হলুদ ক্যাবের দুর্দিনে উবার লিফটের জন্য সুখবর
নিউইয়র্ক নগরের ঐতিহ্যবাহী ইয়েলো ক্যাব ও চালকদের দুর্দিন যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। এর মধ্যেই করোনাভাইরাসের মহামারি এসে বলা যায় সব এলোমেলো করে দিয়েছে। ইয়েলো ক্যাবিদের জীবনে আশার আলোটা আরও স্তিমিত হয়ে গেছে এই মহাদুর্যোগে। একই অবস্থা উবার-লিফটসহ ভাড়ায় চালিত অন্য সব গাড়িসেবা প্ল্যাটফর্মেরও। তবে উবার-লিফটের চালকদের চাকরিজীবী হিসেবে বিবেচনার নির্দেশ দিয়ে আদালত অন্তত একটি সুখবর দিল।
করোনাভাইরাসের এই সময়ে অন্য অনেক পেশাজীবীর মতোই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়েন ক্যাব চালকেরা। করোনা মোকাবিলার কৌশল হিসেবেই লকডাউনসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে নগর ও অঙ্গরাজ্য কর্তৃপক্ষ। সিনেমা হল, রেস্তোরাঁ, সমুদ্র সৈকতসহ নানা বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। থেমে যায় পর্যটকদের কোলাহল। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপকভাবে যাত্রী সংখ্যা কমে যায়। আর এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন হলুদ ক্যাব চালকেরা।
নিউইয়র্ক নগরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এনওয়াই-১-এর প্রতিবেদনে ডরোথি লেসোন্টে নামের এমন এক ক্যাবচালকের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। লেসোন্টে নিউইয়র্ক নগরে ক্যাব চালকের কাজ করছেন ১৯৮০-এর দশক থেকে। গত মার্চ মাস থেকে তিনি ট্যাক্সি নিয়ে বের হচ্ছেন না। ধীরে ধীরে সব খুলে দেওয়া হলেও এখনো তিনি কাজে ফেরেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শুধু জ্বালানিই পুড়বে। শহরে কোনো কাজ নেই।’
লেসোন্টের এই বক্তব্য ভুল নয় কোনোভাবেই। নগরে ঘুরে বেড়ালেই দেখা মিলবে অপেক্ষমাণ হলুদ ক্যাবের লম্বা সারি। আর এর বিপরীতে থাকা যাত্রীশূন্য সড়ককে মনে হবে ভীষণ বেমানান। দীর্ঘ দিন ধরে সংকটে থাকা ক্যাব শিল্প বর্তমানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কবে কাটবে, তা নিয়েও সংশয়ে আছেন সংশ্লিষ্টরা।
কোভিড-১৯ মহামারিতে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বাজে অবস্থার শিকার হয়েছিল আমেরিকা। আর আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় নিউইয়র্ক। বিশেষত নিউইয়র্ক নগরের পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে খারাপ। গত জুন থেকে এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। জুনের শেষ নাগাদ পর্যায়ক্রমে সব খুলে দেওয়া শুরু হয়। তারপরও হলুদ ক্যাব চালকদের ভাগ্য ফেরেনি। সে সময় পর্যন্ত প্রতি চারজনের মধ্যে একজন চালক কাজে ফিরতে পেরেছিলেন। বর্তমানে এ সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি।
নিউইয়র্কের ট্যাক্সি অ্যান্ড লিমোজিন কমিশনের (টিএলসি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক নগরে সক্রিয় হলুদ ক্যাবের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৪৩৫টি। গত এপ্রিলে এ সংখ্যা নেমে ২ হাজার ১৯৩-এ এসে দাঁড়ায়। জুনে এ সংখ্যা কিছুটা বেড়ে ২ হাজার ৯৬৫-তে দাঁড়ায়।
ক্যাব শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আয় এই সময়ে অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আয় কমেছে ভয়াবহভাবে। ডরোথি লেসোন্টে নিজের মালিকানাধীন ক্যাব নিজেই চালান। তাঁর ভাষ্যমতে, আগে যেখানে তিনি দিনে ৬০০ থেকে ৭০০ ডলার আয় করতেন, মহামারির সময়ে তা কমে দিনে ৫০ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
একই রকম ভাষ্য পাওয়া গেল আরেক ক্যাবচালক মোহাম্মদ মাহবুবের কাছ থেকে। ট্যাক্সি ম্যাডালিয়নের মালিক ও চালক এই ব্যক্তি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পর্যটক নেই। এখনো বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অথচ এই ক্ষেত্রগুলোই ছিল হলুদ ক্যাব শিল্পের সবচেয়ে শক্তির জায়গা। এখন এই জনশূন্য বাস্তবতা সেই শক্তিকেই দুর্বলতায় পরিণত করেছে।’
মহামারির আগে থেকেই নিউইয়র্কের ট্যাক্সি শিল্প সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক বছর আগেও যেখানে ট্যাক্সি ম্যাডালিয়নের দাম ছিল ১০ লাখ ডলার, তা ২ লাখ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছিল। এতে বহু ট্যাক্সি মালিককে বিপদে পড়তে হয়। উবার-লিফটসহ অ্যাপভিত্তিক গাড়ি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাবের কারণে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা পড়েন বিপাকে। ঋণের জালে আটকা পড়া ক্যাব মালিক ও চালকেরা না পারছিলেন খাতটি থেকে সরে দাঁড়াতে, না পারছিলেন এ খাতের আয় দিয়ে নিজেদের সংসার চালাতে। হতাশায় বেশ কয়েকজন ট্যাক্সিচালক আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছিলেন।
সেই পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, ‘আমাদের ঋণ থেকে মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। আমরা আর কোনো আত্মহত্যা দেখতে চাই না। এই শিল্পকে রক্ষায় মেয়র ও অঙ্গরাজ্য কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন—এমন আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন সবাই।’
এই দুর্দিনে টিএলসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও, তার সবই সাময়িক। কমিশনের চেয়ারপারসন অ্যালয়সি হেরেডিয়া জার্মোসজুক অবশ্য আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘নগর কর্তৃপক্ষ অবশ্যই কোনো না কোনো সৃজনশীল উপায় খুঁজে বের করবে। হলুদ ক্যাব ছাড়া নিউইয়র্ক নগরকে কল্পনা করা অসম্ভব। আমি দায়িত্বে থাকতে অন্তত তা হতে দেব না। যদিও আমি এখনো জানি না যে, কী করব।’
শুধু হলুদ ক্যাব নয়, ভাড়ায় চালানো গাড়ির চালকদের সবাই বলতে গেলে সংকটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন। উবার ও লিফটের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত চালকেরাও নিজেদের আয় নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। উপরন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকেও চালকদের সংকট নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছিল না। এ অবস্থায় ক্যালিফোর্নিয়ার আদালত থেকে আসা আদেশ কিছুটা হলেও তাদের স্বস্তি দেবে।
ক্যালিফোর্নিয়ার কর্তৃপক্ষের করা এক মামলাকে আমলে নিয়ে সেখানকার বিচারক ১০ আগস্ট প্রাথমিক আদেশ দিয়েছেন, উবার-লিফটের চালকদের এখন থেকে চাকরিজীবী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এতে চালকদের চুক্তির অধীনে থাকা স্বাধীন সত্তা হিসেবে বিবেচনার বদলে চাকরিজীবী হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। ফলে এ খাতের সঙ্গে যুক্ত চালকেরা কিছুটা হলেও আর্থিক নিরাপত্তা পাবেন।
ক্যালিফোর্নিয়া উবার ও লিফট উভয় কোম্পানির জন্যই সবচেয়ে বড় বাজার। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্মও এই অঙ্গরাজ্যে। ফলে এখান থেকে আসা আদালতের এই আদেশ অ্যাপভিত্তিক গাড়ি সেবাদাতা প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে দেওয়া আদেশ ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে নিউইয়র্কেও এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়। কিন্তু সেসব পদক্ষেপ চালকদের স্বার্থকে খুব একটা সুরক্ষিত করতে পারেনি। এ দিক থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সেসকো আদালতের দেওয়া এই আদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আদেশটি যদিও এখনই কার্যকর হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে আপিলের জন্য ১০ দিনের সময় দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে উবার ও লিফটের মুখপাত্র ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, তারা এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবে। উবারের মুখপাত্র বলেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়ার ৩০ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। এই সময়ে কর্তৃপক্ষের উচিত কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দেওয়া। এই অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়, যা গোটা একটি শিল্পকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে।’
তবে আদালতের এই আদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বীণা দুবাল। তিনি বলেন, ‘এটি অনেক বড় পদক্ষেপ। বিদ্যমান আইনকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রাহ্য করে আসছিল। চালকদের স্বার্থে তারা কিছুই করতে রাজি ছিল না। এই আদেশ একটি আশার সঞ্চার করেছে।’