সুখের খোঁজে মিশুর কার্টুন
>তরুণ কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশুর কার্টুন সিরিজ ‘দ্য গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ’। তিনি এই সিরিজে যুদ্ধবিগ্রহ আর আন্দোলন-সংঘাতের সময়কার কিছু ছবিকে রূপান্তর করেছেন যাপিত জীবনের সুখের কোনো মুহূর্ত হিসেবে। তাঁর আঁকা সেসব কার্টুন বিস্তৃত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সিএনএন, আল–জাজিরা, বোরডপান্ডাসহ ২৪টি দেশের ৭০টি সংবাদমাধ্যমে। এক বছর আগে শুরু করা সে সিরিজের গল্প শোনালেন মিশু।
আপনার কার্টুন সিরিজটি এক বছর পূর্ণ করছে। এই সময়ের মধ্যে সাড়া তো ভালোই পেলেন!
‘সাড়া’ শব্দটি শুনে সদাহাস্যোজ্জ্বল মোরশেদ মিশুর মুখাবয়ব বদলে গেল। ঠোঁটের ওপর তাঁর ‘ট্রেডমার্ক’ পুরু গোঁফে আলতো আঙুল ছুঁয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেক সাড়া পেয়েছি। কিন্তু জানেন, সাড়া পাওয়ার আশায় সিরিজটি আমি শুরু করিনি। কার্টুনগুলো বরং আমার মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। একান্ত দুঃখবোধ থেকে কাজটি করেছি।’
মিশুর সে দুঃখবোধের কথা অনেকের হয়তো জানা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধবিগ্রহ আর আন্দোলন-সংগ্রামের সময়কার অনেক ছবি ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়ায়, ভাইরাল হয়। কয়েক বছর ধরে এই ছবিগুলো মিশুর মনের ভেতরও জেঁকে বসে দুঃখবোধ হয়ে। তিনি মেলান ব্যক্তিগত জীবনের কোনো ঘটনার সঙ্গে। দুঃসহ মুহূর্তের ছবিগুলো তো আসলে হতে পারত সুখের কোনো মুহূর্তের ছবি। মানুষের তৈরি বিপর্যয় তৈরি করেছে দুঃসহ এসব মুহূর্ত। দ্য গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ নামের সিরিজে মিশু সেই ছবিগুলোর বিপরীতে ভাবতে চেষ্টা করেছেন। সেখানে সুখের মুহূর্ত দেখিয়েছেন।
এক বছর আগের একদিন
১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে তিনি একটু পেছনে ফিরে গেলেন। ফ্ল্যাশব্যাকে দৃশ্যমান হলো ২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। সে রাতে আঁকতে বসেছিলেন সিরিজের প্রথম ছবি। সিরিয়া যুদ্ধের সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক বাবা তাঁর প্রাণপ্রিয় মেয়েকে নিয়ে ছুটছেন বাঁচার আশায়। চোখেমুখে একরাশ আতঙ্ক আর মৃত্যুভয়। সে ছবিটি মিশু রূপান্তর করলেন, সবুজ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে বাবা তাঁর মেয়েকে নিয়ে হেঁটে আসছেন। মেয়ের হাতে লাল বেলুন। দুজনের মুখে অকৃত্রিম হাসি।
ছবি আঁকা শেষ হলো। তবে ঠিক হয়নি সিরিজের নাম। ভাবলেন ফেসবুকে দেওয়ার সময় ছবির সঙ্গে একটা ছড়া হলে ভালো হয়। দুটো পঙ্ক্তির আশায় ছড়াকার অনিক খানকে স্মরণ করলেন মোরশেদ মিশু। ভবনার কথা শুনে তিনিই চট করে বললেন, ‘আমি শুধুই আঁকতে জানি, কষ্টগুলো ঢাকতে জানি।’ আঁকার মাধ্যমেই তো কষ্ট লুকান মিশু।
তখনই ঠিক করে ফেললেন সিরিজের নামও। সে বৃত্তান্তও বলে গেলেন মিশু, ‘অনিক খান আমার কাজের উদ্দেশ্য জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছি, পৃথিবীর সবাই তো আমরা সুখের সন্ধান করছি। যে মানুষ যুদ্ধের ময়দানে আছে, তার কাছে সুখের মুহূর্ত হয়তো এক মুঠো খাবার পাওয়া।’
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে সিরিজের নামকরণে দুজন একমত হলেন। নাম ঠিক করা হলো ‘দ্য গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ’।
জুটল প্রশংসা, সমালোচনাও
রাতে আঁকা কার্টুনটি পরদিন সকালে মিশু ফেসবুকে দিয়েছিলেন। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক রূপ নিতে সময় নেয়নি। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় বেশ কিছু ফেসবুক পেজ মিশুর আঁকা কার্টুনটি শেয়ার করে।
মিশু বললেন, ‘লাইক আর শেয়ারের বিষয়টি আমার কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করল। এভাবে আরও কিছু কার্টুন আঁকলাম।’
মিশুর আঁকা কার্টুনগুলো মানুষের বিবেককে নাড়া দিল। অনেকে এলেন প্রশংসাবাক্য নিয়ে। মাস দুই গড়াতেই সমালোচনার তিরও ছুড়লেন কেউ কেউ। ‘অনেকে ভেবেছিলেন আমি বুঝি একজন মুসলিম আর্টিস্ট হিসেবে, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে আঁকছি। কারণ, তখন পর্যন্ত আঁকা কার্টুনগুলো ছিল মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধবিগ্রহের ছবি নিয়ে।’ বলেন মোরশেদ মিশু।
তবে মিশু বোঝাতে পেরেছেন তিনি কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম, গোত্র, দেশের পক্ষে আঁকছেন না। সময়ের সহযাত্রী হিসেবে প্রথম দিকে হয়তো সাম্প্রতিক যুদ্ধবিগ্রহ আর আন্দোলনের ছবি এসেছে তাঁর আঁকায়, কিন্তু এটাই শেষ নয়। তাই সিরিজের ১১তম কার্টুনটিতে দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার ছবি, মিশুর সুখের রং ছড়িয়েছে বাংলাদেশের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়কার একটি ছবিতেও।
ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী
এ মাসেই মিশুকে অবাক করে দিয়েছে একটি চিঠি। চিঠির প্রেরক ইরানি অভিনেত্রী ও সংগীতশিল্পী গোলশিফতেহ ফারাহানি। তিনি চিঠিতে তাঁর ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন।
গত বছর ইরানের একটি জাতীয় দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল মোরশেদ মিশুর দ্য গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এরপর তা বিস্তৃত হয়েছে সিএনএন, আল–জাজিরা, বাজফিড, বোরডপান্ডাসহ ২৪টি দেশের ৭০টি সংবাদমাধ্যমে।
তবে মিশুর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা উন্মাদ–এর পুরস্কারটি। গত বছর জুলাই মাসে রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদ-এর ৪০ বছর পূর্তি উৎসবে কার্টুন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পায় মিশুর সিরিজটি। মিশু বলছিলেন, ‘আমি জীবনে কোনো কাজে প্রথম হইনি। সেটাই প্রথম প্রথম হওয়া।’
হয়ে গেলেন কার্টুনিস্ট
অধরা স্বপ্ন নিয়ে অনেকে কথা বলতে চান না। কিন্তু মোরশেদ মিশু অকপটে বললেন ছোটবেলার সে অধরা স্বপ্নের কথা। যে স্বপ্ন তাঁর পেশার তরি ভিড়িয়েছে কার্টুন নামের এক সৃজনশীল পেশার সঙ্গে। ‘আমার লক্ষ্যই ছিল সামরিক কর্মকর্তা হওয়ার। এইচএসসি পাস করার পর সামরিক বাহিনীতে ভর্তির পরীক্ষা দিলাম। কিন্তু সুযোগ পেলাম না।’ টানা দুই বছর চেষ্টার পর স্বপ্নভঙ্গের হতাশা চেপে বসেছিল।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) অষ্টম সেমিস্টার পর্যন্ত পড়ার পর তাঁর খেয়াল হয়েছিল, এ যেন ‘অযথা সময় নষ্ট’। ছেড়ে দেন পড়াশোনা। তবে স্বপ্ন যে ছেড়ে দিয়েছেন তা নয়। যোগ করলেন, ‘আমি অ্যানিমেশন নিয়ে পড়তে চাই। আমার কাজের, ভালো লাগার বিষয় তো এটাই।’ তাই মিশু এখন পুরোদস্তুর কার্টুনিস্ট।
গল্প শুনতে শুনতে তাঁর গোঁফ–রহস্যও উন্মোচন হলো। ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মো. আতাউল গণি ওসমানীর গোঁফ দেখে আমারও ইচ্ছে হয়েছিল রাখার।’
উন্মাদ মিশু
উন্মাদ প্রসঙ্গ এলেই মিশুর মুখে যে শব্দটি মুহুর্মুহু আসে, তা হলো, ‘বস’। যাঁরা মোরশেদ মিশুকে চেনেন, যাঁরা জানেন জনপ্রিয় রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদ সম্পর্কে, তাঁদের কাছে এই শব্দের পেছনের মানুষও চেনা। বস হচ্ছেন উন্মাদ সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। বাংলাদেশের তরুণ কার্টুনিস্টদের অনুপ্রেরণার নাম। মোরশেদ মিশু যেমনটি বললেন, ‘উন্মাদ আমার কাছে একটি প্রতিষ্ঠান। আমার কার্টুন জীবনের শুরু এখানেই। শুরুর সময়টায় আমি যখন আঁকছি, বস দেখে দিচ্ছেন। তাঁর সংশোধনী দেখে আমি শিখছি, ঝালিয়ে নিচ্ছি।’ মুক্ত পেশাজীবী (ফ্রিল্যান্সার) মিশু এখনো উন্মাদ–এ সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
২০১২ সাল থেকে এই শেখার শুরু। তবে মিশুর কার্টুনে হাতেখড়ি তাঁর মেজ ভাই মাহিন আবদুল্লাহর কাছে। আঁকাআঁকিসহ বিভিন্ন বই ও সাময়িকীর প্রতি মিশুর যে টান, সে কৃতিত্বটা তিনি মেজ ভাইকেই দিলেন।
প্রদর্শনীর পরিকল্পনা
এখন সিরিজের যে কার্টুন আঁকছেন, সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিতে চান না মিশু। ৩০টি কার্টুন আঁকা হলে, সেগুলো নিয়ে প্রদর্শনী করার লক্ষ্য তাঁর। আর সেটা কয়েক মাসের মধ্যেই। মোরশেদ মিশু বললেন, ‘আমার আঁকায় বিশ্বে অনেক বড় পরিবর্তন আসবে, কোনো রাষ্ট্রনায়ক যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন। এই স্বপ্ন নিয়ে আমি আঁকিনি। আমার মনের খোরাক মেটানোর জন্য আঁকছি। যে অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ পেয়েছি কিংবা পাচ্ছি, এসব তো বাড়তি পাওনা।’