ঢাকায় সত্যজিৎ রায়
ঢাকার ডায়েরি
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের একটি দলের সঙ্গে ঢাকায় আসেন সত্যজিৎ রায়। কলকাতার সাময়িকী উল্টোরথ ও সিনেমা জগৎ এই সারস্বত ভ্রমণ নিয়ে দুটো প্রতিবেদন ছেপেছিল। এখানে রইল তার প্রাসঙ্গিক অংশ।
আমি আপনাদের সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আপাতত ঢাকায় আছি। এসেছি ২১ ফেব্রুয়ারি। বোয়িংয়ে কলকাতা থেকে ঢাকা ২৫ মিনিটের পথ। কিন্তু তার জন্য যে হুজ্জতি পোহাতে হয়, তাতে লন্ডন চলে যাওয়া যায়। এই ধরুন না, প্লেন প্রতিদিনই লেট। এয়ারপোর্টে বসে বসে হরিমটর জপ করতে হয়। আমাদের আসার দিন প্লেন তিন-চার ঘণ্টা লেটে ছাড়ল। আমার বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন শ্রীসত্যজিৎ রায়। এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি তিনি বসে আছেন বেলা নয়টা থেকে। প্লেন ছাড়ল সাড়ে বারোটায়। সত্যজিৎবাবুকে জিজ্ঞাসা করায় বললেন, না মশায়, আমায় তো কেউ বলেনি যে লেট হবে।
১২৫ টাকা ভাড়া। তা-ও আবার মাল ২৫ কেজির একটু বেশি হলেই নগদ অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হবে। দুটো ফরম সই করতে হবে। ১৫ টাকার স্ট্যাম্প কিনতে হবে। কাস্টমস চেকিংয়ের পর পুলিশ দেহ তল্লাশি করবে। তারপর ছাড়া পাওয়া।
প্লেনে উঠে অখাদ্য এক গেলাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ মুখে ঠেকাতে না ঠেকাতেই দেখলাম পদ্মা পার হচ্ছি। সামনের সিটে সত্যজিৎবাবু, ঋত্বিকবাবু বসে। ঋত্বিকবাবু বলছেন, মশায়, আমার বাড়ি ঢাকায়। আমি সব চিনি।
ঋত্বিক ঘটক সত্যজিৎবাবুকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করেন। ওঁদের কথা শুনছিলাম। ঋত্বিকবাবু বলছিলেন, পাবলিকের নগদ বিদায় হাততালি নিয়ে কী হবে, সত্যজিৎবাবু। এমন কিছু করুন, যা সত্যিকারের সৎ ও মহৎ।
সত্যজিৎবাবু অন্যমনস্ক হয়ে মাঝেমধ্যে কী সব ভাবছিলেন।
পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা। সত্যজিৎবাবুর জন্য ফুল নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। আমার জন্য গাড়ি নিয়ে এসেছেন এক ভদ্রলোক। এয়ারপোর্টে একটা ফরম সই করতে হলো। সঙ্গে কত টাকা এনেছি, তার ঘোষণা।
আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। শুনলাম কাল সারা রাত লোকে জেগেছে। শহীদ মিনার লোকে লোকারণ্য হয়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে শহর। লোকজন বেশি পথে নেই।
বিকেলবেলা গেলাম শেখ সাহেবের বাড়িতে। আগে যেটি ছিল প্রেসিডেন্ট হাউস, এখন সেটি শেখ সাহেবের সরকারি বাসভবন। বাংলো প্যাটার্নের একতলা বাড়ি। সুন্দর লন। বাড়িটা হলো রমনা গ্রিনে। এ জায়গাটিতে এলে অনেকটা নিউ দিল্লির মতো মনে হয়।
শেখ সাহেবের ঘরে ঢুকে দেখি সত্যজিৎ রায় বসে আছেন। আর গান গাইছেন দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্যামল মিত্র। গানের পর বেশ মজা হলো। একটি মেয়ে গান গাইল। কে একজন পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলল, শেখ সাহেব, এ হলো বাংলাদেশের মেয়ে।
শেখ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে ওরা কোথাকার?
হাসির রোল উঠল। যে বলেছিল, সে বেচারা তো লজ্জায় একেবারে চুপ।
গানের পর শেখ সাহেব চা খেতে ডাকলেন। চা খাওয়ার সময় আমি এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলাম। বললাম, আমি কিছুদিন এখানে আছি। মাঝেমধ্যে দেখা হবে।
শেখ সাহেব বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই হবে।
সন্ধ্যার পর ভাবলাম পল্টন ময়দানের সভায় যাব।
কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এসেছেন। তাঁদের নিয়ে জনসভা। পরে বিচিত্রানুষ্ঠান। কিন্তু লোকের ভিড়ে এগোতে পারলাম না। লাখখানেক লোকের ভিড় সেখানে। চলে এলাম।
উল্টোরথ, মার্চ ১৯৭২