গ্রীষ্মকালীন সবজি এখন কৃষকের গলার কাঁটা

করোনার কারণে সবজির বিক্রি কমেছে। ছবি: সংগৃহীত
করোনার কারণে সবজির বিক্রি কমেছে। ছবি: সংগৃহীত

আমরা জানি, অন্যান্য ফসলের তুলনায় বর্তমানে সবজি উৎপাদন কৃষকের জন্য অত্যন্ত সুখকর কারণ অন্যান্য ফসলের তুলনায় সবজিতে ফলন ও রিটার্ন দুইই বেশী। বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সবজি উৎপাদন প্রায় ১০ গুন বেড়েছে। যার ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, কৃষকের ও শ্রমিকের আয় বেড়েছে, নারীদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে, ভূমিহীনদের কাজের সুযোগ তৈরী হচ্ছে এবং কিছুটা হলেও কৃষকের অভাব অনেকটাই কমেছে।

বর্তমানে সবজি উৎপাদনে চীন ও ভারতের পরে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। এর ফলে শিক্ষিত যুব সমাজ নতুন নতুন প্রযুক্তি ও ইনোভেটিভ ধ্যান ধারণা নিয়ে সবজি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে।

কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের সূত্র মতে এ বছর বাংলাদেশে ৮.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে। উৎপাদন টার্গেট ১৬৪.৫৯ লক্ষ টন। শীত, গ্রীষ্ম, সারা বছর চাষ হয় এবং কিছু বিদেশী জাত মিলে বাংলাদেশে প্রায় ১৪২ ধরণের সবজি চাষ হয়। সবচেয়ে বেশী যে সমস্ত সবজি বাংলাদেশে চাষ হয় তাদের মধ্যে টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, চাল কুমড়া, পটল, ঝিঙা, করলা, লাউ, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, কাঁচা মরিচ, ধুন্দুল, মিষ্টি কুমড়া, ঢেরস, শশা, ক্ষীরা, মুলা, শিম, গাঁজর, পুইশাক, লালসাক, বরবটি, সজনা, শিম, ধনে পাতা, মটরশুঁটি, কাঁচা পেঁপে ইত্যাদি।

আমরা জানি, কৃষি হচ্ছে আমাদের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত, এ খাত থেকে জিডিপির আনুমানিক ১৪ শতাংশ আসে। মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৬৩ শতাংশ এর সঙ্গে জড়িত। আমরা এও জানি, মোট সবজির ৩০ শতাংশই উৎপাদন হয় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে যার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন এবং বাজার মূল্য প্রায় ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই গ্রীষ্মকালীন সবজিগুলোই এখন কৃষকের জন্য হয়েছে গলার কাঁটা। এই কাঁটা দূর করার জন্য সরকারকে অনতিবিলম্বে কিছু প্রদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ ভিত্তিক গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্রয়ের স্থান নির্ধারণ করা, যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত গ্রীষ্মকালীন সবজি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর রাখবে, স্কুল, কলেজ ও খেলার মাঠগুলোও আপদকালীন সময়ে ব্যাবহার করা যেতে পারে। যেখান থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় সবজি সমূহ সরাসরি কিনে ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে সরবরাহ করা যেতে পারে।

এ ছাড়াও স্থানীয় কৃষি অফিস, বিএডিসি ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তররের সমন্বয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারভিশনে উপজেলা অনুযায়ী একটি করে টিম গঠন করে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে সবজি ক্রয় করে, বড় বড় শহরগুলোতে পাঠানোরে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বড় বড় সুপারশপগুলোকে সবজি উৎপাদন জেলাগুলতে গিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সবজি কেনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করতে পার। এইখানেও আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের সহায়তা করতে পারে।

এ কষ্টের সময়ে কৃষকের পাশে যদি আমরা দাঁড়াতে না পারি তাহলে অসহায় কৃষকেরা আমদের ক্ষমা নাও করতে পারেন। আমরা ভালোভাবেই জানি একমাত্র কৃষি খাতের সফলতার উপর আমাদের ১৭ কোটি জনগনের বাঁচা মরা নির্ভর করে। আর এই খাতের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে দেশের প্রায় এক কোটি কৃষক পরিবারসহ ছোটবড় অসংখ্য কৃষি উৎপাদকেরা যারা ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য জোগান দিয়ে যাচ্ছে না বেশ কিছু রপ্তানীযোগ্য পন্যেরও জোগান দিয়ে যাচ্ছে।

সংবাদ মাধ্যমগুলো জানাচ্ছে বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্হিতিতে দেশের কৃষি উৎপাদকরা সামগ্রীকভাবে চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। কৃষি উৎপাদকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা উৎপাদন করে তা সে গ্রীষ্মকালীন সবজি , ধান, পাট, ডিম, দুধ, মুরগী যাই হোক না কেন, তার কোনটিরই উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। অবশ্য ভোক্তা পর্যায়ে এ সবকিছুরই মূল্য যথেষ্ঠ বেশী। তার মানে টাকা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। এ ঘটনা অবশ্য সারা বছরই ঘটছে, তবে বর্তমান কোয়ারেন্টিনের মধ্যে সেই সংকট আরো গভীর হয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরো গভীরতর হতে চলেছে।

পাইকারী বাজারে পণ্য আছে কিন্তু ক্রেতা নেই, পণ্য পরিবহনে চলছে নানারকম বাঁধা বিপত্তি। ফলে উৎপাদক কম দামে লোকসান দিয়ে তার পণ্য বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। ৪ টাকা পিস ডিম, ২৫ টাকা লিটার দুধ, ৪৫ টাকা কেজি ফার্মের মুরগী আর ৩ টাকা কেজি বেগুন, ২ টাকা কেজি টমেটো, ২ টাকা কেজি শশা ,৩ টাকা কেজি ঢেঁড়স তার কয়েকটি উদাহরণ। অথচ উৎপাদন খরচ অনেক বেশী। শিল্প উৎপাদকেরা বাজারে চাহিদা কমে গেলে প্রয়োজনে যে কোন সময় উৎপাদন কমিয়ে দিতে বা বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু কৃষি উৎপাদকরা চাইলেই সেটা অনেক সময় করতে পারে না। ফলে লোকসান হয় অবধারিত। এরকম চলতে থাকলে দেশের কৃষক সমাজ ও কৃষি উৎপাদকরা তো মারা পড়বেই; উপরন্ত দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। সেক্ষেত্রে কৃষির সংগে সংশ্লিষ্ট শিল্পসমূহ, যেমন কৃষি উপকরণ উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ, ইত্যাদিও মহা সংকটে পড়বে। তাই দেশের কৃষক তথা সামগ্রীকভাবে কৃষিকে বাঁচাতে এখনই সরকারকে জরুরীভিত্তিতে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহন করতেই হবে। যেমন, কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে প্রনোদনা হিসাবে ভর্তুকির ব্যবস্হা করা, কৃষি ঋণ মাফ করা বা সুদ মওকুফ করা, বিনাসুদে বা স্বল্পসুদে নতুন ঋণের ব্যবস্হা করা, প্রয়োজনে ভারতের মতো মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইজ ঘোষণা করে তা সরকারী উদ্যোগে নিশ্চিত করা, কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণ ও পরিবহণ বাঁধামূক্ত করা, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে চাহিদা নিরূপন করে এলাকাভিত্তিক উৎপাদন পরিকল্পনা তৈরী ও বাস্তবায়ন, ইত্যাদি।

আশা করি সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল কৃষকের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিবেন এবং অসহায় কৃষকদের গলার কাঁটা নামানোর চেষ্টা করবেন। কারণ কৃষকেরা হলো আমাদের প্রকৃত যোদ্ধা, আজকে আমরা ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সংবাদকর্মী ও অন্যান্য সেবা প্রদানকারীকে যোদ্ধা হিসাবে আমরা যেমন সবাই স্যালুট জানাচ্ছি, ঠিক তেমনি আন সীন বা অন্ধকারে ঢাকা পড়া প্রকৃত যোদ্ধাকে আমরা যেন ন্যূনতম সম্মানটুকু দিতে ভুলে না যাই। মনে রাখতে হবে কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্হিতিতে ১৭ কোটি মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থকে বাঁচাতে পারে একমাত্র এই আন সীন যোদ্ধারাই।

লেখক: কৃষিবিদ