২৪৭স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।শহীদ জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রমমৃত্যুকে নাহি ডরে বীরকয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা পিছে হটতে থাকল। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ধাওয়া করলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অমিত সাহসী দলনেতা জগৎজ্যোতি দাস সবার আগে। তিনি দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁর অনুগামী হতে পারলেন মাত্র তিনজন সহযোদ্ধা। বাকি সবাই বেশ পেছনে। ক্রমশ দূরত্ব বাড়তে থাকল। মূল দল অনেক দূরে, এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের পাল্টা আক্রমণ করল। জগৎজ্যোতি বিচলিত না হয়ে তিন সহযোদ্ধাকে নিয়ে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন। যুদ্ধ চলতে থাকল। এর মধ্যে শহীদ হলেন তাঁর তিন সহযোদ্ধা। তিনি একা হয়ে পড়লেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেও আহত হলেন। পাকিস্তানি সেনারা ধেয়ে আসছে তাঁকে জীবিত ধরতে। তাদের হাতে মৃত্যুবরণের আগেই নিজ অস্ত্রের গুলিতে নিজেই আত্মাহুতি দিলেন। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের। ১৬ নভেম্বর। বদলপুরে।হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত বদলপুর। থানা সদর থেকে উত্তর-পূর্বে এর অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকা ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত ছিল। কিন্তু এই এলাকার বেশ কিছু যুদ্ধ ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাব সেক্টর থেকে পরিচালিত হয়েছে। ১৫ নভেম্বর জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ নিয়ে টেকেরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর বানিয়াচংয়ের উদ্দেশে রওনা দেন। টেকেরঘাট সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানার অন্তর্গত। তাঁরা নৌকাযোগে আসছিলেন। ১৬ নভেম্বর সকালে তাঁরা বদলপুরে পৌঁছেন। সেখানে এসে জগৎজ্যোতি জানতে পারেন একদল রাজাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে বসে চাঁদা আদায় করছে। এ কথা শুনে তিনি তাদের আক্রমণ করেন। তাঁদের আক্রমণে দুজন রাজাকার নিহত হয় এবং দুজন আত্মসমর্পণ করে। বাকিরা পালিয়ে যায়। এমন সময় পাশের জলসুখা গ্রাম থেকে গুলি হতে থাকে। এ গ্রামেই জগৎজ্যোতির বাড়ি। তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সেদিকে রওনা হন। বাকিদের দুই ভাগে ভাগ করে একদলকে পাঠান পিটুয়াকান্দি। অপর দলকে আজমিরীগঞ্জের দিকে। এর মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি দল শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জ থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। অবস্থা প্রতিকূল দেখে জগৎজ্যোতি জলসুখা না গিয়ে পিটুয়াকান্দিতে চলে আসেন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছে হটতে থাকে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ধাওয়া করে। ধাওয়ার একপর্যায়ে জগৎজ্যোতি মাত্র তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে অনেক দূর চলে যান। মূল দল বেশ পেছনে থাকে এবং তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এমন সময় পশ্চাদপসরণরত পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের আকস্মিক আক্রমণ করে। জগৎজ্যোতি তিন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেও ব্যর্থ হন। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁর সহযোদ্ধা আবু লাল, গোপেন্দ্র ও উপেন্দ্র শহীদ হন। তাঁর বাম পাঁজরে গুলি লাগে। আহত জগৎজ্যোতিকে জীবিত ধরার জন্য পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে আসছিল। কারণ, তিনি তাদের কাছে টেরর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অনেক অপারেশন করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আহত জগৎজ্যোতি পাকিস্তানি সেনাদের কাছে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মাহুতি দেওয়া শ্রেয় মনে করেন। নিজের গুলিতে নিজেই শহীদ হন তিনি। পরে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর মরদেহ একটি বাঁশে বেঁধে জলসুখা গ্রামের রাস্তার পাশে কয়েক দিন ঝুলিয়ে রাখে।জগৎজ্যোতি দাস ১৯৭১ সালে শিক্ষকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাব সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন।মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ জগৎজ্যোতি দাসকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৫৪।শহীদ জগৎজ্যোতি দাসের পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা (ইছবপুর) গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম জিতেন্দ্র দাস। মা হরিমতি দাস। তাঁরা কেউ এখন বেঁচে নেই। জগৎজ্যোতির এক ভাই (জীবনানন্দ দাস) ও এক বোন (ফুলরানী দাস)। তাঁরা বর্তমানে ভারতে বসবাস করেন।সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।গ্রন্থনা: তারা রহমানtrrashed@gmail.com