স্মৃতির পাতায় ঐতিহাসিক মুজিবনগর
হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে! তাও যদি হয় স্মৃতিবিজড়িত কোনো স্থানে, তাহলে তো কথাই নেই। লুফে নিলাম মুজিব বর্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান মুজিবনগর দেখার সুযোগ। ব্যস্ততাকে ছুটিতে পাঠিয়ে একটি দিনকে নিজের করে নিলাম আমরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা।
সকাল সাড়ে ছয়টায় এক বন্ধুর ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। ফোন কানে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে আওয়াজ এল ‘কী রে উঠিসনি এখনো?’ কল কেটে তড়িঘড়ি উঠে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথিমধ্যে ক্যাম্পাসের ডায়না চত্বরে দেখা মিলল বন্ধু মামুন, শোভন, প্রতাপসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। সবাই মিলে ভ্যানে চেপে বসলাম। চললাম বাসের কাছে মীর মশাররফ একাডেমিক ভবনের দিকে। বন্ধু-বান্ধবীরা হেলেদুলে বাহারী সাজে আসতে শুরু করল। সবার মনে বাঁধভাঙা আনন্দ। কারও যেন আর অপেক্ষা সইছে না। কখন শাঁই শাঁই করে ছুটে চলবে বাস।
ভাবতে ভাবতেই গাড়ি চালুর শব্দে এক অনাবিল আনন্দ বয়ে চলল সবার মনে। মনের আনন্দে গানের তালে, হইহুল্লোড়ে নাচতে শুরু করল অনেকে। গান, নাচ ও হইহুল্লোড়ে সবুজের বুক চিরে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কে সর্পিল ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে চলছে আমাদের বাস। পথিমধ্যে গানের সঙ্গী হলেন আমাদের প্রিয় মেহেদী স্যার। এরই ফাঁকে বন্ধু রেদোয়ান র্যাফেল ড্রর টিকিট বিক্রি করতে ভুলল না।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মুজিবনগরের প্রধান ফটকে আমরা পৌঁছাই দুপুর ১২টার দিকে। বাস থেকে নেমেই খানিকটা বিশ্রাম নিলাম ‘সূর্যোদয়’ ডাক বাংলোয়। বিশ্রাম শেষে বেরিয়ে পড়লাম মুজিবনগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এ সময় আমাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. সেলিম তোহা স্যার, আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনিচুর রহমান স্যার, সহকারী অধ্যাপক ড. আরমিন খাতুন ম্যাম ও আমাদের বিভাগের প্রভাষক মেহেদী হাসান স্যার।
বাংলো থেকে বেরিয়ে প্রথমে নজর কাড়ল মেহেরপুরের ভবেরপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথবাবুর আমবাগান, যাঁর নামানুসারে জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছিল বৈদ্যনাথতলা। এই বৈদ্যনাথতলা আমাদের দেশর প্রথম রাজধানী। যেখানে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। শপথ গ্রহণ ও ঘোষণাপত্র পাঠের পর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতি পাঠ করে সেই স্থানের নামকরণ করেন মুজিবনগর। সেই থেকেই এই স্থানটি মুজিবনগর বলেই পরিচিত। বাংলাদেশকে মুক্ত করতে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ, যার ফসল আমাদের লাল–সবুজের বাংলাদেশ।
আমবাগান দেখা শেষে আমরা গেলাম স্থপতি তানভির মোকাম্মেলের নকশায় দেশের প্রথম রাজধানীর ঐতিহ্য তুলে ধরতে গড়া মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে। সেখানে গিয়ে দেখা হয় বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগর হওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি আমাদের মুজিবনগর গড়ে ওঠার গল্প শোনান। অপলক দৃষ্টিতে ও মনোযোগ সহকারে তাঁর গল্প শুনছিলাম আমরা।
গল্প শোনার পর সেলিম তোহা স্যারের পক্ষ থেকে আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করলাম না। আইসক্রিম খেতে খেতে এগিয়ে চললাম বিরাট আকৃতির বাংলাদেশের মানচিত্র দেখতে। দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টরের ভাগ দেখানো হয়েছে এই মানচিত্রে। এ ছাড়া যুদ্ধের এলাকা, শরণার্থীদের দেশত্যাগের চিত্রও স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এ সময় আশপাশে দেখা মেলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন ভাস্কর্য, যার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন ইতিহাস। ক্লিকে ক্লিকে স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থান ধরে রাখতে মোটেও ভুললাম না আমরা।
শুধু মুজিবনগর দেখেই ক্ষান্ত হয়নি আমাদের ভ্রমণপিপাসু মন, ভ্যানে চেপে দল বেঁধে ছুটে চললাম বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত অভিমুখে। এপারে বাংলাদেশ, ওপারে ভারত, মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া। সীমান্তের পাশেই নানা বাহারি পণ্যের দোকান সাজানো। দেখে মনে হয় যেন এক মেলা বসেছে। সীমান্ত থেকে ফিরে সম্পন্ন করলাম মধ্যাহ্নভোজ। মধ্যাহ্নভোজ শেষে এক সুবিশাল আমবৃক্ষের ছায়াতলে আয়োজন করি এক বিনোদনভরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বালিশ খেলার। এ সময় গান, নাচ, কৌতুকের পাশাপাশি প্রধান আকর্ষণ ছিল র্যাম্প শো। এ ছাড়া আয়োজন করা হয় র্যাফেল ড্রর। সবশেষে খেলা ও র্যাফেল ড্রর পুরস্কার বিতরণের মাধ্যমে শেষ হয় মুজিবনগরে অবস্থান।
এবার ফেরার পালা। দীর্ঘদিনের সাধ মুজিবনগর দেখা ষোলোকলায় পরিপূর্ণ হলো। ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বুকে লালন করে ফিরে এলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার কৌতূহল যেন আরও বেড়ে গেল। মনের মধ্যে গেঁথে গেল এই মুজিবনগর। স্মৃতির পাতায় এ দিনটি চির অম্লান হয়ে থাকবে।