
দীর্ঘ লকডাউনের পর নিউইয়র্ক খুলেছে ৮ জুন সোমবার। লোকজন বেরিয়ে আসছে। সবার চোখেমুখে তাড়া করছে অজানা আতঙ্ক। কয়েক ধাপে নগরী খুলবে। পাশের অঙ্গরাজ্য নিউজার্সি খুলছে এক সপ্তাহ পর।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটন থেকে পশ্চিমের নদীটা পেরোলেই নিউজার্সি। ভিন্ন রাজ্য, ভিন্ন জনপদ। নিউইয়র্কের মতো কোলাহল নেই। করোনার তাণ্ডবের সময় ফটোগ্রাফার হৃদয় অনির্বাণ খন্দকার বাস করতে শুরু করেন নিউজার্সিতে। সুযোগ পেলেই নগরী ঘুরে বেড়ান। অনির্বাণ খন্দকারই একমাত্র বাংলাদেশি ফটোগ্রাফার, যিনি লকডাউনের সময় নিয়মিত ছবি তুলেছেন অবরুদ্ধ নগরী ঘুরে ঘুরে। তাঁর এসব ছবি আমরা নিয়মিত প্রথম আলোতে ছেপেছি। অনলাইনে প্রকাশ করেছি।
৯ জুন মঙ্গলবার রাতে ঘরে ফিরছিলেন অনির্বাণ খন্দকার। দিনভর অবরুদ্ধ নগরী খুলে দেওয়ার ছবি তুলেছেন। গত কয়েক দিন বিক্ষোভের সময় ঘটে যাওয়া লন্ডভন্ড নগরীর কিছু এলাকার ছবি তুলে হল্যান্ড টানেল ধরেছেন নিউজার্সিতে বাড়ি ফিরবেন বলে। হল্যান্ড টানেল পেরিয়ে গাড়ি চলছে পশ্চিমে। অনেকটাই কোলাহলহীন, ট্রাফিকহীন সড়কপথ।
আচমকা সামনে কুণ্ডলী পাকানো আগুনের জ্বলে ওঠা দেখেন। প্রচণ্ড শব্দ শোনেন। অনির্বাণ গাড়ি থামানোর আগে সড়ক পথে অন্য কিছু গাড়িও থেমে যায়। কেউ একজন ফোন করে পুলিশে। পুলিশ তখনো আসেনি। এমন অবস্থায় গাড়ি থেকে না নামাই সাধারণ নিয়ম। পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বিপজ্জনক রাজপথে মধ্যরাতের কিছু আগে ক্যামেরা হাতে এগিয়ে যান অনির্বাণ খন্দকার। মানুষ পুড়ছে। সড়কপথে আহতজনের আর্তনাদ। ক্যামেরা রেখে মৃত্যুপথযাত্রী একজনকে পানির বোতল এগিয়ে দেন অনির্বাণ খন্দকার। আমাকে ফোন করেন। কাঁপা কণ্ঠে জানান, গাড়ি দুর্ঘটনায় কতজন মারা গেছে বলতে পারছেন না । কতজন পুড়ে গেছে , কিছুই বলতে পারছেন না। কাঁপা কণ্ঠে ফোনে কথা বলছেন অনির্বাণ।
পুলিশে জানানো হয়েছে, কেউ একজন ৯১১-এ কল করেছে , অনির্বাণ দুর্ঘটনার কিছুই জানেন না । এ অবস্থায় রাজপথে তাঁর নিজেরও নিরাপত্তা নেই। দ্রুত জানতে চেষ্টা করছিলাম, ঠিক কোন জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে? ঠিক কোন জায়গায় মধ্যরাতের এ মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করছেন অনির্বাণ! লোকেশন ঠিকমতো বলতে না পারলেও আমি অনুমান করতে পারি ইউনিয়ন সিটির আশপাশের কোনো এলাকায়। এলাকাটি এমনিতেও খুব নিরাপদ নয়।
পুলিশ আসছে, জরুরি বিভাগ আসছে। অনির্বাণকে নিরাপদে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বলি। চলচ্চিত্র বিষয়ে নিউইয়র্কের একটি ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন অনির্বাণ খন্দকার। স্থিত হয়ে আমাকে ছবিগুলো পাঠালে আমি ঘটনার তল্লাশিতে নামি।
১১ জুন বুধবার নিউজার্সির গভর্নর ফিল মারফি জানান, রোড-২২ এ যেখানটায় ইউনিয়ন শহরটি শুরু হয়েছে, সেখানে গাড়ি পুড়ে গিয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে আগের রাতে। নিউজার্সির সি বিচ আংশিক খুলে দেওয়া হলেও নির্দেশ অমান্য করে বিপুলসংখ্যক অল্পবয়সী প্রায় ৫০ মাইল দক্ষিণের এক সৈকতে পার্টিতে যোগ দেয়। ওই পার্টিরই লোকজন তারা। পার্টি থেকে কয়েক জনকে পুলিশ নির্দেশ অমান্যের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গভর্নর।
পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ-তরুণীর গাড়িটি রোড-২২-এ আসার পর কেন বিস্ফোরিত হলো—এ নিয়ে তদন্ত চলছে। তিনজন যাত্রীই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। বেঁচে যাওয়া দুজন হাসপাতালে। এর মধ্যে ফটোগ্রাফার হৃদয় অনির্বাণ খন্দকারের এগিয়ে দেওয়া পানির বোতল থেকে পানি পান করা একজন হয়তো বেঁচে আছে। এ দুর্ঘটনার আর কোনো ছবি স্থানীয় কোনো মিডিয়ায় আসেনি ঘটনার একদিন পরও। হয়তো কারও কাছেই নেই দুঃখজনক এ সড়ক দুর্ঘটনার তাৎক্ষণিক কোনো আলোকচিত্র। মানুষের বিপদে বসে থাকতে না পারা হৃদয় অনির্বাণ খন্দকারের তোলা আলোকচিত্রগুলো হয়তো এ দুর্ঘটনার একমাত্র প্রামাণ্য চিত্র। এই দুর্ঘটনা তাঁকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে।