এমন পুলিশি হানার পরও ফুরফুরে মন
নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে অ্যালকোহল বা মাদক-নিয়ে গাড়ি চালানো ফৌজদারি অপরাধ। প্রমাণ হলে গ্রেপ্তার ও জরিমানা অবধারিত। লাইসেন্সও বাতিল হওয়ার জোর আশঙ্কা থাকে। আমেরিকার একেক রাজ্যে একেক নিয়ম।
পাশের রাজ্য নিউজার্সিতে যদি কেউ মাতাল হয়ে গাড়ি চালায়, গ্রেপ্তার হতে পারে। প্রথম অপরাধ হলে তখন দণ্ড হিসেবে ৩ থেকে ১২ মাসের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত হয়ে যেতে পারে। জরিমানা ফি গুনতে হয় প্রায় ৭৫০ ডলার থেকে ১০০০ ডলার পর্যন্ত। সঙ্গে ৩০ দিনের জেলও হতে পারে।
সেদিন ছিল রোববার। রাত তিনটার দিকে ফিরছিলাম ফিলাডেলফিয়া থেকে। তিন দিন ধরে ফুপাতো বোনের বিয়ে ও বউভাত খেয়ে আড্ডা দিতে গিয়ে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। গন্তব্য নিউইয়র্কের কুইন্স। মাথায় ছিল পরদিন অফিস করার তাড়া। বড় কোনো সমস্যা না হলে আমি অফিসে কল আউট করি না। দুকাপ ব্ল্যাক কফিতে চাঙা হয়ে কাজ শুরু করার অভিজ্ঞতা আমার। বরকে টেনে–হিঁচড়ে মাঝ রাতে গাড়ি চালাতে বাধ্য করেছি। বেচারার এত রাতে জমজমাট আড্ডা ফেলে ড্রাইভ করার ইচ্ছা ছিল না। সে বুঝে ফেলেছে পরের দিন আমি অফিস ধরতে চাই। জানাল, তিন ঘণ্টার চেয়ে বেশি লাগতে পারে। রাস্তা ফাঁকা থাকবে। এত সময় লাগবে না জেনেও তর্কে গেলাম না। কিছু বললে আমার চারবার রোড টেস্ট ফেল করার পুরোনো কাহিনি তুলে সবাইকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে আরও কিছু সময় নষ্ট করবে। এসব ভেবেই তখনকার মতো অগত্যা চুপই থাকলাম।
ফিলাডেলফিয়ার পথ শেষ করে গাড়ি নিউজার্সিতে ঢুকতেই খেয়াল করলাম, মেয়ে দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট মেয়ে ড্রাইভিং কন্ট্রোল করবে বলে বাপের পাশের সিটে বসেছে। দেখলাম, সে সামনের সিট পুরোটা পেছনে হেলিয়ে বিছানা মতো করে নিয়েছে। সবার আগে সেই ঘুমিয়ে গেল। বড়টা পেছনে আমার পাশে। সিট ফেলে সে গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করছি, বক বক করে বরকে জাগিয়ে রাখার। রাতে গাড়ি যেই চালাক না কেন, আমি সব সময় আমার দেশের ড্রাইভার ভাইদের কথা মনে মনে স্মরণ করি। তাদের একজন দুলাল ভাই রাতে ড্রাইভ করার সময় বলতেন, আপা রাতের বেলা গাড়ি চালাবেন আপনি, আমি শুধু ফলো করব। তার মানে হলো আমি ঘুমাতে পারব না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওনার নানান গল্প শুনতে হতো।
আমাদের গাড়ি ফিলাডেলফিয়া পার করে নিউজার্সির পথে চলছে। বেশ কিছুটা সময় পর রাস্তায় নিয়ন আলো দেখতে পেলাম। রাতের অন্ধকারে ফিলাডেলফিয়ার রাস্তায় খুব একটা লাইট চোখে পড়েনি। এখানেও আমেরিকার মিতব্যয়িতা নজরে আসে। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, ততটাই এরা ব্যয় করে।
গাড়ি চালানোর সময় আমার বর বলছে, এটা এইচওভি (হাই অকুপেন্সি ভেহিকল) লাইন। এটাতে তারাই গাড়ি চালাবে, যারা এক/দুই ঘণ্টার মধ্যে কোনো এক্সিট নেবে না। এই লাইন তুমি মন চাইলেই বদল করতে পারবে না। রাস্তায় যখন ডট ডট মার্ক আসবে, তখন লেন বদল করতে পারবে। অন্যথায় পুলিশ টিকিট ধরিয়ে দেবে। আমেরিকার রাস্তার জ্ঞান দিতে দিতে সে গাড়ি চালাচ্ছে। সে সময়ে রাস্তায় কিছু বড় লরি, ট্রাক ছাড়া আর তেমন কোনো প্রাইভেট গাড়ি চোখে পড়ছিল না। তাই সে অনেকটাই আয়েশে ড্রাইভ করছে। আর সঙ্গে যদি আমার মতো আনাড়ি আর চারবার পরীক্ষা দিয়েও পাস না করা মানুষ থাকে, তাহলে মনে হয় সব ড্রাইভারেরই বেশ সুবিধা।
আবারও দেশের কথা মনে পড়ে যায়। দেশে থাকতে আমাকে প্রায়ই ঢাকা–চট্টগ্রাম বাই রোডে অফিসের কাজে দৌড়াতে হয়েছে। তখনো পেছনের সিটে বসে ড্রাইভারদের কাণ্ড কারখানা দেখেছি। হেলাল, লিটন পরে দুলাল ভাই। আমার ধারণা, এসব মানুষের দেওয়া অতি জ্ঞানের কারণে আমি এখনো রোড টেস্ট পাস করতে পারিনি। পরীক্ষা দিতে ড্রাইভিং সিটে বসলেই তাঁদের দেওয়া পরামর্শের কথা মনে পড়ে যায়। যথারীতি পরীক্ষক বলেন, আমাকে আরও প্র্যাকটিস করতে হবে।
এর মধ্যে আমার চোখে কিছুটা তন্দ্রা এসেছিল। দেখলাম, এইচওভি লাইনের রাস্তা পার হয়ে গাড়ি নিউজার্সির নরমাল লেনে চলছে। কেন যেন মনে হল, গাড়ি অল্প হেলেদুলে চলছে। কথা না বলে সামনে বসা চালকের দিকে নজর দিলাম। দেখলাম, সে হাত দিয়ে চোখ মুখ চুলকাতে চুলকাতে ড্রাইভ করছে। গাড়ি মনে হল হালকা দুলছে। কফি শপে থামবে কি না জানতে চাইলে উত্তর আসে, মেয়েরা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। কোথাও থামলে ওদের ডিস্টার্ব হবে। বুঝতে পারলাম, ও জেগে আছে।
অল্প দূর যেতেই পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। গাড়ি থামাতে বলছে। আমার বরকে দেখলাম, কিছুটা অপ্রস্তুত তবে খুব সতর্ক হয়ে গাড়ি থামাল। আমাকে বলল, ভয় পেয়ো না, পুলিশ আসছে। টিকিট দিয়ে চলে যাবে। এর মধ্যে একজন ইয়াং হ্যান্ডসাম পুলিশ অফিসার নেমে এসে জানালার গ্লাস নামাতে বলল, নামাতেই সুন্দর ছেলেটিকে দেখতে লাগলাম। সে আমাদের গাড়ির কাগজপত্র চেক করতে থাকল। আমরা কোথায় থেকে আসছি, কোথায় যাচ্ছি এসব প্রশ্ন করছে। যদিও গাড়ির নম্বরপ্লেটে নিউইয়র্ক লেখা আছে। তারপরও সে নানান প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। এরই মধ্যে মেয়েরা জেগে উঠেছে। সবই ঠিকঠাক ছিল।
ঝামেলাটা বাঁধল তখনই যখন ইয়াং পুলিশ আমার বরকে বলেছে, ‘আই থিংক ইউ আর ড্রাংক’। সে উত্তর দেওয়ার আগেই ছোট মেয়ে উঠে বসে উত্তর দিল, অফিসার ইউ কেন নট সে লাইক দ্যাট ওয়ে।
অফিসার বিরক্ত হয়ে তার আইডি দেখতে চাইল। এবার পেছন থেকে বড় মেয়ে বলল, অফিসার তুমি এবার আরেকটা ভুল করছ। সি ইজ আনডার এজ। তুমি চাইলেই আমরা তোমাকে তার আইডি দেখাতে বাধ্য নই। নাউ ইউ হেভ টু প্রুফ, মাই ডেড ইজ ড্রাংক। মেয়ে দুইটার রুদ্রমূর্তি দেখে আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। থামাতে চেষ্টা করলাম। বললাম, তোমার বাবাকে কথা বলতে দাও। আরও অবাক হলাম, সে মেয়েদের কথা বলতে বাঁধা দিল না। কিছু না বলে সে উল্টো মুখে তালা দিয়ে চুপ করে আছে।
এবার অফিসার বলছে, তোমাকে আমি ৯০ মাইল রাস্তা ধরে ফলো করতে করতে এখানে আসছি। এইচওভ লাইনে গাড়ি চালানোর কথা ৭০/৮০ মাইল স্পিডে, সেখানে তুমি ৫০/৬০ মাইল স্পিডে এলেমেলো গাড়ি চালিয়েছ। আমি তোমার ড্রাইভিং ভিডিও করেছি। ড্রিংক করেই মানুষ এমন গাড়ি চালায়।
পুলিশ কর্মকর্তার কথার যুক্তি আছে। আমিও টের পেয়েছি। আমি এবার মুখে কিছু না বলে মনে মনে স্মার্ট পুলিশ অফিসারের পক্ষ নিলাম। মেয়েরা বলছে, তোমার কাছে অনেক প্রমাণ থাকতে পারে। তবে তুমি ড্রাংক টেস্ট করে প্রমাণ না হওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি কাউকে ড্রাংক বলতে পারো না। আমি তো অবাক! তাই নাকি? ওরা এত কিছু কীভাবে জানে!? ইশারায় তারা আমাকে চুপ করিয়ে দেয়। আমি তখন জরিমানা কত হতে পারে, তা ভাবছিলাম আর মেয়ে দুইটার পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া শুনছি। তারা বলছে, তোমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় প্রমাণ ছাড়া কাউকে এমন কথা না বলার জন্য। তুমি একজন ড্রাইভারকে তার সন্তানদের সামনে যা ইচ্ছা তাই প্রশ্ন করতে পারো না। যদি কারও গাড়িতে ১৮ বছরের নিচে কোনো সন্তান থাকে, তার সামনে তো এমন প্রশ্ন করা তোমার অপরাধ। আনডার এইটিন তোমাকে আইডি দেখাতে বাধ্য না। তুমি মন চাইলেই এমন কাউকে মাঝ রাতে গাড়ি পুলওভার করতেও পারো না। তোমার টিকিট দেওয়ার থাকলে তুমি বাসায় ডাকযোগে পাঠাতে পারো।
মেয়েরা বলছিল, আমার মায়ের সকালে অফিস আছে। তুমি আমাদের সময় নষ্ট করেছ। এরই মধ্যে আরও কয়টা পুলিশের গাড়ি এসে থেমেছে। আমি এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। তাদের চুপ করতে বললাম। উল্টো ধমক খেলাম, মা তুমি চুপ করো। তারা বলছে, তোমাকে এখন প্রমাণ করতে হবে যে আমার বাবা ড্রাংক। না হয়, তোমাকে এখন সরি বলতে হবে। কেন তুমি আমাদের গাড়ি থামালে? মনে মনে ভাবলাম, পুলিশ অফিসারটা ধীর গতির জন্য একটা টিকিট দিয়ে গাড়িটা ছেড়ে দিতে পারত।
অন্য পুলিশ অফিসাররা গাড়ির কাছে এসে মেয়েদের তর্ক করা দেখতে থাকল। এর মধ্যে লক্ষ্য করলাম, তারা কেমন যেন এনজয় করার মুডে আছে। ৩০ মিনিটের মতো আমরা থেমে আছি নিউজার্সির মাঝ রাস্তায়। কিন্তু কোনো পক্ষই কোনো সমাধানে আসছে না। অফিসারটাও গাড়ির জানালায় গলা ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি অফিসাররা দাঁড়িয়ে মেয়েদের তর্ক উপভোগ করছে। কী মুসিবতে পড়লাম, ভাবতেই আচানক বয়স্ক একজন অফিসার ‘আমাদের দেশ কোথায়’ জানতে চাইল। আমি গলা উঁচিয়ে বলতে যাব, এমন সময় ছোট মেয়েটা বলে উঠল, দেটস নট ইউর বিজনেস। ফ্যাক্ট ফার্স্ট (fact first)। কাম টু দা ফ্যাক্ট।
এবার বয়স্ক মতো অন্য একজন অফিসার আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ইউ হেভ স্মার্ট গার্ল। ধন্যবাদ দিলাম। কুতর্ক করাকে এদের পছন্দ হয়েছে দেখে কিছুটা সময় হতভম্ব হয়ে গেলাম।
অবশেষে পুলিশের দল মেয়েদের জেরার কাছে অনেকটা হেরে গিয়ে ‘সরি’ বলতে বাধ্য হলো। তারা যাওয়ার সময় তাদের বাবাকে একটা হুঁশিয়ারি টিকিট ধরিয়ে দিল। আমি ওদের জানালাম, আমরা বাংলাদেশি। সিনিয়র অফিসারটা যেতে যেতে বলে গেল ‘আই লাইক ইউর রেড রাউন্ড কালার’। এ প্রথম কেউ আমার কপালের টিপ পছন্দ করল। মনটা ভরে গেল। মেয়ে দুইটা আর তাদের বাপ কী বলছে, আমি তার কিছুই শুনলাম না। মন ভালো করা সকালে অফিসে গেলাম।