২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ফাহিমের বোনের হৃদয়স্পর্শী ভিডিও বার্তা

বোনদের সঙ্গে ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত
বোনদের সঙ্গে ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত

‘তুমি যদি কোনো ভাইয়ের বোন হয়ে থাকো, যখনই দেখা হবে জড়িয়ে ধরো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরো, যতক্ষণ পারো। আমি তা-ই চাই, যখন আমি ফাহিম সালেহর সাজিয়ে রাখা ছবিগুলো দেখি। আমি তো আর কখনো তা করতে পারব না!’

ফাহিম সালেহর বোন রুবী সালেহ এভাবেই ১৩ আগস্ট সকালে আবেগঘন এক ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছেন। হত্যাকাণ্ডের এক মাস পর প্রথমবারের মতো দেওয়া এক আবেগঘন ভিডিও বার্তায় রুবী সালেহ বলেছেন, ভাইয়ের হত্যার বিচার হওয়ার জন্য তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাবেন।

ভিডিও বার্তায় রুবী অ্যাঞ্জেলা সালেহ ভাইয়ের মৃত্যুতে তাঁদের পরিবারের ভেঙে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘জীবন আর কখনো আনন্দের হবে না।’

রুবী তাঁর আবেগঘন ভিডিও বার্তায় স্মরণ করেন হত্যাকাণ্ডের দিন গত ১৩ জুলাই ফাহিম সালেহ কেমন করে তিন মাইল দৌড়ে ম্যানহাটানের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেছিলেন। এরপরই তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হোন। রুবী সালেহ বলেন, ‘১৪ জুলাই সকাল ১০টা ৪৭ মিনিটে যখন আমার ফোন বেজে ওঠে, তখনো আমি ছিলাম বিছানায়।’

এই ফোনটি ছিল রুবি সালেহর এক আত্মীয়ের, যিনি এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। ফোনে তিনি যখন বলেন যে একটি দুঃসংবাদ আছে, তখনো রুবী সালেহর পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে ঠিক কী শুনতে যাচ্ছেন তিনি। ভেবেছিলেন, তাঁর মা-বাবা বা পরিবারের কারও হয়তো কোভিড-১৯ হয়েছে। এই ভেবেই তিনি শঙ্কিত হন। কিন্তু যখন শোনেন যে দুঃসংবাদটি তাঁর ভাই ফাহিম সালেহ–সম্পর্কিত, তখন তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। ‘ফাহিম আর আমাদের মধ্যে নেই’—এই কথাটা তাঁর কাছে কোনো অর্থই তৈরি করছিল না। রুবী সালেহর ভাষায়, ‘কী করে আমার স্বাস্থ্যবান, তারুণ্যে ভারা সৃষ্টিশীল ও সুন্দর ৩৩ বছর বয়সী ভাই আমাদের মধ্যে না থাকতে পারে?’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত

পরে বোনকে ফোন করে যখন নিশ্চিত হন ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়ে, তখন রুবী আক্ষরিক অর্থেই চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরদিনই রুবী নিউইয়র্ক নগরে আসেন। ততক্ষণে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম একজন তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার খুন হওয়ার সংবাদে সয়লাব। সেই খবরগুলো কতটা পীড়া দিচ্ছিল, তা বলতে গিয়ে রুবী বলেন, ‘তারা কথা বলছিল আমার ছোট ভাই সম্পর্কে। আমার ফাহিম, যাকে আমার মা-বাবা আমার আট বছর বয়সে থাকতে হাসপাতাল থেকে কম্বলে জড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ফাহিমের সঙ্গে আমি বেড়ে উঠেছি। একজন বোন নয়, একজন মায়ের মতো করে। তাকে আমি খাইয়েছি, তাকে গোসল করিয়েছি, তার ডায়াপার বদলে দিয়েছি।...আর আজ তিরিশ বছর পর আমার কাছে খবর এল যে ফাহিমের খণ্ডিত দেহ গার্বেজ ব্যাগে পাওয়া গেছে, যেন তার জীবনের কোনো মূল্যই নেই।’

ফাহিম সালেহর সাবেক ব্যবসায়ী পার্টনার কেমন করে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সালেহর মহানুভবতার কথা জানিয়েছেন, সে কথা রুবী ভিডিও বার্তায় উল্লেখ করেন। রুবী জানান, ঘরের ফায়ারপ্লেসের সামনে তাঁর বাবা ফাহিম সালেহর ছবি রেখে ছেলের স্মৃতি ধরে রেখেছেন। রুবী বলেন, ‘ছবিগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়া-আসার সময় মনে পড়ে ফাহিম সালেহ প্রকৃতই কে ছিল। মনে পড়ে, সে আজ আমাদের মধ্যে আর নেই!’

শৈশবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত
শৈশবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত

রুবি তাঁর ভিডিও বার্তায় বলেন, তিনি ও তাঁর পরিবার ফাহিম সালেহর হত্যার বিচার নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাজ করে যাবেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে বড় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে।’

ভিডিও বার্তা ছাড়াও রুবী সালেহ মিডিয়াম ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটে ভাইকে নিয়ে লিখেছেন। তাঁদের বাবার বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে এবং পরে সৌদি আরব থেকে আমেরিকায় স্থানান্তরের বর্ণনা দিয়েছেন।

১৩ জুলাই বেলা ১টা ৪০ মিনিটে ফাহিম যখন ম্যানহাটানে তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টের লিফটে ওঠেন, তখন তাঁর পিছু নিয়ে দ্রুত লিফটে ঢুকে পড়েন এক ব্যক্তি। তদন্তকারীরা বলছেন, ওই ব্যক্তিই টাইরেস হ্যাসপিল। তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যাগে ইলেকট্রিক করাত ছিল বলে তাঁদের ধারণা। লিফটের সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা গেছে, ফাহিম ওই ব্যক্তিকে কিছু জিজ্ঞেস করছেন। এরপর দুজনের মধ্যে কিছু আলাপ হতেও দেখা গেছে। পরে ফাহিমকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছিল।

বোনের সঙ্গে ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত
বোনের সঙ্গে ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত

ফাহিম লিফট থেকে ঘরে পা রাখতেই মাস্ক পরিহিত ওই ব্যক্তি ফাহিমকে আক্রমণ করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, পেছন থেকে আঘাতের পর ফাহিম লিফট থেকে বের হতেই সামনের দিকে পড়ে যান। এরপর লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ায় সিসিটিভির ফুটেজ আর রেকর্ড হয়নি। তদন্তকারীরা মনে করেন, এরপরই টাইরেস ছুরিকাঘাত করে ফাহিমকে হত্যা করেন। পরে তিনি কার সার্ভিস ডেকে হোম ডিপোয় যান। কার সার্ভিসের সেই পেমেন্ট তিনি পরিশোধ করেন ফাহিমের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে। হোম ডিপো থেকে কিছু ক্লিনিং আইটেমও কেনেন টাইরেস।

ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের লিফটের সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যায়, পরদিন ১৪ জুলাই দুপুরে আবার ফিরে আসেন টাইরেস। সঙ্গে ছিল রিচার্জেবল ভ্যাকুয়াম। পুলিশের মতে, এটি হত্যার চিহ্ন মুছে ফেলতে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৪ জুলাই দুপুরে ইলেকট্রিক করাত ব্যবহার করে ফাহিমের দেহ খণ্ড খণ্ড করেন হ্যাসপিল। এ সময় ফাহিমের বোন অ্যাপার্টমেন্টের দরজা নক করেন। তিনি পুলিশকে ‘ওয়েলফেয়ার চেকের’ (নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীর অপমৃত্যু হয়েছে, এ রকম আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চাওয়া) অনুরোধ জানান। তবে পুলিশ আসার আগেই ভবনের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে টাইরেস পালিয়ে যান। ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের সূত্র ধরেই ১৭ জুলাই প্রায় এক মাইল দূরের একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জামিন নাকচ করে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান। ১৭ আগস্ট আবার আদালতে হাজির করার কথা হ্যাসপিলকে।