বিয়ে নিয়ে কিছু কথা

‘বিবাহ’ জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। একজন নারী ও একজন পুরুষের যৌথ জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকার এটি। যে চুক্তির মাধ্যমে বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়, তা-ই বিয়ে। এর দ্বারা মানুষ তার মনের কামনাকে বিধিবদ্ধভাবে পূরণের স্বীকৃতি পায়। দৃষ্টি সংযত রাখা ও উন্নত চরিত্র গঠনের সবচেয়ে কার্যকারী ব্যবস্থা হচ্ছে বিয়ে। জৈবিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরহেজগারী ও সুস্থ সংস্কৃতির পূর্ণতায় পৌঁছানোর অন্যতম একটি উপাদান এটি।

ইসলামে বিয়েকে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সামর্থ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ে করা উচিত। ইসলামে বিয়েকে ইবাদতের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বিয়ে প্রতিটি মানুষের জীবনে নিয়ে আসে পরিবর্তন। এর মাধ্যমে জীবন প্রবেশ করে সম্পূর্ণ নতুন একটি পর্যায়ে, যা দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ বয়ে আনে। ইসলামে বিয়ের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা রয়েছে। এই বিধান উপেক্ষা করে নিজেদের খেয়ালমতো বিয়ের কার্যাদি সম্পন্ন করায় কোনো কল্যাণ। বিয়ে একটি সুন্নত, তাই এটি সুন্নত তরিকায় করাই সমীচীন।

একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে যে ‘স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক জন্মজন্মান্তরের’। ইংরেজিতেও বলা হয় ‘ম্যারেজ ইজ মেড ইন হেভেন’। এগুলো যার যার বিশ্বাসের ব্যাপার। তবে সাদা চোখে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কখনোই চিরায়ত নয়। দুজন নরনারী এক ঘরে, এক ছাদের নিচে বাস করে সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার বলে। যে দম্পতির মধ্যে যত ভালো বোঝাপড়া, সেই দম্পতি তত সুখী।

সম্প্রতি এক বিয়েতে গিয়ে সেখানকার অনুষ্ঠানের ধরন দেখে এ নিয়ে লেখার ইচ্ছা জাগল। মনে হলো আমাদের সমাজে বিয়ের যেসব নিয়ম অনুসরণ করা হয়, তার কতগুলো ইসলামের বিধানে পড়ে? আমি জানি না, অন্য কেউ জানেন কিনা জানি না। অতি আধুনিকতার নামে মুসলিম পরিবারেও বিয়েতে কুসংস্কার ঢুকে পড়েছে। আধুনিকতার নামে চলছে অপচয় ও অশ্লীলতা।

যেমন শুরুতেই ধরা যাক, পানচিনি কিংবা আক্দ। আমাদের সমাজে দু পরিবারের মতামতের ভিত্তিতে বিয়ের সিদ্ধান্তে উপনীত হলে দেখা যায় কত আয়োজন। শুরু হয় অপচয়ের পালা। যেমন ধরুন সমাজের এক শ্রেণির লোক পানচিনি অনুষ্ঠানে যতটুকু আয়োজন করেন মনে হয় ছোটখাটো একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। ১০০ থেকে ২০০ জনের খানাপিনার ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য আরও কত কী থাকে সে আয়োজনে। ‘আক্দ’ অনুষ্ঠানেও দেখা যায় বিশাল আয়োজন। এগুলোকে অপচয়ের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় বলেও মনে করি আমি। অথচ এ দুটি অনুষ্ঠানই পারিবারিক পরিসরে সুন্দরভাবে করা যায়।

বিয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কাবিন। এই বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবায়। আমাদের দেশে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম হলেও ৮৫ শতাংশই কাবিন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখে না। ইসলামিক তরিকায় বিয়ে করতে হলে আগে দেনমোহর, তালাক, স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞান নিয়ে তবেই করা উচিত। দেখা যায়, আমাদের সমাজে অনেক ছেলেই, সে মধ্যবিত্ত হোক, বা নিম্নবিত্ত হোক, সেও দেখা যায় পাঁচ লাখ টাকার কাবিন করে ফেলে। অথচ তার কাছে হয়তো ৫০ হাজার টাকাও নেই। কিন্তু কেন? লোক দেখানো সমাজে টাকার অঙ্কটাই প্রাধান্য পায় বলেই এমনটা হয়। তবে এটি সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছেলে পক্ষের সামর্থ্য না থাকলেও কাবিন বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সমাজকে দেখানোর জন্য।

আবার ধরুন বিয়ের দাওয়াতপত্র বা বিয়ের কার্ডেও দেখা যায় ভিন্নতা। কারুকাজ বা বিভিন্ন স্টাইলে কার্ড যে কেউ বানাতেই পারেন। কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, কার্ডে ইংরেজি এড়ানো প্রয়োজন। যেহেতু আমাদের সব আত্মীয়-বন্ধুই হয়তো ভালো ইংরেজি জানেন না। এ ক্ষেত্রে বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবিটিও বিবেচনা করা উচিত। কারণ অনেক মূল্য দিয়ে আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি। নিজেদের ভাষাকে গুরুত্ব না দিলে অন্যরা কেন আমাদের সম্মান করবে।

এবার ধরা যাক গায়েহলুদের কথা। বিয়েতে গায়েহলুদ অনুষ্ঠান প্রতিটি মুসলিম পরিবারেই কমবেশি হয়। কনের শরীরে হলুদ মাখানো কিংবা বরের গায়েহলুদ মাখানো অনুষ্ঠান অনেক জমকালোভাবে আমাদের সমাজে হয়ে থাকে। গানের শিল্পী আনা হয় গানবাজনা, নাচ, খাওয়া-দাওয়া কত কী হয়। প্রশ্ন হলো কোথা থেকে এল এসব? এসব অনুষ্ঠান করে কি কোনো উপকার হয়।

বিয়ের দিন দেখা যায় দু-চার হাজার লোক খাওয়ানো হচ্ছে। নানা আসবাবপত্র দিয়ে বিত্তশালীরা মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন। কথা হলো এত বিশাল আয়োজনের দরকার কী? মুখেই শুধু বলা হয় আমরা মেয়ে চাই কোনো কিছু চাই না কিন্তু। আদতে মনে মনে ঠিকই আশা করেন ছেলের বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে অনেক কিছু আসবে। এটা যেন এক অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে।

বিয়েতে ফটোসেশন করাটা এখন হালফ্যাশন। আজকাল বিয়ে বাড়িতে কনেদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা মডেলিং স্টাইলে ছবি তোলা হয়। এসব দেখলে মনে হয় কনেরা কনে নন, তাঁরা মডেল, আর আমরা দর্শক। বিয়ের পর দিন জামাই বাজার থেকে বড় মাছ কিনে আনে। বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ানো হয় আত্মীয়দের। সে অনুষ্ঠানের নামও আছে আমাদের সমাজে ‘মাছ-ভাত’। সেটা অবশ্য নতুন বউয়ের হাতে রান্না খাওয়ার একটা কৌশল। এ উপলক্ষে বরের পকেট থেকে কিছু টাকা খসানোটাই লক্ষ্য থাকে।

অবশেষে বলতে চাই আমরা মানুষেরা সমাজকে দিনে দিনে কঠিন করে তুলছি। বিয়েকে একটি ব্যবসায়িক বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছি। বিয়ে মানে অপচয় নয়, না কোনো বাহাদুরি। আমরা কি এ থেকে বের হতে পারি না? সবই সম্ভব শুধু দরকার ইচ্ছাশক্তি।