সফল বাংলাদেশি পদার্থবিজ্ঞানীর গল্প
তাঁর চিকিৎসক বাবা মোহাম্মদ আবদুস শুকুর চেয়েছিলেন, ছেলেও বড় হয়ে বাবার মতো ডাক্তার হবে। কিন্তু সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় জন্ম নেওয়অ এক কিশোর বড় হয়ে বিশ্বসেরা বাংলাদেশি পদার্থ বিজ্ঞানীদের একজন হবেন, কেই বা জানত। বলছিলাম বাংলাদেশের এক সূর্যসন্তান পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আতাউল করিমের কথা। জীবনে সফল হতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আতাউল করিমও এর ব্যতিক্রম নন। জীবনের ধাপে ধাপে সংগ্রাম করে তবেই না প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাথের প্রভোস্ট এবং এক্সিকিউটিভ ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কর্মরত।
জন্ম ও ছাত্রজীবন: ১৯৫৩ সালের ৪ মে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন চিকিৎসক এবং মা একজন গৃহিণী। আর তার স্ত্রী সেতারা একজন প্রাণরসায়নবিদ। ষাটমা আদর্শ বিদ্যালয় থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিদ্যালয় ভবনের ছাদ পুড়ে যাওয়ায় ক্লাস করতে হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। তারপর ভর্তি হোন পাথারিয়া ছোটলিখা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এক বছর এখানে পড়ার পর বাবার ইচ্ছানুযায়ী ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় টিকেও খাটো হওয়ায় মেডিকেল পরীক্ষায় বাদ পড়তে হয়। দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় ১ হাজার ৬০০ জনের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম ৪০ জনের মধ্যে থেকে ঠিকই এই বৈতরণি পার হয়ে ১৯৬৫ সালে ভর্তি হন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে, যা তখন ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ নামে পরিচিত ছিল। ক্যাডেট কলেজের কঠিন নিয়মকানুন কী রকম লাগত, জানতে চাইলে জানালেন, খুব খারাপ লাগে নাই; এক সময় সব নিয়মকানুন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
১৯৬৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৬৪ হাজার ৪৩২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। উচ্চ মাধ্যমিকের সময় তখন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। এ রকম পরিস্থিতিতেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে হয়। আতাউল করিম জানালেন, দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সময় আরও অনেক গুরুত্বসহকারে পড়াশোনা করতে হয়েছে যাতে প্রথম স্থান ধরে রাখা যায়। ১৯৭২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৩৯ হাজার ৮৬৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হন। তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কেমন ছিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এর মধ্যেও আমাদের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হন তিনি। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাড়ি জমান।
আমেরিকায় শুরুর দিককার গল্প: আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে পদার্থবিদ্যায় এবং ১৯৭৯ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর লাভ করেন তিনি। তখনকার সময়ে আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল জানতে চাইলে বলেন, আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য তখন ১৬ বছরের শিক্ষাজীবন থাকতে হতো। কিন্তু আমার ছিল ১৫ বছর। আমি এক বছর পিছিয়ে আছি জেনেই ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকলেও ভর্তির প্রথম অফার আসে আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং সেখানেই ভর্তি হই। তখন আমি জানতাম না, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ারও সুযোগ ছিল, কিন্তু এ নিয়ে কোন আফসোস নেই। শুরুর দিকে মানিয়ে নেওয়াটা একটু কষ্টকরই ছিল। আমেরিকায় আসার উড়োজাহাজের টিকিট বাকিতে কাটতে হয়েছিল। চাইলেই বাবার কাছে থেকে টাকাটা নিতে পারতাম। কিন্তু নিইনি। টিকিটের টাকা পরিশোধ করার জন্য এবং পড়াশোনার খরচ চালাতে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের পাশাপাশি রেস্টুরেন্টেও কাজ করতে হয়েছে। ১৯৮২ সালে আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি শেষ করেন।
কর্মজীবন: আতাউল করিম ১৯৮১ সালে ইউনিভার্সিটি অব আরকানসাসে শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে উইচিটা স্টেট ইউনিভার্সিটির তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ডেটনে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮-২০০০ সাল পর্যন্ত টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তারপর ২০০০ সালে সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিনের দায়িত্ব পালন করেন। এ কলেজে তিনটি নতুন বিভাগ বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ও আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেম সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তারপর ২০০৪-২০১৩ সাল পর্যন্ত ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটির তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করেন। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথে কর্মরত।
গবেষণা: আতাউল করিম বিভিন্নরকম গবেষণা চালিয়েছেন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ব্যাপক বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে অপটিক্যাল কম্পিউটিং, প্যাটার্ন/টার্গেট রিকগনিশেন, নাইট ভিশন, বিভিন্ন রকম ডিসপ্লে, ইলেকট্রো-অপটিক্যাল সিস্টেমস, সেন্সরস, নন–লিনিয়ার ইমেজ প্রসেসিং প্রভৃতি।
পুরস্কার ও সম্মাননা: নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালে আউটস্ট্যান্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৪ সালে আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯১ সালে অ্যালামনাই অ্যাওয়ার্ড ইন স্কলারশিপ, ১৯৯০ সালে নাসা টেক ব্রিফ অ্যাওয়ার্ড ও আপ অ্যান্ড কমার্স এডুকেশন অ্যাওয়ার্ড প্রভৃতি। এ ছাড়া তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘আউটস্ট্যান্ডিং পিপল অব দি টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’ ও ‘আমেরিকান ম্যান অ্যান্ড উইমেন ইন সায়েন্স’ শীর্ষক তালিকাসহ আরও নানা সম্মানজনক তালিকায়।