
মেসেঞ্জারে সাধারণত যাওয়া হয় না। গত সপ্তাহে আচমকাই মেসেঞ্জারে ঢুকে বশির আহমদ নাম দেখে ওপেন করলাম। বশির আহমদ আমার নাতিন জামাই। পেট্রোবাংলার প্রকৌশলী ছিলেন। এখন থাকেন আটলান্টায়। ভালো লেখেন। পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই তাঁর লেখা পড়ি। একটি ছবি পাঠিয়েছেন। লালপাড় সাদা শাড়ি পরিহিতা এক তরুণী, বগলে ‘জাম্বো’ সাইজ এক ইলিশ, ওপরে লেখা, ‘ইলিশ পাঠালাম। বাজারে আর কষ্ট করে যেতে হবে না। খেয়ে নিয়েন।’ আমি মন্তব্য করলাম, ‘ঘ্রাণে অর্ধ ভোজন। আর দর্শনে?’
বশির আহমদ খুবই রসিক মানুষ। আমার উত্তরে তিনি লিখলেন, ‘ইফ ইউ স্মেল টোয়াইস ইউ আর ফুল। হাফ+হাফ=ফুল। এক্সট্রা বোনাস বাই লুকিং?’ আমি লিখলাম, ‘তা হলে হাওয়া খেয়ে বাঁচা যায়! কী আনন্দ।’ উত্তরে বশির আহমদ এক সিরিজ গিফট পাঠিয়ে দিলেন, দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন রোববার, পয়লা বৈশাখ। সকালে চা-পানের সময় বউমা রুবা স্মরণ করিয়ে দিল, আজ যেন আমি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরি। সবাই মেলায় যাব। আগেই জানতাম, ঘরের সবাই কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে, সাড়ম্বরে বৈশাখ উদ্যাপন করবে। মেয়ে লোপা কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে; স্ত্রী হাসিও। লাল শাড়ি, খোঁপা ইত্যাদি জোগাড় হয়েছে। আমেরিকায় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা হয় না। এখানের আবহাওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। আজ আবহাওয়া ভালো। সর্বোপরি বউমার অনুরোধ। নতুন পাঞ্জাবি বের করে এগিয়ে দিলেন হাসি; পরে নিলাম। বৈশাখী আনন্দে কাউকে অখুশি করতে নেই।
লোপা দুপুরের আগেই বাসায় এসে জানাল তার জা উষা ও ভাশুর মাহবুব রহমান আমাদের সঙ্গে যাবেন। আরও যাবেন ছোট ফুপু (আমার ছোট বোন) সারিকুন। ভালোই হলো, সবাই মিলে বেশ আনন্দ করা যাবে। ছেলে নয়ন লাল পাঞ্জাবি পরল। সে গাড়ি ড্রাইভ করবে। গাড়িতে ওঠার আগে চায়ের টেবিলে আলাপকালে আমেরিকায় বড় হওয়া নয়ন বলল, ‘আমাদের প্রধান দুটি উৎসব-দুই ঈদ এবং আরেকটি বড় উৎসব পয়লা বৈশাখ; ঠিক বলিনি?’ বললাম, ‘ঠিক। ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব, এভাবে দুর্গাপূজা, ক্রিসমাস, বুদ্ধপূর্ণিমা হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আর পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ হচ্ছে সকলের উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব বাঙালির উৎসব। এই যেমন ধরো, আমেরিকার থ্যাংকস গিভিং। এটা খ্রিষ্টান, ইহুদি বা মুসলিম কোনো ধর্মের উৎসব নয়, সব আমেরিকানের উৎসব। আদি-অভিবাসী, সাদা-কালো, স্প্যানিশ-ইউরোপিয়ান, আফ্রিকান-এশিয়ান নির্বিশেষে সব আমেরিকান থ্যাংকস গিভিং পালন করে। পয়লা বৈশাখও বাঙালির জন্য তেমন।’
নয়ন মাথা নাড়ল। আমরা রওনা হলাম। জ্যামাইকা থেকে উডহ্যাভেন, উডহ্যাভেন থেকে মাহবুব রহমান ও উষাকে নিয়ে জ্যাকসন হাইটস। রোববার হলেও জ্যাকসন হাইটসের দৃশ্য ভিন্ন; প্রচণ্ড ট্রাফিক। বিভিন্ন রাস্তা রঙিন, লালে লাল। লাল শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরা বাঙালি নারী-পুরুষের ঢল। এ এক অপরূপ দৃশ্য। এমনটি গত তিরিশ বছরে আমেরিকায় কখনো দেখিনি। ৩৪ অ্যাভিনিউয়ে উদীচী স্কুলের সামনে আমাদের নামিয়ে দিয়ে লোপা-নয়ন-রুবা চলে গেল উডসাইড থেকে তাদের ছোট ফুপুকে নিয়ে আসতে। স্কুলের ভেতরে ঢুকে দেখি লোকে লোকারণ্য। পাশে এক টেবিলে বসে আছেন সংগীতজ্ঞ মুত্তালিব বিশ্বাস, হাতের ইশারায় ডাকলেন। কুশল বিনিময়ের পর বললাম, ‘৬৯ স্কুলে বৈশাখী উৎসবে আপনার প্রধান অতিথির বক্তব্য পড়লাম, “আমরা চেহারা ও মনে প্রাণে বাঙালি...বাঙালিয়ানার টানে দেশ থেকে এত দূরে এত বর্ণাঢ্য মেলার আয়োজন করতে পারি...।’’ বললেন, ‘তৃপ্তি পাইনি, শনিবার অল্প কয়েকজনকে নিয়ে অগোছালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।’
এগিয়ে এলেন উদীচীর সুব্রত বিশ্বাস। আমি লেট। যে কারণে দুটি জিনিস মিস করেছি। এক, মঙ্গল শোভাযাত্রা; দুই, রকমারি পিঠা। বেলাল ভাই (লেখক বেলাল বেগ) জড়িয়ে ধরলেন, নববর্ষের আলিঙ্গন। বললাম, ‘আপনার “জয়বাংলা” স্লোগান আমাদের উদ্দীপ্ত করে।’
উল্লেখ্য, সভা-সমাবেশে আনন্দঘন মুহূর্তে বেলাল ভাইয়ের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি ভিন্ন মাত্রার আনন্দ যোগ করে। বহুদিন পর দেখা হলো লেখিকা লিজি রহমানের সঙ্গে। আমি জানতাম তাঁর প্রিয় পুত্র আসিফ সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে; কিন্তু এটা জানতাম না যে বাচ্চু ভাই (তাঁর স্বামী) সাত/আট মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন। এ খবর শুনে এই আনন্দের মধ্যেও মনটা ভারী হয়ে গেল। নাট্যকার মুজিব বিন হক আমন্ত্রণ কার্ড দিয়ে গেলেন তাঁর পরবর্তী নাটকের। দেখা হলো প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন, ফ্লোরা, হেলিম আহমদ, লেখিকা রানু ফেরদৌস, মনিজা রহমান, লং আইল্যান্ডের শিরিন আহমদসহ আরও অনেকের সঙ্গে।
উদীচী স্কুল থেকে হেঁটে রওনা হলাম ডাইভার্সিটি প্লাজার দিকে। ৭৩ স্ট্রিটের কোনায় শনিবার হয়েছে জমজমাট অনুষ্ঠান। আজ অনুষ্ঠান নয়, অন্য দৃশ্য। রাস্তা লাল শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরা নারী-পুরুষের পদচারণায় মুখরিত। আমি থেমে গেলাম বাংলাদেশ প্লাজার সামনে। স্বদেশ ফোরামের অনুষ্ঠান। আমি এখানে অতিথি। সঙ্গীরা চলে গেলেন ডাইভার্সিটির দিকে; ওখানে বিপার অনুষ্ঠান। ওপাশে আছে ড্রামা সার্কেলের মেলা।
হাতে কিছুটা সময় আছে। চা ছাড়া সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি। ভাবলাম, এই ফাঁকে চা-সমুচা খাওয়া যাক। রেস্তোরাঁগুলোতে প্রচণ্ড বৈশাখী ভিড়। ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখি রেক শূন্য। শিঙাড়া, সমুচা, আলু চপ, কাবাব, নিমকি কিছুই নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে। পাশের রেস্তোরাঁয় গেলাম, একই অবস্থা। এর পরেরটাতেও তাই। তবে দেখলাম, ইলিশ ভাজা এখনো পর্যাপ্ত আছে। হয়তো একটু পরে এটাও শেষ হয়ে যাবে। এক রেস্তোরাঁয় ভাগ্যক্রমে পিঠা পেয়ে গেলাম। একটি পিঠা চায়ের সঙ্গে উদরস্থ করে রওনা হলাম বাংলাদেশ প্লাজার সেমিনার হলের দিকে। পরে আমার স্ত্রী বললেন, তারা ইলিশ ভাজা খেয়েছেন, প্রতি টুকরো দশ ডলার। আরও জানালেন, গ্রোসারিতে মাঝারি সাইজের একটি ইলিশ গড়ে ২৫ ডলার। বড় সাইজ হলে ৫০ ডলার।
সন্ধ্যা সাতটার পর লেখক-ছড়াকার সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী শুরু করলেন স্বদেশ ফোরামের নববর্ষের অনুষ্ঠান। সভাপতিত্ব করলেন মুক্তিযোদ্ধা অবিনাশ আচার্য। অনুষ্ঠান চলাকালে ফেসবুকে আহমাদ মাযহারের পোস্ট দেখলাম, পিএস ৬৯ স্কুলে এত ভিড় যে ওখানে আর ঢোকা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আবার মনিজা রহমানের পোস্ট দেখলাম, পিএস ৬৯ স্কুলে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছেন। এত ভিড়!
স্বদেশ ফোরামের অনুষ্ঠান শেষে রাত নয়টায় আমি ও কবি তমিজ উদ্দিন লোদী রওনা হলাম ৬৯ স্কুলের দিকে। ইতিমধ্যে লোপা টেক্সট করেছে, তারা ওখানে আছে। স্কুলের সামনে আসতেই মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা বললেন, ‘ওপরে দোতলায় চলে যান, এখন ঢোকা যাবে। স্কুলের সামনে প্রায় পাঁচ শ মানুষ অপেক্ষায় ছিল ভেতরে ঢোকার জন্য।’ একই কথা বললেন তোফাজ্জল লিটন। স্কুলের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ১৯ বছরে এত দর্শক তিনি দেখেননি।
স্কুলের হলরুমে ঢুকে দেখি তানভীর শাহীন ‘মেলায় যাইরে’ পরিবেশন করছেন, মঞ্চে নাচছে কয়েকজন শিশু। গান শেষে শিরীন বকুল ঘোষণা করলেন মেলার আকর্ষণীয় সব পুরস্কার। শ্যামালিপি জানালেন, ‘এবার সংগীত পরিবেশন করবেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী ফেরদৌস আরা।’ মঞ্চে তিনি এলেন, পরপর পরিবেশন করলেন কয়েকটি গান—দেশাত্মবোধক, নজরুল ও লোকগীতি। তাঁর কণ্ঠমাধুর্যে আপ্লুত হলাম সবাই। এত সুরেলা সুর ও কণ্ঠ। সেই আবেশ নিয়েই হল ছাড়লাম। তখনো জ্যাকসন হাইটস লোকে লোকারণ্য। আর নববর্ষের অনুষ্ঠান শুধু জ্যাকসন হাইটসেই নয়, জ্যামাইকা, ব্রঙ্কস, লং আইল্যান্ডসহ অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিউইয়র্কের নানা প্রান্তে।
শুধু নিউইয়র্কেই নয়, ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলেস, মিশিগান, টরন্টো, মন্ট্রিয়েলসহ সারা উত্তর আমেরিকায় সাড়ম্বরে বাঙালিরা উদ্যাপন করেছে পয়লা বৈশাখ। আগেই বলেছি, গত ৩০ বছরে এমনটি আমি দেখিনি। বাঙালি প্রাণের এমন উচ্ছ্বাস, এমন উদ্দীপনা আর কখনো দেখা যায়নি। এ যেন বাঙালি সংস্কৃতির মহোৎসব। আচমকা এমনটি হলো কেন? বিশেষ করে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে, পরবাসী জীবনে? উত্তর দিয়েছেন যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে। কেউ বলেছেন, ‘আবহাওয়া ভালো ছিল’, ‘ছুটির দিন ছিল’, ‘বৈশাখী বিনোদনের ভালো সুযোগ করে দিয়েছিল’ ইত্যাদি। কেউ কেউ এর সঙ্গে যোগ করেছেন, সম্প্রতি বৈশাখের বিরুদ্ধে একটি পক্ষের অবস্থান দেশে-বিদেশে বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করেছে। আরও সমারোহে তা উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা ওই বিরোধিতার জবাব দিতে চেয়েছে। এই শেষেরটিও একটি বড় কারণ হতে পারে এমন অভাবনীয় সাংস্কৃতিক জাগরণের।
তবে এই আনন্দ উৎসবের মধ্যেও মানুষ ভোলেনি সোনাগাজীর নুসরাতকে। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে এসেছে নুসরাতের কথা। মানুষ তাকে ধারণ করেছে হৃদয়ে। দ্রুত বিচার চেয়েছে। দাবি জানিয়েছে সমাজের অবক্ষয় রোধে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। মানুষ বলেছে, দেশে বৈষয়িক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু অবনতি হয়েছে নৈতিক মূল্যবোধের। এটা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব পড়বে হুমকির মুখে।