৩৩তম ফোবানা সম্মেলন, অতিথিদের প্রতিক্রিয়া
৩৩তম ফোবানা কনভেনশন ২০১৯ শুরু হয়েছিল ‘আমাদের সন্তান-আমাদের অহংকার’ এই স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে। এ কারণে নতুন প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি রহমান ও তাওহিদ প্রান্তকে দিয়ে উদ্বোধন করা হলো তিন দিনব্যাপী ফোবানা সম্মেলন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কনভেনশনের আহ্বায়ক নার্গিস আহমেদ প্রিয় মাতৃভূমির ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন ও মহিমান্বিত রাখতে সব ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
জার্মানি, কানাডা ও আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে ৭৬টি সংগঠনের অসংখ্য প্রতিনিধির উপস্থিতিতে গত ৩০ আগস্ট রাতে লং আইল্যান্ডে নাসাউ কলিসিয়াম সংলগ্ন ম্যারিয়ট হোটেলের বলরুমে শুরু হয় ফোবানা কনভেনশন। পরবর্তী দুদিনের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয় ১৭ হাজার দর্শকের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন নাসাউ কলিসিয়ামের অডিটোরিয়ামে।
কনভেনশন কমিটির সদস্যসচিব আবির আলমগীরের উপস্থাপনায় উদ্বোধনী পর্বে তহবিল গড়তে সহায়তাকারী ১২ জন ফোবানা আইকনকে বিশেষ সম্মান জানানো হয়।
আয়োজকেরা জানান, কনভেনশনের শেষ দুদিনের জন্য নাসাউ কলিসিয়ামের ভাড়া হচ্ছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ডলার। এর পুরোটাই এসেছে আইকনদের দেওয়া শুভেচ্ছা তহবিল থেকে।
সম্মেলনে আটটি সেমিনারে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সেমিনারে সমন্বয় করছেন আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ফাইজুল ইসলাম। এ ছাড়া সম্মেলনে মেধাবী ১০ ছাত্রকে বৃত্তি দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় আগত বিশেষ অতিথিদের সঙ্গে। ফোবানা নিয়ে তাঁরা জানিয়েছেন তাঁদের প্রতিক্রিয়া—
জার্মান প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক নাজমুন নেসা পিয়ারি বলেন, পরবাসে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য এবং নতুন প্রজন্মকে তার শেকড়ের সন্ধান দেওয়ার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে ফোবানার সদস্যরা। এবার ফোবানা কমিটি থেকে আমাকে ‘ফোবানা পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে। ভালোবাসি ফোবানাকে—ফোবানার দীর্ঘ পথচলা সফল হোক।
লেখক ও চিকিৎসক তিতাশ মাহমুদ বলেছেন, এবার নিউইয়র্কে ফোবানা রুচিমান, আধুনিক ও সংস্কৃতমনা কিছু মানুষের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগে বেশ কয়েকবার বঙ্গমেলা ও বঙ্গ সম্মেলনে গিয়েছি। ফোবানায় এসে অন্য দুই সম্মেলনের মতো নিজেকে একবারও ‘সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন’ মনে হয়নি। বরং আমি অত্যন্ত উৎসব মুখর আমার জন্মভূমি বাংলাদেশকে পেয়েছি। এত দিন পরদেশে আছি, এক সঙ্গে এত বন্ধু আমি আর কোথাও পাইনি।
টরন্টো প্রবাসী কবি ও আবৃত্তি শিল্পী হোসনে আরা জেমী বলেন, ‘ফোবানায় এবারই আমার প্রথম অংশ নেওয়া।
কবি সমাবেশে নর্থ আমেরিকাসহ বাংলাদেশ থেকে আসা কবিদের সঙ্গে কবিতা পড়েছি। খুব ভালো লেগেছে। ভবিষ্যতে ফোবানার সার্বিক উন্নতি কামনা করছি।’
নিউজার্সি থেকে আসা শতদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ফোবানার নির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ কবীর কিরণের নেতৃত্বে পরিবেশিত মনোজ্ঞ কবিতা আবৃতি এবং দেশাত্মবোধক সংগীত দর্শকদের মন জয় করেছে। কবির কিরণ বলেন, তিনি নিজেকে ফোবানার একজন প্রকৃত বন্ধু মনে করেন।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা লেখক ও সংগঠক মৃদুল রাহমান বলেন, কবি সম্মেলন ও কাব্য জলসা জমজমাট ছিল। বিশাল মিলনায়তন অথচ উপস্থিতি কম থাকায় অন্যান্য আয়োজনে প্রাণের সঞ্চার কম ছিল। দর্শক, শ্রোতা ও সাধারণ উপস্থিতির চেয়ে স্পনসরদের প্রতি আয়োজকদের জামাই আদর ছিল চোখে পড়ার মতো।
গবেষক বিলকিস রহমান বলেন, এই আয়োজনে সবচেয়ে বড় অর্জন নতুন প্রজন্মের শিশু, কিশোর ও তরুণদের উপস্থিতি। এত বড় হলে মানুষের উপস্থিতি কম মনে হয়েছে, কিন্তু যারা এসেছেন তাঁরা খুব আনন্দ করেছেন।
পতাকা কন্যা নাজমুন নাহার বলেন, এবারের ৩৩তম ফোবানা সম্মেলন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমি বাংলাদেশের পতাকাকে পৃথিবীর ১৩০টি দেশে পৌঁছে দিয়েছি। ‘মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড’ এর মাধ্যমে তার স্বীকৃতি আমাকে দিয়েছে ফোবানা। আমি
সাধুবাদ জানাই নার্গিস আহমেদের মতো একজন ভালো সংগঠককে। যিনি বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আমেরিকার মাটিতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।
আবৃত্তি শিল্পী তাহরীনা পারভীন বলেন, ৩৩তম ফোবানায় আমার প্রাপ্তি অনেক। প্রায় ৫০ জন আবৃত্তি শিল্পী একসঙ্গে বসে আবৃত্তি করেছি, আড্ডা দিয়েছি। এটা আমার অনেক বড় পাওয়া।
নিউইয়র্ক সিটির বোর্ড অব এডুকেশনের এডুকেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যানি ফেরদৌসের অভিমত, যেকোনো মহৎ আয়োজনকে পণ্ড করে দেওয়া জন্য বাংলাদেশিরা বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে যায়, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আয়োজক সংগঠককে যদি এই সব অপ্রীতিকর বিপত্তির মুখে পড়তে না হতো তাহলে নিশ্চয়ই সম্মেলনের সফলতা শতভাগ হতো।
ছড়াকার মনজুর কাদের বলেন, এই প্রথমবারের মতো দেশ বিদেশের কবি ও আবৃত্তি শিল্পীদের এক ছাতার নিচে এনে এক পরম সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছে ড্রামা সার্কেল।
লেখক ও সংগঠক মাসুম আহমেদ বলেন, এত পয়সা খরচ করে এই দুটো খণ্ডিত সম্মেলন করে আমাদের বাঙালি কমিউনিটি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লাভটা কী হয়েছে? অথচ নিউইয়র্কে ছোট একটা অনুষ্ঠান করতে গেলে জায়গা পাওয়া যায় না। অনুষ্ঠান করার জন্য নিজস্ব কোনো জায়গাও নেই। আমাদের কমিউনিটির জন্য একটা ভবন কি করা যায় না? যেখানে একটা ছোট অডিটোরিয়াম থাকবে, একটা লাইব্রেরি থাকবে, একটা কনফারেন্স হল থাকবে, একটা বাংলা স্কুল থাকবে? অবশ্যই এটা করা যায়। এসব সম্মেলন যারা করে তারা যদি চাইতো তাহলে এত দিনে আমেরিকায় বিভিন্ন শহরে কয়েকটা ভবন করতে পারত। যারা স্পনসর করেন তাঁরা এসব দিকে নজর দিলে ভালো হয়।
সদ্য সমাপ্ত হওয়া ৩৩তম ফোবানা নিয়ে আলাপচারিতায় এ রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়াই দেখা গেছে আগত অতিথি ও অংশগ্রহণকারীদের মাঝে। কেউ কেউ আশাবাদী, কেউ আনন্দিত, কেউবা হতাশ। তবুও গড়পড়তা বিচারে বলা যায়, ফোবানা অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে পরবর্তী যেকোনো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাছে।
সবচেয়ে বড় কথা বাঙালিদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়া, নিজেরা নতুন নতুন দল গড়ার যে ধারা তৈরি হয়েছে, তাতে শুধু নিজেদের মাঝে বিভাজনই বাড়ছে। এটাই বিভক্ত ফোবানা থেকে আমাদের বাঙালি কমিউনিটির শিক্ষা হওয়া উচিত। এমন মনোভাবই ধ্বনিত হয়েছে অনেকের মনে।