প্রশ্নের মুখে ট্রাম্পের নেতৃত্ব

করোনাভাইরাস মহামারিতে নিউইয়র্কে মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে মরদেহ সৎকারের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থা। নিউইয়র্কের র‌্যান্ডালস আইল্যান্ডের আইক্যান স্টেডিয়ামের পার্কিংয়ে গত ৩১ মার্চ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা লাশবাহী গাড়ি। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস মহামারিতে নিউইয়র্কে মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে মরদেহ সৎকারের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থা। নিউইয়র্কের র‌্যান্ডালস আইল্যান্ডের আইক্যান স্টেডিয়ামের পার্কিংয়ে গত ৩১ মার্চ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা লাশবাহী গাড়ি। ছবি: রয়টার্স
>
  • মৃত্যু ৫,৩১৬ ও আক্রান্ত ২ লাখ ২৬ হাজারের বেশি 
  • শুধু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যথেষ্ট নয় 
  • ইতালির ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে আমেরিকাকে


নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সামনে রীতিমতো অসহায় হয়ে গেছে মহাপ্রতাপশালী হোয়াইট হাউস। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অক্ষমতা ভীষণভাবে স্পষ্ট করে তুলেছে এই মহামারি। এপ্রিলের প্রথম দিনেই আমেরিকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় এক হাজার মানুষের। এক দিনে এত বেশি মানুষের মৃত্যু মহামারি মোকাবিলায় প্রশাসনের কথিত প্রস্তুতির সামনে এক বড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। এটি একই সঙ্গে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বকেও।
শুরুতে করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবকে কোনো গুরুত্বই দেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেছিলেন, আমেরিকা চীন নয়। পরিস্থিতি মোকাবিলার যথেষ্ট প্রস্তুতি আমেরিকার রয়েছে। কিন্তু এখন এই সময়ে আমেরিকাকেই সবচেয়ে বেশি অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, ২ এপ্রিল পর্যন্ত আমেরিকায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লখ ২৬ হাজার ছাড়িয়েছে। মারা গেছেন ৫ হাজার ৩১৬ জনের বেশি। যে নিউইয়র্ককে লকডাউন ঘোষণার প্রয়োজন নেই বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সেই নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে ৯২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২ হাজার ৩৭৩। শুধু নিউইয়র্ক নগরেই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৩৭৪ জন, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে। নিউইয়র্ক নগরে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক আগেই ৪৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

করোনায় দুঃসংবাদ হৃদ্‌রোগীদের জন্য। নিউইয়র্ক নগরের সব বরোতে ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিস বা ইএমএসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, হৃদ্‌রোগীকে ঘটনাস্থলে প্রাণ ফিরাতে না পারলে যেন হাসপাতালে আনা না হয়। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে ইএমএসের গাড়িতে থাকা প্যারামেডিক্‌স প্রাথমিক চেষ্টা করে রোগীকে মৃত ঘোষণার আগে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেত। এখন সেটি না করেই ঘটনাস্থলেই প্যারামেডিক্‌স চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে পারবেন।

মার্কিন জরুরি বিভাগ প্রশাসনের কাছে লাশ রাখার জন্য এক লাখ ব্যাগ প্রস্তুত রাখার চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে। এই ব্যাগ জোগান দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ।

এই যখন অবস্থা, তখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। যদিও জনসমাগমের ওপর আরোপ করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এটিকে যথেষ্ট বলে মনে করছেন না স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, জনসমাগমস্থলগুলো বন্ধ করা এবং ১০ জনের বেশি জমায়েত হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মধ্য দিয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরই মধ্যে লকডাউন জারি হয়ে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই থমকে গেছে অর্থনীতি। লাখ লাখ মানুষ এরই মধ্যে কাজ হারিয়েছেন। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকে তার কোনো ঠিক নেই। লকডাউন ঘোষণা করলে অর্থনীতির অবস্থা এর চেয়ে বাজে হয়তো হবে না। কিন্তু যদি না করা হয়, তবে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ভয়ংকর দিকে মোড় নিবে।

প্রশাসন যে এই হিসাবটি জানে না, তা নয়। কিন্তু খোদ প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা আসছে না। যদিও ২ এপ্রিল মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সিএনএনকে বলেন, আমেরিকার পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ইতালির ভাগ্য বরণ করতে হবে।

বর্তমানে আমেরিকার পরিস্থিতি আদতে এমন যে, হোয়াইট হাউসের পক্ষে আসলে অসহায় হয় দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের লোকেরা এই মুহূর্তে আমেরিকানদের ঘরে থাকার জোর আহ্বানই কেবল জানাতে পারেন। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই শুধু মার্কিন প্রশাসনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহ সংকট, যা স্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের বড় ঝুঁকিতে ফেলছে।

এই পরিস্থিতিতে হোয়াইট হাউস কিছু পদক্ষেপ যে নিচ্ছে না, তা নয়। যেমন ট্রাম্পের অর্থনীতি সচলের প্রস্তাব এড়িয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হোয়াইট হাউস। ঘোষণাটি ট্রাম্পের কাছ থেকেই এসেছে। কিন্তু তার আগেই ‘দু সপ্তাহের মধ্যে অর্থনীতি সচলের’ কথা বলে, যা অঘটন ঘটানোর, তা ঘটিয়ে ফেলেছেন ট্রাম্প। আর তা হলো নিজের নেতৃত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেওয়া।

শুরুতে গুরুত্ব না দেওয়া এই মহামারিকে এখন অতি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হচ্ছে প্রশাসনকে। গত ৩১ মার্চ প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইক পেন্স জানান, আমেরিকায় এই মহামারিতে ১ লাখ থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে। এমনকি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতিসহ অন্য সতর্কতাগুলো অবলম্বনের পরও মৃতের সংখ্যা এমন হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন।

এই যখন অবস্থা, তখন রাজনৈতিক পরিসর থেকে শুরু করে জনপরিসরে একটি প্রশ্নই বারবার উঠছে। আর তা হলো—পরিস্থিতি যদি এতটাই বাজে হবে, তবে ট্রাম্প শুরুতে কেন একে কোনো গুরুত্ব দেননি? তিনি এই ঝুঁকিকে কেন লুকাতে চেয়েছিলেন? শুরুতে কেন প্রস্তুতি নেওয়া হলো না? এই অপ্রস্তুতিকেই এখন এত এত মৃত্যুর জন্য দুষছেন সবাই।

কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি সিএনএনকে বলেন, ‘শুরুতে ট্রাম্প যেভাবে সংকট অস্বীকার করেছেন, তা ছিল ভয়ংকর। এখন মানুষ মরছে।’

প্রশাসনের কর্মকর্তারাই বলছেন, শুরুর গা-ছাড়া ভাবের কারণেই এখন সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভেন্টিলেটর থেকে শুরু করে চিকিৎসা সরঞ্জামের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য ও জরুরি সেবাকর্মীদেরই ঝুঁকিমুক্ত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকায় এখন এমন কোনো অঞ্চল নেই, যা ঝুঁকিমুক্ত। প্রতিটি অঞ্চলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা শুরু থেকেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দিক থেকে প্রকাশ করা হলেও ট্রাম্প ছিলেন নির্বিকার। বরং বরাবরের মতোই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করে গেছেন এই টুইটার প্রেসিডেন্ট।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন সচেতন হয়ে কথা বলছেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১ এপ্রিল যখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করার ঘোষণা দেওয়ার সময় তিনি বললেন, ‘এই ভয়াবহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমেরিকা সর্বাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যাবে’, তখন তিনি নিজের বিরুদ্ধেই যেন কথা বললেন। নিজের পূর্ববর্তী অবস্থানের জন্য এখন পর্যন্ত দুঃখও প্রকাশ করেননি তিনি। নিজের গোঁয়ার্তুমি ধরে রাখতেই তিনি এখনো তৎপর। এমনকি সংকটকে রাজনৈতিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টাও করছেন। ব্রিফিংয়ে তিনি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স দুজনের কেউই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেননি। এমনকি সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়ানোর ক্ষেত্রে পেন্সের দক্ষতায় নিজের মুগ্ধতাও তিনি লুকাতে পারেননি।

এত কিছুর পরও হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের নেতৃত্বকে ‘যথার্থ’ বলা হচ্ছে। যদিও হোয়াইট হাউসে গঠন করা করোনাভাইরাস টাস্কফোর্সের এক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ট্রাম্প এই মহামারি নিয়ে জুয়া খেলেছেন। তিনি সব বিশেষজ্ঞের কথা শুনেছেন। এরপর তিনি একজন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আলাদা হয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেছেন। ওই বিশেষজ্ঞ ‘তাপমাত্রা বাড়লে প্রকোপ কমতে পারে’ বলে একটি সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। ট্রাম্প এটিকেই অকাট্য ধরে নিয়েছেন যে, বসন্তে উত্তাপ বাড়লে এমনিতেই ভাইরাস হাওয়া হয়ে যাবে। কিন্তু আদতে তা হয়নি।

এত কিছুর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে রাজনীতির বর্মটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তিনি ও তাঁর রিপাবলিকান সমর্থকেরা বলছেন, প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করতে ডেমোক্র্যাটরা যা করেছে, তাই প্রশাসনকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় বাধার মুখে ফেলেছে। সিনেটে রিপাবলিকান দলের নেতা মিচ ম্যাককোনেল সরাসরি বলেছেন, অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে ওয়াশিংটন এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, তাদের পক্ষে এই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি তাঁরা সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) ঘাড়ে দায় চাপাতেও পিছপা হচ্ছে না। তাঁদের বক্তব্য, সিডিসি নাকি শুরুতে পরিস্থিতি এতটা বাজে হবে—এমন কোনো পূর্বাভাস দেয়নি।

কিন্তু তাঁদের এই বক্তব্যের কোনোটিই যে ধোপে টিকবে না, তা একটিমাত্র তথ্যেই পরিষ্কার। আর তা হলো, করোনাভাইরাসের কারণে যেকোনো ঝুঁকিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কাজটি প্রথমেই করেছিলেন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। তিনি এই পুরো সময় ধরেই শুধু তাঁর পুনর্নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এখনো তিনি নভেম্বরের দিকেই তাকিয়ে আছেন। এই দুর্যোগে অর্থনীতি সচল করতে চাওয়ায় অন্তত তা-ই প্রকাশ পায়। আর এমন চাওয়া ও লক্ষ্যই প্রেসিডেন্টের আত্মকেন্দ্রিক রূপটি আরও নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে, যা তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।