ক্রিকেটের অজানা কিছু কথা
এই তো মাত্র ক’দিন হলো ক্রিকেট জ্বর থেমে গেছে। সে জ্বরের খবর সবাই জানে। সুতরাং আমি সে দিকে যাচ্ছি না। মেয়েরা আর ক্রিকেটের কী বোঝে—এই বলে ঠোঁট ওলটাতে পারেন, নাক সিঁটকাতেও পারেন। তবে এও সত্য যে, আমি অনেক কিছুই বুঝি না এবং বুঝতেও চাই না। ছাত্রজীবনে একবার আমার বড় ভাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন চার আর ছক্কা কী, কখন এলবিডব্লিউ হয় ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। একবার ক্রিকেট আনন্দে রোকেয়া হলের সামনে হইচই করার সময় তোলা ছবি অনেকগুলো জাতীয় পত্রিকায় চলে আসায় বকাও দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘তুই ক্রিকেটের কী বুঝিস, যে গেটে গিয়ে নাচানাচি করতে হবে? আমিও ‘তথাস্তু’ বলে তারপর থেকে বেশি বোঝার চেষ্টা করিনি। তারপরও এই হুজুগে জ্বরে আক্রান্ত আমি ইংল্যান্ডের এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা প্রসঙ্গে কিছু তথ্য পেলাম। আরও কিছু তথ্য পেলাম পড়ে। সে সবই তুলে ধরছি এখানে।
মূলত ক্রিকেট খেলার উৎস অজানা। তবে এই খেলাটির উদ্ভব হয় ইংল্যান্ডে। পরে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোসহ অন্যান্য দেশে এ খেলা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে ইংল্যান্ডের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। বহু খেলার উৎপত্তিস্থল এই দেশ। অনেক বিশেষজ্ঞ একমত হয়েছেন যে, সম্ভবত সাসেক্স অথবা নরম্যানদের সময়ে উইল্ডে শিশুরা এই খেলা চালু করেছিল। উইল্ড দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের কেন্ট ও সাসেক্সের মধ্যবর্তী একটি ঘন অরণ্য ও তার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা। ক্রিকেট খেলার সর্বপ্রথম স্পষ্ট উল্লিখিত তারিখ ১৭ জানুয়ারি ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দ; দিনটি ছিল সোমবার।
ক্রিকেটের উৎস সম্বন্ধে রয়েছে আরও অনুমান। অনেকে মনে করেন এ খেলা ফ্রান্স অথবা ফ্লেন্ডার্সে শুরু হয়েছিল। এই অনুমানের ক্ষেত্রে ক্রিকেট খেলার উল্লিখিত তারিখ বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ, ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দ। মনে করা হয় পরবর্তী কালে রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড ‘ক্রিগ’ (ইংরেজি creag) ও অন্যান্য খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। এই ক্রিগকে মনে করা হয় ক্রিকেটেরই একটি পুরোনো শব্দ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রিকেট শব্দটির আদি শব্দ ইংরেজি ‘craic’, যার অর্থ ‘সর্বজনীন মজা ও খেলা’।
ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি বেশ মজার। মনে করা হয়, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রাপ্তবয়স্কদের খেলা হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত বহু প্রজন্ম ধরে ক্রিকেট খেলা শুধু শিশুদের খেলা ছিল। সম্ভবত ক্রিকেট খেলা উদ্ভূত হয়েছিল বোলস খেলা থেকে। যেহেতু বোলস একটু পুরোনো খেলা, তাই মনে করা হয় বলটিকে তার লক্ষ্যের আগে ব্যাটসম্যান ব্যাট দিয়ে একে আঘাত করে দূরে পাঠানো থেকেই ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি। খেলা শুরু হয় মেষ-চারিত কোনো মাঠ বা ফাঁকা জায়গায়। মূল সরঞ্জামের মধ্যে বল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভেড়ার দলা পাকানো পশম বা একটি পাথর অথবা একটি ছোট কাঠের ডেলা। ব্যাট হিসেবে ব্যবহার করা হয় একটি লাঠি বা একটি বাঁকা দণ্ড বা খামারবাড়ির কোনো যন্ত্র। আর উইকেট হিসেবে একটি বসার টুল বা গাছের গোড়ার শিকড় অথবা কোনো দরজা।
‘ক্রিকেট’ নামটির সম্ভাব্য উৎস হিসেবে অনেক শব্দের কথাই ধরা হয়। সর্বপ্রথম স্পষ্ট উল্লেখে এটাকে ক্রেকেট বলা হয়। এমনও হতে পারে, নামটি এসেছে মধ্য ওলন্দাজ ভাষার ‘ক্রিক’ শব্দ থেকে, যার অর্থ দণ্ড; অথবা ক্রিক (ইংরেজি cricc) বা ক্রাইক (ইংরেজি cryce) থেকে, যার অর্থ পঙ্গু লোকের ব্যবহৃত লাঠি বা ছড়ি। অথবা ফরাসি ভাষা ক্রিকোয়েট (ইংরেজি criquet) থেকে, যার অর্থ কাঠের থাম। এ ছাড়া মধ্য ওলন্দাজ শব্দ ‘ক্রিকস্টোয়েল’-এর (ইংরেজি krickstoel) কথাও বলা হয়, যার অর্থ নিচু বসার টুল, যা গির্জায় নতজানু হওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি অনেকটা শুরুর দিকের ক্রিকেটে ব্যবহৃত উইকেটের মতো দেখতে, যেখানে দুটি স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো।
যত দূর জানা যায়, এ খেলা শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতকের শেষদিকে। মূলত দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে শুরু হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি ইংল্যান্ডের জাতীয় খেলায় পরিণত হয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৪৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হলেও ইতিহাস স্বীকৃত টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ খেলা শুরু হয় ১৮৭৭ সালে। দর্শক সংখ্যার দিক দিয়ে ফুটবলের পর ক্রিকেট বিশ্বের দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা। এই খেলার বিশ্বব্যাপী প্রশাসনের দায়িত্বে আছে শতাধিক সদস্যবিশিষ্ট সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। যদিও এর মধ্যে মাত্র দশটি সদস্য দেশই টেস্ট ক্রিকেট খেলে।
ক্রিকেট একটি দলীয় খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েক শ বছর ধরে। এর আধুনিক রূপের সূত্রপাত হয় ইংল্যান্ড ও কমনওয়েলথ দেশগুলোর মধ্যমে। এ খেলা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায়। এর মধ্যে ইংরেজদের কলোনি গড়ার মাধ্যমে ভারতে সর্বপ্রথম ক্রিকেটের ছোঁয়া লাগে, হিন্দি ছবি ‘লাগান’-এ। এক সময় ভারতই এ খেলা ছড়িয়ে দেয়।
ভারতের উল্লেখযোগ্য ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন সিনিয়র ও জুনিয়র পতৌদি। ভারতের গুরগাঁও জেলার শহর পতৌদির অষ্টম নবাব ছিলেন ইফতিখার আলি খান পতৌদি। তিনি পড়ালেখা করেছিলেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে। তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি ইংল্যান্ড ও ভারত উভয় দলেই খেলেছিলেন। ১৯৩২ সালে ইংল্যান্ডের পক্ষে অভিষেক টেস্টে ১০২ রান করেছিলেন সিনিয়র পতৌদি। ১৯৪৬ সালে ভারতের ইংল্যান্ড সফরে ভারতের জাতীয় দলকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। তবে তাঁর ছেলে মনসুর আলী খান পতৌদি বা পতৌদি জুনিয়রের ক্রিকেটীয় জীবন আরও অনেক বেশি বর্ণাঢ্য ছিল। ডানহাতি ব্যাটসম্যান ও মাঝারি গতির বোলার ছিলেন তিনি। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ভারতের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মোট ৪৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন অসামান্য এ ক্রিকেটার। ১৯৬৯ সালে তখনকার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শর্মিলী ঠাকুরকে বিয়ে করেন তিনি। তাঁদের ছেলে সাইফ আলী খান ও মেয়ে সোহা আলী খান ভারতীয় সিনেমা জগতের পরিচিত দুটি নাম। এক সময় সাইফ আলী খান দাদা-বাবার পথ অনুসরণ করলেও পরে মায়ের পেশাই বেছে নেন।
এ ছাড়া ক্রিকেট ইতিহাসে পিতা-পুত্রের খেলোয়াড়ি অবদানের কথা বলা হলে প্রথমেই চলে আসে অমরনাথ পরিবারের কথা। তাঁরা হলেন লালা অমরনাথ ও মহিন্দর অমরনাথ। ১৯৩৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ভারতীয় হিসেবে অভিষেক টেস্টে শতরান করে অসামান্য কীর্তি গড়েন লালা অমরনাথ। স্বাধীন ভারতের পক্ষে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জয় করেন তিনি। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি মাঝারি গতিতে বলও করতেন তিনি। লালা অমরনাথের তিন ছেলে সুরিন্দর, মহিন্দর ও রাজিন্দর ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে সুরিন্দর ও মহিন্দর অমরনাথ ভারতের জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান সুরিন্দর ১৯৭৬ সালে বাবার মতোই অভিষেক টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে দুজনেই পরে আর কোনো টেস্ট সেঞ্চুরি পাননি। তবে ভারতীয় ক্রিকেটে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন তাঁর আরেক ছেলে মহিন্দর অমরনাথ। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপের তার অসামান্য কীর্তির জন্য এখনো ভারতীয়দের কাছে সুপরিচিত তিনি। ব্যাট হাতে দক্ষ হলেও সেই বিশ্বকাপে বোলিংয়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিলেন মহিন্দর অমরনাথ। সেমিফাইনাল ও ফাইনালে অসামান্য বোলিংয়ের জন্য ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন। পরবর্তী দশকগুলোর জয়ের খবর ও খেলোয়াড়দের ইতিহাস সবারই জানা।
ক্রিকেট রাজকীয় খেলা এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে এই খেলা এখনো সেই রাজকীয় ভাবমূর্তি ধরে রেখেছে। কারণ এ খেলা আমজনতার মধ্যে এখনো তেমন সাধারণ হয়ে ওঠেনি। সে তুলনায় বলা যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ক্রিকেট অনেক বেশি সমাদৃত। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত—সবার কাছে সমানতালে জনপ্রিয় এ খেলা। ইংল্যান্ডের মাটিতে এখনো তা অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পাবলিক স্কুলগুলোতে ক্রিকেট সম্বন্ধীয় কোনো জ্ঞান বিতরণ করা হয় না। বেসরকারি স্কুলে আবার তা সমাদৃত এবং ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়। রাজকীয় খেলা রাজকীয় স্থানে আছে। বিশ্বকাপের খেলা দেখতে টিকিট কেটে আমাদের অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালি যাওয়ার সাহস করলেও প্রকৃত ইউরোপীয়দের মধ্যে নাকি এমন জ্বর তেমন দেখা যায় না বা তারা অবগতও নয়। জয়-পরাজয় দূরে থাক। তারপরও বলতে হয় আইসিসির কাপ যথাযথ স্থানে পৌঁছে গেছে।