুতেই কিছু হয় না যে তার/ অনিদ্র সে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন সাঁওতাল সর্দার এক...’
লম্বা চুল তো কেবলমাত্র একটা পোশাকি প্রকাশ। ভেতরে অন্য কিছু। গলিত ইস্পাত কিংবা আগুন। আসলে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিল্প-সংস্কৃতি, সমাজ, জীবনাচরণ, শিক্ষা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর তরুণসমাজ।
একটিমাত্র পঙ্ক্তির কবিতায় রফিক আজাদের সহজ উচ্চারণ, ‘ঈশ্বর হলেন অগ্নি, যিনি এ হৃদয়ে থাকেন।’(‘ঈশ্বর’, সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে, ১৯৭৪)।
তাঁর কবিতায় প্রগলভতা আছে। আছে অতিকথন। রাগ-ক্ষোভ উগরে দেওয়ার বিষয়েও রাখঢাক রাখেননি, ‘আজ রাতে সে তার চুলের গুচ্ছ/ ছড়িয়েছে ঐ লোকটার/ বিছানো বালিশে;/ ব্যাটাচ্ছেলে ওকে কালো-টাকায় কিনেছে!/ একদিন ঐ মালাকে আমি দেখে নেব। ঐ শুয়োরের বাচ্চাকে আমি ঠিক দেখে নেব।/আজ থেকে মালপানি জিন্দাবাদ,/ আজ থেকে আর ভালোমানুষ থাকব না;/ আমি শালা সব কাজ ছেড়েছুড়ে টাকাই কামাবো,/ দিলটা পাথর করে দিনরাত শুধু মালপানিই কামাবো,/ ঐ শুয়োরের বাচ্চাকে একদিন/ দেখে নেব, ঠিক দেখে নেব।’(‘মালপানি জিন্দাবাদ’, সশস্ত্র সুন্দর, ১৯৮২)
তবে এই রাগ কেবল বহিরাঙ্গের। ভেতরে কিন্তু শান্ত সমাহিত জলধারা প্রবহমান। কারণ, রফিক আজাদের আরেকটা নাম তো জীবন। সেই কারণেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো জীবনের রূপ-গন্ধ খুঁজতেন তিনিও। খুঁজতেন মধুপুরের চুনিয়ায় আর গারো পাহাড়ে। তবে চুনিয়া বা বিরিশিরি নিয়ে নিজের একান্ত আবিষ্কার সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন তিনি। চেনা জগৎকে শক্তি যেমন দূরবর্তী করে তুলছেন তা তিনি করেননি। চুনিয়া নিয়ে তাঁর সরল বিবরণেই হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠে, ‘স্পর্শকাতরতাময় এই নাম/ উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,/ অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,/ চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে/ খুব শক্তিশালী/ মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।’(চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, ১৯৭৭)
নিজের কিছু কিছু কবিতাকে তিনি বলতেন পদ্য-প্রবন্ধ। কোনো বিষয়কে আশ্রয় করে লেখা বলেই হয়তো এমন অভিধা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবিতাই লিখেছেন রফিক আজাদ। সব কবিতা নয়, তাঁর কিছু কিছু কবিতায় এমন উপাদান থাকে যা, পাঠকের অভিজ্ঞতাকে অন্য স্তরে নিয়ে যায়। অর্থাৎ যা মুহূর্তেই বিহ্বল করে। গ্রাস করে নেয়। এমন একটি কবিতা দিয়ে শেষ করা যাক, কারণ এর পরে আর কিছুই বলার থাকে না, ‘দেখি:/ মধ্যরাতে/ জ্যোত্স্নায় জ্বলছে ক’টি ঘোড়া,/ তাদের শরীর থেকে ঝরছে বিদ্যুৎ-/ গর্বিত গ্রীবায় নয় সারা দেহে ঝরে স্নিগ্ধ নান্দনিক দ্যুতি!/ মধু ও সেগুনকাঠে/ তৈরি হ’লে যা দাঁড়াতো/ চোখ জুড়ে/ তেমন গায়ের রঙ-পেলব, মসৃণ!/ পা ঠুকছে ঘোড়াগুলি/ চৈত্রেফাটা শস্যহীন মাঠে-অনিন্দ্য, সুন্দর!’
‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’, খুব বেশি দূরে নয়, ১৯৮৯