‘জানেন তো, ব্রিলিয়ান্স (মেধা) এবং ইন্টেলিজেন্সের (বুদ্ধিমত্তা) মধ্যে যে অনেক পার্থক্য? যাকে ভালো ছাত্র বলা হয়, তার ফলাফল ভালো, সে অনেক পড়তে পড়তে অনেক জেনেছে, সেটা তার ব্রিলিয়ান্স। কিন্তু যখন একজন পড়াশোনা করছে, ব্যাক বেঞ্চে বসে ফাঁকি দেওয়ার বুদ্ধিটাও তার আছে, তখন কিন্তু আমি তাকে ইন্টেলিজেন্ট বলব। বলছি না ফাঁকি দেওয়াটা ভালো। কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে, নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে একটা উপায় খুঁজে নেওয়া, ইন্টেলিজেন্ট হওয়া, স্ট্রিট স্মার্ট হওয়া কর্মক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি।’
কথাগুলো তরুণেরা মাথায় টুকে রাখতে পারেন। পেশাগত জীবনের জন্য নিজেকে তৈরি করার উপায় নিয়ে বলছিলেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নির্বাচিত প্রথম নারী সভাপতি এবং মোহাম্মদী গ্রুপের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক। ৭ অক্টোবর বিএসআরএম নিবেদিত ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘মিট দ্য এক্সপার্ট’–এর চতুর্থ পর্বে তাঁর সঙ্গে প্রাতরাশের টেবিলে বসে ক্যারিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করা ও পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল সারা দেশ থেকে নির্বাচিত ১২ জন তরুণের।
এই তরুণদের চোখজুড়ে স্বপ্ন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে নানা প্রশ্ন, খানিকটা আশঙ্কাও। তাই প্রথিতযশা শিল্পপতি ও দক্ষ প্রশাসক রুবানা হককে সামনে পেয়ে তরুণেরা খুলেছিলেন প্রশ্নের ঝাঁপি। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের সঞ্চালনায় যথাসময়ে শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব।
ডাবুর বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ম্যানেজার আবু ওবায়দা ইমন জানতে চাইলেন, কীভাবে তরুণেরা নিজেকে কর্মক্ষেত্রের জন্য যোগ্য করে তুলতে পারেন। রুবানা হকের মতে, কর্মক্ষেত্রে কাজের চাহিদা এবং সদ্য গ্র্যাজুয়েট তরুণদের কর্মদক্ষতার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তিনি বলেন, ‘আমার অফিসে যখন কেউ চাকরির আবেদন নিয়ে আসেন আমি প্রথমেই বলি, বলুন তো আজকের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো কী কী? এ থেকে বোঝা যায় তিনি পত্রিকা পড়েন কি না, আশপাশে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে জানেন কি না। আর একটা কথা মনে রাখবে যে চাকরিই করতে হবে, তা কিন্তু নয়। তুমি কী কাজ করতে চাও সেটা আগে ভাবো, তারপর চেষ্টা করে দেখো নিজেই সেই কাজ করার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারো কি না।’
মালিহা রহমান নামে এক শিক্ষার্থীর প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম–অধিকার প্রসঙ্গে। উত্তরে রুবানা হক বলেন, সম–অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। নারীর ক্ষমতায়নের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান, পোশাকশিল্পে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণের প্রশংসা করেন তিনি। কিন্তু একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেন, উচ্চপদে আসীন নারীর সংখ্যা ও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা এখনো অনেক কম। আজিমপুর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থী আফরোজা সুলতানা এ অবস্থার সমাধান সম্পর্কে জানতে চাইলে রুবানা হক কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইনক্লুসিভনেস বা অন্তর্ভুক্তিকরণ বাড়ানোর কথা বলেন।
আলোচনার একপর্যায়ে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সাবরিনা আক্তারের প্রশ্ন ছিল, নারীরা নেতৃত্বে এলেই পরিপূর্ণ নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা সম্ভব কি না। রুবানা হকের বক্তব্য হলো, শুধু নারী নেতৃত্বই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। কারণ, এখনো নারীরা যখন নেতৃত্ব দেন, পুরুষের তুলনায় তাঁর চ্যালেঞ্জ থাকে দ্বিগুণ। নেতৃত্ব দেওয়ার যে চ্যালেঞ্জ, সেটি ছাড়াও নারীর জন্য থাকে সামাজিক বাধা। রুবানা বলেন, ‘একজন নারীকে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার আগে নিজের পোশাক নিয়ে ভাবতে হয়; কিন্তু একজন পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়।’
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থী নানজীবা ইবনাত একটা সুন্দর প্রশ্ন করলেন। জানতে চাইলেন, কোন উপদেশটি রুবানা হক সব সময় মনে রাখার চেষ্টা করেন। ‘যত ঝড়ই আসুক, ভয় পেতে নেই। ঝড় পেরিয়ে গেলেই ভয় পাওয়া সমীচীন’—মায়ের কাছে শোনা এ উপদেশের কথাই বললেন রুবানা হক।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসতে থাকে আরও অনেক প্রশ্ন, দক্ষ প্রশাসক রুবানার উত্তর শুনে তরুণদের আগ্রহ বাড়ে আরও। প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন আসে। রুবানা হকও আগ্রহ নিয়ে উত্তর দেন। ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলামের প্রশ্নের উত্তরে রুবানা হক কখনো বলেন, মা-ই তাঁর সবচেয়ে বড় আইডল। কখনো রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষার্থী শারমিন সুলতানাকে মনে করিয়ে দেন, ভালো মানুষের সান্নিধ্যে থাকা কতটা জরুরি। কথায় কথায় উঠে আসে একাত্তরের যুদ্ধদিনে নাসির উদ্দীন ইউসুফ, শৈশব-কৈশোরে করুণাময় গোস্বামীর মতো চমৎকার মানুষদের সান্নিধ্যে কতটা ঋদ্ধ হয়েছেন তিনি।
প্রাতরাশের টেবিলে সর্বশেষ প্রশ্নটি করেন শফিকুল হক নামের এক তরুণ। তিনি জানতে চান, তরুণদের বেকারত্বের হতাশা থেকে উদ্ধার করতে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য কতটা জরুরি। উত্তর এল, ভীষণ জরুরি। রুবানা হক মনে করেন, ‘মেন্টরশিপ’ হতে পারে একটি চমৎকার কার্যকরী সমাধান। তিনি বলেন, ‘একজন সফল মানুষ যদি আশপাশের দশজনকে মেন্টর করে, সেখান থেকেই কিন্তু শুরু হয় আরও দশজনের সামনে এগিয়ে যাওয়া। মেন্টর করা মানে পাশে দাঁড়ানো, তরুণটি সামনে কী করতে পারে এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করা, পরামর্শ দিয়ে তাকে সাহায্য করা।’
আলোচনার শেষে তরুণদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের মানুষের সরাসরি আলোচনার সুযোগ করে দেওয়ায় আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান রুবানা হক। তিনি বলেন, ‘সামনে এগিয়ে যেতে হলে নেটওয়ার্কিং একটি বড় শক্তি। আজ তরুণেরা এল, আলোচনা করল, পরিচয়ের ক্ষেত্র তৈরি হলো। পরবর্তী সময়ে ওরা একটি ভালো কাজ করতে চাইলে ওরা হয়তো আমাকে আজকের এই পরিচয়ের কথা মনে করিয়ে দেবে, আমি ওদের এগিয়ে যাওয়ার পথটি যেন সহজ হয়, সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে বা যেকোনোভাবে সহায়তা করব—এই চর্চা অব্যাহত রাখা আমাদের দায়িত্ব।’