সাইরেনের শব্দ শুনে লেখা বন্ধ করে দিই!
বাইরে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন ছাড়া আর কোনো শব্দ শুনি না! উডহেভেন, কুইন্সের বাসায় বসে এভাবেই কাটছে দিন! প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদকের সঙ্গে ফোনে কথা হয়! সরাসরি না হলেও ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে লেখার অনুরোধ জানান তিনি!
তাঁর ধারণা, মনের শক্তি অনেকের আছে! তাঁর আছে, সে মাত্রায় না থাক। বাকিদেরও খানিক কেন থাকবে না। এ দুঃসময়েও লিখে যাচ্ছেন নিজে। তাই আশা করতেই পারেন সতীর্থদের কাছ থেকে।
আমি চেষ্টা করি লেখা দাঁড় করাতে। শুরু করি, বাইরে সাইরেনের শব্দ শুনে লেখা বন্ধ করে দিই।
ঘরে বন্দী প্রবাসীরা এখন অপেক্ষা করতে থাকে। জানতে চায়, কী ঘটছে। সাইরেনের শব্দ ছাড়া যে বাইরের কিছু আর শুনতে পায় না মানুষ। তাই অপেক্ষায় থাকে, কখন ফেসবুকে আপডেট দেওয়া হবে।
কয়জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে? কয়জন আজ মারা গেলেন? কে কে মারা গেলেন? করোনায় প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে প্রতিবেশী, আত্মীয়-বন্ধুদের।
একজন কাছের মানুষ, করোনায় প্রাণ কেড়ে নিল। আমার স্ত্রী উষা বলেন, নুসরাত ভাবির সঙ্গে মাস দুয়েক আগে দেখা হয়েছিল। হাসিমুখে কথা বলছিলেন। প্রাণবন্ত, সুন্দর মানুষটির বয়স পঞ্চাশের মতো ছিল। মন খারাপ হয়। মুভি দেখে মন ভালো রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করি। আমাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ সাবেক ছাত্রনেতা শাহাবুদ্দিন। হাসপাতালের শয্যা থেকে বার্তা লিখে পাঠান। জানান, তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এক মিনিটের জন্যও ভেন্টিলেটরের সাহায্য ছাড়া পারছেন না শ্বাস নিতে। মেসেজ পেয়ে আমাদের কষ্ট হয়।
টিভিতে সংবাদ দেখার চেষ্টা করি। আরও আগে থেকে সাবধানতা অবলম্বন করলে এত মানুষ মরত না। দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট দোষ চাপান দেশের রোগনিয়ন্ত্রণ সংস্থার ওপর। তারা দোষ দিচ্ছে চীনের ওপর, ওরা সঠিক সময়ে আমাদের জানায়নি। এসব দেখে কষ্ট বাড়ে, এবার ভয় হয়। খুব বেশি ভয়। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। আমেরিকার ৯০ শতাংশ মানুষ নিজেদের ঘরে বন্দী। আমেরিকার মানুষ এমন পরিস্থিতি দেখেনি আগে। বিশ্বের কেউ দেখেনি। মানুষ এমন পরিস্থিতিতে কী করবে ঠিক করতে পাচ্ছে না।
আমেরিকার নানা অঙ্গরাজ্যের মানুষ ছুটছে চার্চের দিকে। সামাজিক দূরত্বের কথা ভুলে গিয়ে জমায়েত হচ্ছে। আইন অমান্য করায় পুলিশ গ্রেপ্তার করছে যাজকদের।
দিশেহারা নগরীর মানুষও। মানুষ অধৈর্য হয়ে উঠছে। এমন জীবনযাপনে মানুষ অভ্যস্ত নয়। এ জীবনযাপন নয়। মৃত্যুর হাতছানি চারদিকে। ফেসবুক, ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ছে মৃত্যুর ভিডিও প্রতিমুহূর্তে। এসবে নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে নীতি প্রণয়ন হতো। এখন কারও সময় নেই তা দেখার। দ্রুত সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। লাশ গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। ভিডিও করে ছাড়ছে মানুষ। ঘরে বসে অনেকে অনিচ্ছায় এসব দেখছে। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অসুস্থ হলে কী হবে? যাবে কোথায়? হাসপাতালগুলোর অবস্থা নাজুক।
২ লাখ ৪০ হাজারের মতো আমেরিকান মারা যাবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনগণকে প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে। ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষ মরছে প্রতিদিন। এ সংখ্যা বাড়ছে। জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নাকি এমন চলতে থাকবে।
বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষও দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। ফোনে একে অপরের খবর নিচ্ছেন। মানুষের কণ্ঠে মৃত্যুর ভয় প্রকাশ পাচ্ছে। তারপরও আশা নিয়ে বেঁচে আছে মানুষ। দেরিতে হলেও নিউইয়র্কের মানুষ সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি বুঝেছে। পালন করছে কঠোরভাবে, যার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোয় ভর্তির সংখ্যা এখন নাকি কমেছে কিছুটা হলেও।
দুই মাস পর থেকে পর্যায়ক্রমে ঠিক হতে পারে সব। এমন আশা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে চাইছে।