ব্রিটেন ক্ষমা চাইতে পারলে একই অপরাধে পাকিস্তান কেন নয়
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় দিন। একজন ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের বিক্ষোভরত নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এতে প্রাণ যায় বহু লোকের। ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড’ বলে পরিচিত ওই ঘটনার সূচনা অমৃতসরের একটি সমাবেশ থেকে।
অমৃতসর শিখ সম্প্রদায়ের একটি পবিত্র শহর। এই শহরেই শিখদের পবিত্র স্বর্ণমন্দির। সেখানেই ঘটে এ হত্যাকাণ্ড।
১৯১৯ সালে এই শহরে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছিল। ১৩ এপ্রিলে শহরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল ডায়ার খবর পেলেন শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগে বিক্ষোভের জন্য মানুষজন জড় হচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি একদল সৈন্য নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে গেলেন। তিনি এসেই শহরে যেকোনো ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দিলেন। কিন্তু অনেক মানুষ এই সিদ্ধান্তের কথা জানতেন না। জালিয়ানওয়ালাবাগের পার্কে সেদিন অনেকে এসেছিলেন দুই স্বাধীনতাসংগ্রামী সত্য পাল ও সইফুদ্দিন কিচলুর দ্বীপান্তরের প্রতিবাদে সভায় যোগ দিতে। বেশ কিছু শিখ তীর্থযাত্রীও ছিলেন। কর্নেল রেজিনাল্ড ডায়ার সেনাবাহিনীর শিখ, রাজপুত, গোর্খা ও বালুচ রেজিমেন্টের সেনাদের নিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘিরে ফেলেন। সব কটি প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর কাউকে সতর্ক না করে, পালানোর সুযোগ না দিয়ে শিশু–নারীনির্বিশেষে নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন।
সার্জেন্ট উইলিয়াম এন্ডারসন ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের অধীনে কাজ করতেন। ওই ঘটনা সম্পর্কে পরে তিনি লিখেছিলেন, ‘যখন গুলি শুরু হলো, মানুষ মাটিতে শুয়ে পড়তে লাগলেন। কেউ কেউ উঁচু দেয়াল বেয়ে উঠে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁরা যে আমাদের দিকে তেড়ে আসবেন, সেই ভয় তখন আমার হয়নি।’
কত মানুষ সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে ছিলেন, তা নিয়ে নানান বক্তব্য রয়েছে। ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরে ব্রিটিশ সরকার একটি তদন্ত করে। রিপোর্টে নিহত মানুষের সংখ্যা বলা হয় ৩৭৯ জন। কিন্তু ভারতের করা তদন্তে এই সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। উল্লেখ্য, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ সরকারের দেওয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করেন।
তবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এত বছর পরে হলেও ব্রিটেনের বোধোদয় হয়েছে। ব্রিটেন উপলব্ধি করেছে নিরপরাধ মানুষ হত্যা কখনোই সভ্যতার নিদর্শন হতে পারে না। তাই এই হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ পূরণ হওয়ার তিন দিন আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছিলেন, ‘সেদিন যা ঘটেছিল এবং তার কারণে মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, আমরা তার জন্য গভীরভাবে অনুতপ্ত।’ ব্রিটেনের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড হাউস অব কমন্সে এ ‘অতীত ইতিহাসের লজ্জাজনক ঘটনা’র জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে কিছু অর্থনৈতিক দিক জড়িয়ে থাকে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন।
অবশ্যই মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই ক্ষমা এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হলো নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যা কখনোই কোনো সুস্থ এবং সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়েও আরও ভয়াবহ এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ড ১৯৭১ সালে সংগঠিত করার পরও পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ক্ষমা তো চায়নি, বরং আরও ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রকাশ করে যাচ্ছে।
আমরা যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ করি, তাহলে দেখব রাজনৈতিক পটভূমি এবং নৃশংসতার বিচারে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যা ছিল অনেক বেশি নিষ্ঠুর এবং বর্বর। রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর যে বর্বর আক্রমণ চালায়, তা কোনোভাবেই কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনের আক্রমণ ছিল না, বরং তা ছিল গণতন্ত্র হরণের আক্রমণ, তা ছিল ১৯৭০ সালে জনগণ যে ম্যান্ডেট দিয়েছিল তা স্তব্ধ করার আক্রমণ। সর্বোপরি পাকিস্তানিদের সেই আক্রমণ ছিল গণতন্ত্রের কবর রচনা করার আক্রমণ।
যদি নৃশংসতার দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করি তাহলে দেখি ১৯৮১ সালের ইউএনএইচআরসি (ইউনাইটেড ন্যাশনস হিউম্যান রাইটস কমিশন) রিপোর্ট অনুযায়ী মানবসভ্যতার ইতিহাসে যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে তখন হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশে। গণহত্যার ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ গড়।
তবে এখানে উল্লেখ্য, অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম রাতের প্রাণহানির সংখ্যাই ছিল কমপক্ষে ৩৫ হাজারের মতো। চুকনগর গণহত্যায় প্রাণহানি ঘটেছিল ১০ হাজারের ওপরে।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী ২৭ মার্চে প্রাণহানির সংখ্যা ১০ হাজার। ১৯৭১ সালের সিডনি মরর্নিং হেরাল্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী মার্চের ২৫ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত (৫ দিনে) প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এতে দেখা যায় দিনপ্রতি প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘প্রাভদা’ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশে ৩০ লাখ শহীদের বিষয়টি প্রকাশ করে। এই প্রাভদার ইংরেজি সংস্করণে উল্লেখ করা হয়, ‘Over 30 lakh persons were killed throughout Bangladesh by the Pakistani occupation forces during the last nine months’। প্রাভদা পত্রিকাটির ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারির বাংলা সংস্করণে শিরোনাম হয় ‘দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করেছে।’
বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট যে রাজনৈতিক পটভূমি এবং নৃশংসতার বিচার যেভাবেই দেখা হোক না কেন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বহুগুণে জঘন্য ও বর্বর ছিল পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত ১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ড। তবুও পাকিস্তান নামক অসভ্য রাষ্ট্রটির বোধোদয় হয়নি। উপরন্তু পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তাদের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পেইড এজেন্টের মাধ্যমে গণহত্যার বিষয়ে শুধু মিথ্যাচারই করছে না, বরং তাদের এদেশীয় দোসরদের বিচারকেও বাধাগ্রস্ত করার কূটচক্র চালিয়ে যাচ্ছে।
তাই সময় এসেছে ব্রিটেনের পথ অনুসরণে পাকিস্তানকে বাধ্য করা। সে জন্য সরকারি, বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিপর্যায়েও বিশ্বের বিভিন্ন ফোরাম এবং গণমাধ্যমে পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা তুলে ধরতে হবে। বিশ্ববাসীর মধ্যে এই ভাবনার উদ্রেক ঘটাতে হবে যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি যত দিন পর্যন্ত ১৯৭১ সালের কৃত গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইবে, তত দিন মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে।
*লেখক: গবেষক