২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিশ্বভ্রমণে নাজমুনের নতুন রেকর্ড

গুয়াতেমালার একটি দর্শনীয় স্থানে বাংলাদেশি পতাকা মোড়ানো নাজমুন নাহার
গুয়াতেমালার একটি দর্শনীয় স্থানে বাংলাদেশি পতাকা মোড়ানো নাজমুন নাহার

বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া বাংলাদেশি তরুণী নাজমুন নাহার এখন গেছেন নিকারাগুয়ার লেওন শহরে অবস্থান করছেন। ১৯ সেপ্টেম্বর নিকারাগুয়ার সময় সকাল দশটায় সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তাঁর এই ভ্রমণ যাত্রা কতটা দুর্লভ, দুর্দান্ত, দুর্বিষহ, কতটা আকস্মিক ও ঘটনাবহুল, তিনি কী কী করেন, কী খাওয়া-দাওয়া করেন, কোথায় ঘুমান—তা দেখার জন্যই আমি উত্তর আমেরিকা থেকে তার পথকে প্রতিদিন অনুসরণ করেছিলাম।
সম্প্রতি নাসাউ কলোসিয়ামের ফোবানা সম্মেলনে নাজমুনকে সম্মানিত করা হয়েছিল ‘মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড’ ও ইয়ুথ কনফারেন্সে ‘গ্লোব অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে। এ ছাড়া এ বছর তিনি পেয়েছেন অনন্যা অ্যাওয়ার্ড, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড, জন্টা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, রেড ক্রিসেন্ট মোটিভেশনাল অ্যাওয়ার্ড। তিনি শিরোনাম হয়েছেন দেশি-বিদেশি বহু গণমাধ্যমের, তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক তথ্যচিত্র, ভিডিও ডকুমেন্টারি। তিনি কেবল বাংলাদেশের পতাকা বুকে নিয়ে বিভোর নতুন নতুন সীমানা জয়ের স্বপ্ন পূরণে। তাঁর একটাই স্বপ্ন পৃথিবীর প্রতিটা দেশে তার এই লাল সবুজের পতাকা উড়ানো।
নিউইয়র্ক ভ্রমণের সময় ২৯ আগস্ট প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা অফিসে নাজমুনের সঙ্গে প্রথম দেখা এবং পরিচয়। ১১ সেপ্টেম্বর তিনি গুয়াতেমালায় ঠিকমতো পৌঁছেছেন কিনা, যাত্রাপথে কী কী হলো তা জানার জন্য আমি তাঁকে ভিডিও কল দিয়েছিলাম রাত দেড়টায়। কী দুর্দান্ত! রক্তমাখা হাত আর শরীর নিয়ে তিনি আমাকে হাসিমুখে সব ঘটনার বর্ণনা করছিলেন। তাঁকে দেখে আমার চোখের কোনে পানি জমেছিল, একটা মানুষের ভেতর কতটা মানসিক শক্তি থাকলে তিনি অচেনা গুয়েতেমালার রাস্তায় সব প্রতিকূলতাকে ভেদ করে বেঁচে এসেছেন, তার বর্ণনা শুনে আমি আঁতকে উঠেছিলাম। এ নিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে তিনি পাঁচবার বেঁচে এসেছেন। একটি মেয়ে যে কতটা দুর্দান্তভাবে নিজের সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে পৃথিবীর পথে-পথে দিনে-রাতে সবকিছু মোকাবিলা করছেন, তা তার এই মধ্য আমেরিকার সফরকে অনুসরণ না করলে কখনোই জানা হতো না।
মধ্য আমেরিকার দেশগুলো অনিরাপদ জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তাদের প্রকৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস অপূর্ব। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা হাতে নেমে পড়েছিলেন নাজমুন নাহার। মধ্য আমেরিকায় তার যাত্রা বহুদূর। এখনো অনেক সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে তাকে।
নাজমুন নাহার এবার ভ্রমণ শুরু করেছিলেন গুয়াতেমালা থেকে। ইতিমধ্যে তিনি উত্তর প্যাসিফিক সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে যাওয়া মধ্য আমেরিকার দেশ গুয়াতেমালা থেকে সড়ক পথে এল সালভাদর ও হন্ডুরাস পার হয়ে তাঁর ভ্রমণ অভিযাত্রার ১৩৪তম দেশ নিকারাগুয়ায় পৌঁছেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ১৩৫তম দেশের সীমানা ছুঁবেন কোস্টারিকায়।
কিন্তু নাজমুনের এবারের অভিজ্ঞতা একটু ভিন্নরকম। তাঁর অভিযাত্রার ১৩১তম দেশ গুয়াতেমালার দুর্ধর্ষ ও ভালো লাগার মুহূর্তগুলোর বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। ‘রাত তখন ১০টা। মেক্সিকো থেকে বিমান গুয়াতেমালার আকাশ ভেদ করে লা আরোরা এয়ারপোর্টে এসে নেমেছে। বিমানের জানালা দিয়ে রানওয়ের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম ছোট ছোট পাহাড় ঘিরে আছে আবছা আলো-আঁধারির মাঝে। পেছনে ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে নেমে পড়লাম একটি নতুন দেশের সীমানা ছুঁতে। চোখে তখন আমার ভিন্ন রকম অনুভূতি। প্রতিটা দেশে যাচ্ছি অর্থাৎ আমি পৃথিবীর সঙ্গে দেখা করছি। ভ্রমণের সময় নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, নতুন প্রকৃতিকে দেখা হয়, নতুন কোন শহরে তাদের ইতিহাসকে জানা হয়।’
যেকোনো নতুন দেশে পা রাখলেই এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে যায় সারা পৃথিবী থেকে আসা কত মানুষের সঙ্গে। তেমনি করে মেক্সিকো এয়ারপোর্টে যখন শেষ বোর্ডিং ক্রস করছিলাম, ওই মুহূর্তে লাইনে পরিচয় হয় অস্ট্রিয়া থেকে আসা একজন ট্রাভেলার চারেলের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের অনেক কথা আদান-প্রদান হয়। প্লেনে খুব অল্পসংখ্যক যাত্রী থাকায় চারেল আমার পাশে এসে বসেছিল। গল্প করতে করতে এক ঘণ্টার পথ মেক্সিকো থেকে গুয়েতেমালায় চলে এসেছি। ইমিগ্রেশন করার সময় আমার মাথায় ছিল রাতে হোস্টেলে ফেরার বিষয়টি। গুয়াতেমালার ইমিগ্রেশন ক্রস করে যখন বের হলাম, চারেলকে আর দেখছিলাম না। এর মধ্যে আমরা হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর বিনিময় করেছিলাম প্লেনে বসেই।
ইমিগ্রেশন ক্রস করে এক্সিট পয়েন্ট এসে নেটওয়ার্ক পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এয়ারপোর্টে কিছুতেই ইন্টারনেট ওয়াইফাই কানেক্ট করা গেল না। চারেল বলেছিল, ও যাবে লেক অতীতের সান পেদ্রো টাউনে। চারদিকে অনেক গেট গুয়াতেমালা এয়ারপোর্টে। মনে মনে চারেলকে খুঁজতে থাকলাম, ওকে যদি দেখা যায় কোনভাবে। সে আমাকে বলেছিল, এক্সিট পয়েন্টে আমাদের দেখা হবে।
রাত হয়ে যাবে বলেই আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, গুয়াতেমালার রাজধানীতে এক রাত থাকার। সে অনুযায়ী ডাউন টাউনের এইট্‌থ অ্যাভিনিউর ক্যাপসুল হোস্টেলে একটি বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। এর মধ্যে রাত এগারোটা বেজে গেছে। আসার আগে এ শহর নিয়ে যেটুকু পড়াশোনা করেছি, তাতে বুঝতে পেরেছিলাম শহরে নিরাপত্তার কিছুটা সমস্যা আছে। নিরাপদে এয়ারপোর্ট থেকে হোস্টেল পর্যন্ত পৌঁছানোর পরামর্শ নিতে গেলাম টুরিস্ট ইনফরমেশন পয়েন্টে।
নাজমুন বলল, হঠাৎ করে পেছন থেকে একজন এসে হ্যালো বলল আমাকে। হ্যালো বলে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ? পেছনে তার ব্যাকপ্যাক, বাদামি রঙের চুল, পাশে ক্যামেরার ব্যাগ ঝোলানো। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, সে আমারই মতো একজন অভিযাত্রী। হাত বাড়িয়ে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে হাসিমুখে বলল, তার নাম ব্রানিয়ো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোন হোস্টেলে থাকবে। ব্রানিয়ো বলল, সে তখনো কোন হোস্টেল বুকিং দেয়নি। আমার হোস্টেলের নাম ঠিকানা জেনে তৎক্ষণাৎ সে সিদ্ধান্ত নিল একই হোস্টেলে উঠবে। যাই হোক, তার সিদ্ধান্তে আমি মনে মনে খুশিই হলাম। ব্রানিয়ো একটা উবার কল করল। আমরা গুয়াতেমালা সিটির ডাউন টাউনের জোন ওয়ানের দিকে রওনা হলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে হোস্টেল পর্যন্ত ৩০ মিনিটের পথ। রাতের অপূর্ব দৃশ্য স্প্যানিশ কলোনিয়াল গুয়াতেমালা সিটিকে মনে হচ্ছিল ২০০ বছর আগের পুরোনো ঐতিহাসিক এক রূপসী নগরী। একটু ভাঙা ভাঙা কোথাও কোথাও, পুরোনো স্প্যানিশ আভিজাত্যের ভাব আছে প্রতিটি ভবনে। শহরের রাস্তাগুলো একটু পুরোনো হলেও অনেক পরিচ্ছন্ন। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো ছড়ানো শহরটিকে এক অপরূপ রাজ্য মনে হচ্ছিল। আমি গাড়ির জানালা খুলে নতুন দেশের একটু হিম হিম বাতাস নিচ্ছিলাম। এই শহরের বাতাসের দোলে ক্লান্তিটা কেটে উঠল নিমেষেই।
নাজমুন বলেন, ১৭ নম্বর ক্যাপসুল হোস্টেলে আমরা চলে এলাম। রিসেপশনে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের হোস্টেলের ভেতরে কোন রেস্টুরেন্ট আছে কিনা, ছেলেটি বলল নেই। ছেলেটিকে আমি বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত রাতে আমাদের বাইরে খেতে যাওয়া নিরাপদ হবে কিনা। ছেলেটি বলল, রেস্টুরেন্টটি মাত্র তিন ব্লক পরেই, কোন সমস্যা হবে না।
নিউইয়র্ক থেকে আমাকে ১৪ ঘণ্টার জার্নি করে আসতে হয়েছিল গুয়েতেমালায়। মেক্সিকো সিটি এয়ারপোর্টে একটা বার্গার ছাড়া আর কোনো কিছুই খাওয়ার সুযোগ হয়নি। ব্রানিয়ো এসেছিল কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে। ও বারবার বলছিল, ওর অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। আমরা হোস্টেলে ব্যাকপ্যাক রেখেই খেতে রওনা হলাম। ব্রানিয়ো অনেক মজার মজার কথা বলে, ছেলেটি ফুটবলার। খেলার কথা, বিভিন্ন দেশের গল্প একের পর এক বলেই যাচ্ছিল। এর মধ্যে আমার গল্পও শুনছিল। ম্যাপ দেখে দেখে আমরা রেস্টুরেন্টে গেলাম। প্রত্যেকে ছয় ডলারের মধ্যেই আমরা খেলাম ব্রেড, বিন্স আর সালাদ।
দ্রুত খেয়ে আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম, তখন রাত পৌনে একটা। আমি আর ব্রানিয়ো জোন ওয়ানের ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। ব্রানিয়োর বাম হাতে মোবাইলটি ধরে ম্যাপ দেখে দেখে হাঁটতে থাকলাম হোস্টেলের দিকে। এর মধ্যে গল্পও চলছিল আমাদের। হাঁটার সময় আমি চোখ রাখছি ডানে-বামে, সামনে-পেছনে। আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, এই নগরীর নিরাপত্তাহীনতার কথা। এক ব্লক যাওয়ার পর হঠাৎ দেখলাম, সামনে থেকে দুটি ছেলে আমাদের দিকে একই ফুটপাত ধরে আসছে। দূর থেকে ছেলে দুটিকে দেখে আমার খুব একটা ভালো মনে হচ্ছিল না। ওরা যেন আমাদের পাশাপাশি ফুটপাত ক্রস করতে না পারে, সে জন্য আমি ব্রানিয়োকে বললাম ফুটপাত থেকে মেইন রাস্তায় নামতে। আমরা মেইন রোড ক্রস করে ডান দিকের ফুটপাতে উঠার আগেই আমি যা আশঙ্কা করছিলাম, তাই হলো। পেছন থেকে ছেলে দুটি ছুরি হাতে আমাদের সামনে এসে পড়ল।
আমার হাতে একটা পানির বোতল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। জিন্সের পকেটে ছিল মাত্র ৫০ ডলারের একটি নোট, জিন্সের জ্যাকেটের পকেটে ছিল মোবাইল আর ভিসা কার্ডগুলো। একজন ছুরি দেখিয়ে ব্রানিয়োর হাতে থাকা মোবাইলটি বারবার ধরার চেষ্টা করছে। আর স্প্যানিশ ভাষায় কিছু একটা বলছিল। আরেকজন আমার সামনে ছুরি ধরে আছে, ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় কিছু একটা বলছে। এই বিপদে কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, আমি সেই চেষ্টা করতে থাকলাম। মা সব সময় আমাকে বলেছিল, কখনো এমন বিপদে পড়লে ভেবে নিয়ো জিনিসের থেকে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু কোন কিছু ভাবার আগেই ব্রানিয়ো তার বাম হাত দিয়ে আমাকে ছুরির আঘাত থেকে বাঁচার জন্য ধাক্কা দিল। সে তার ফুটবল খেলার কারিশমাকে কাজে লাগাল। আমি নিজেকে রক্ষার জন্য সামনে একটু এগোতে গিয়ে পড়ে গেলাম। আমার ডান হাতের তালুতে ঢুকে পড়ল ছোট্ট একটি পাথর কণা। বৃদ্ধাঙ্গুলির পাশে মাংসগুলো চরমভাবে থেঁতলে গেল। একই অবস্থা হলো বাম হাতের তালুতে। আর দুই হাঁটুর মধ্যে বাম হাঁটুতে চরমভাবে জখম হয়ে জিন্সের আবরণ ভেদ করে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। ডান হাতের তালু থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে কবজি বেয়ে পড়েছিল রক্ত।
উঠেই চোখের সামনে দেখতে পেলাম ছেলেটিকে, তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকালাম। আমি তখন প্রস্তুত রক্তমাখা শরীর নিয়ে ওর দিকে টাকা-পয়সা বাড়িয়ে দেওয়ার। দেখতে পেলাম, ছেলেটির হাতে থাকা ছুরিটি আর আমার দিকে তাক করা নয়, ডান হাতে নিচের দিকে ধরা। আমার কাছে ডলারও চাচ্ছে না। এর মধ্যে ব্রানিয়ো দৌড়ে আমার পাশে এসে আমাকে ধরে বলল, আর ইউ ওকে? আর ইউ ওকে?
আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে আমাদের কাছে যা ডলার আছে, ওদের দিয়ে দিতে বললাম। আমি জিন্সের পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করছি, এর মধ্যে দেখি ছেলে দুটি পেছনের দিকে হাঁটা দিয়েছে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আর ভাবছিলেন তাহলে কী আমার পড়ে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়ানো রক্তাক্ত শরীর দেখে ওরা ফিরে গেল‌! এমন ঘটনার মুখোমুখি এই প্রথম, কোন মানুষের ছুরির আঘাতের সামনে পড়ে বেঁচে যাওয়া। ব্রানিয়ো কোনোভাবেই তার মোবাইল দিতে চাইল না। কিন্তু এভাবে টাকা, মোবাইল রক্ষা করার জন্য ছুরির সঙ্গে লড়াটা আমার পছন্দ নয়, ওই কয়েকটি ডলার আর মোবাইল থেকে জীবনের মূল্য লক্ষ কোটি গুণ বেশি।
রাত তখন দেড়টা, আমরা দ্বিতীয় ব্লকের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। ব্রানিয়োকে আমি বারবার বলছিলাম, আমি হাঁটতে পারব, তারপরও কোনভাবেই সে আমাকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিল না। ও বারবার ভয় পাচ্ছিল, আমি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে যদি পড়ে যাই। ব্রানিয়ো হয়তো জানে না, আমি কতবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছি। মনের দিক থেকে আমি কতটা শক্ত, ও তখনো টের পায়নি। তখনো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কী মনে করে ছেলে দুটি ফিরে গেল। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েই ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলাম। আমার রক্তাক্ত শরীর নিয়ে আমি কীভাবে হোস্টেলে পৌঁছাব, তাই ভাবতে ভাবতে বুঝতে পারলাম শরীরটা ভারী হয়ে আসছে। ডান হাতের তালুতে কিছু একটা খোঁচা দিচ্ছিল। আমি বুঝতে পারলাম ছোট্ট পাথর কণাটি এখনো বের হয়নি। ডান হাতের তালু থেকে চামড়ার ভেতরে গুঁজে যাওয়া ছোট্ট পাথর কণাটি টান দিয়ে বের করলাম।
হোস্টেলের হলরুমে ঢুকে ব্রানিয়ো আমাকে একটা সোফায় বসিয়ে দিল। সেখানে বসে ক্ষেত বরফ দিলাম। সোফায় বসে আমি ব্রানিয়োকে ম্যাপটা বের করতে বললাম। আগামীকাল গুয়াতেমালা সিটির দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার পরিকল্পনা করে ফেললাম ম্যাপ দেখে। তারপর আমাকে ফিমেল ডরমিটরির রুমের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে সে ঘুমাতে গেল তার রুমে। ঘুমানোর সময় ক্যালিফোর্নিয়াতে আমি ফোন দিয়েছিলাম আমার বন্ধু ডাক্তার লুসিকে। ভিডিও চ্যাটে লুসিকে আমার শরীরের অবস্থা জানালাম। সবকিছু দেখে সে আমাকে আশ্বস্ত করল। আমি ক্ষত জায়গাগুলো পরিষ্কার করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ব্রানিয়ো গুড মর্নিং বলে আমাকে ঘুম থেকে জাগাল। আমার শরীরে ব্যথা যেন বেড়ে গেল। আমাকে বলল, সব ঠিক আছে কিনা। শরীরে ব্যথা নিয়ে আজকে গুয়াতেমালা সিটি দেখতে হবে। অনেক কষ্ট করে আমি রেডি হলাম। মোবাইলে বাটন চেপে কাউকে যে ফোন দেব, তাতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল। আমার পাশের বেডে ঘুমিয়ে ছিল জার্মানির এক মেয়ে। ওর সঙ্গে একটু কথা হচ্ছিল। এর মাঝে সে জানতে পারল আমাদের গত রাতের ঘটনা। ভোরের সুন্দর সকাল আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ আমাকে ভিন্ন ভালো লাগার অনুভূতি দিল।
হোস্টেলটি বেশ সাজানো-গোছানো। হোস্টেলের দেয়ালে বিভিন্ন ইনস্পিরেশনাল কথা লেখা, সুন্দর সুন্দর চিত্র আঁকা। আমি ব্রানিয়ো আর জার্মান গার্ল একসঙ্গে নাশতার টেবিলে বসে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। মেয়েটি আমাদের ঘটনা শুনে একটু আঁতকে উঠল। তারপর আমরা গুয়াতেমালা সিটি দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় রাস্তায় প্রচুর লোকজন দেখে অবাক হলাম, রাতের শূন্য রাস্তা আর দিনের জনমানবময় এই শহরকে মেলাতে পারছিলাম না। রাস্তার কোণে কোণে প্রচুর পুলিশ। ভাবলাম এই পুলিশরা রাতে কি ঘুমাচ্ছিল? কিছু দূর হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম, রাস্তার কোণে কোণে গান হচ্ছে, মিউজিক, বক্তৃতা, খাবারের দোকান, বইয়ের দোকান—কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব। এর মধ্যেই গুগল সার্চ করে দেখা গেল, দুদিন পরেই তাদের স্বাধীনতা উৎসব। তার জন্যই আগে থেকেই তারা উৎসব পালন করছে।
আমরা মেইন স্কয়ারে গিয়ে দেখতে পেলাম, কয়েক শ মানুষের মিলনমেলা। মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, ওয়েলকাম জানাচ্ছে। কিছু কিছু টুরিষ্টও দেখা গেল। ব্যথাযুক্ত পা নিয়ে আমি আর ব্রানিয়ো শহরে ঘুরে বেড়ালাম, একসঙ্গে খেলাম দুপুরে। পরে আমরা গুয়াতেমালা শহর ছেড়ে এন্টিগুয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শহর ছেড়ে যেতেই পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম এন্টিগুয়া শহরে। এই শহরের ভিন্ন চিত্র আমাকে ভুলিয়ে দিল গুয়াতেমালা সিটির সব ঘটনা।
কী অপূর্ব এন্টিগুয়া। চারদিকে অনেক উঁচু পাহাড় ঘেরা শহরটি পুরোনো স্প্যানিশ উপনিবেশ, শত শত টুরিস্ট রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, পাথর দিয়ে বানানো রাস্তাগুলো অনেক সুন্দর। এ যেন ভিন্ন চিত্র অ্যান্টিগুয়ায়। সবাই বলছে, টুরিস্টিক বলে এই শহরটি অনেক নিরাপদ। রাতে-দিনে প্রচুর পুলিশি পাহারা। দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম পারপাস হোস্টেলে। পরদিন এন্টিগুয়া শহরে সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কী সুন্দর শহর! গুয়াতেমালা দেশটিকে আমি নতুন করে চিনতে চেয়েছিলাম। ভলকানিক মাউন্টেন, লেক আতিত, আশপাশের সব পাহাড়গুলো দেখব বলে প্ল্যান করছিলাম। হোস্টেলের সামনে দিয়ে দেখতে পারছিলাম হাজার-হাজার বাচ্চারা মিউজিক করতে করতে শহরের মেইন স্কয়ারের দিকে যাচ্ছিল। আমার ঘুম ভাঙল ওদের গান-বাজনার শব্দে। ঘুম থেকে জেগে দেখি, আমার জন্য একটা ছোট্ট চিরকুটে কয়েকটি কথা লেখা।
রিসেপশনে পরিচয় হয়েছিল গুয়াতেমালার মেয়েটির সঙ্গে। ব্রানিয়োর সঙ্গে ওদের অনেকক্ষণ কথা হয়। মেয়েটি জানতে পারে আমাদের অবস্থার কথা। রাতেই সে আমাকে কিছু মেডিসিন দিয়েছিল। যাওয়ার সময় এই চিরকুটটি আমার জন্য রেখে গিয়েছিল রিসেপশনে। তার মধ্যে লেখা—আমার ১৩১তম দেশ ভ্রমণের সময় তাদের দেশে এসে এমন দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করল।
নাজমুন এন্টিগুয়া শহরের বিভিন্ন পাহাড়ে গেছেন, তাদের ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়েছেন, সেখানকার মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছেন। লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন গুয়াতেমালার আনাচে-কানাচে। তার স্বপ্ন পূরণ হোক বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা হাতে। তার পায়ের চিহ্ন পড়ুক এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। আমাদের বাংলাদেশকে নিয়ে যাক আরও অনেক উচ্চতায়।