শিক্ষার্থীরা হলো হীরার মতো
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে এখন পর্যন্ত আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? শিক্ষার্থীদের যত দূর দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য কি চোখে পড়েছে?
যানজট, কোলাহল, দূষণের অংশটুকু ছাড়া অভিজ্ঞতা বেশ ভালো (হাসি)। আমি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকে বলেছেন, কিউএস র্যাংকিংয়ে আমরা ১ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়। এটা নিয়ে তারা খুব আনন্দিত। কিন্তু আমি মনে করি, এই অর্জনে আমাদের খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ, বাংলাদেশে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ভালো হলেও বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের তেমন কোনো অবস্থান নেই। ব্র্যাক যেমন বিশ্বের ১ নম্বর এনজিও, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তো সেই অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। শহরের ভেতরের অবস্থান, অবকাঠামো, সৌন্দর্যের দিক দিয়ে গ্রেড দিতে হলে আমি হয়তো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কে বি দেব। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই এ গ্রেড পাবে। সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমার কথা হয়নি। কিন্তু লিফটে প্রতিদিন আমার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা হয়। যেকোনো অনুষ্ঠানে আমি সবার সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করি। যত দূর দেখেছি, তারা কৌতূহলী। ইংরেজি ভাষায় তাদের ভালো দখল আছে। আমি হয়তো কিছুটা পক্ষপাত করে ফেলছি। হয়তো যারা ইংরেজি ভালো জানে, তারাই আমার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে এসেছে। তবে অংশগ্রহণের আগ্রহ তাদের মধ্যে আছে। চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের তুলনায় এখানকার শিক্ষার্থীদের মান কোনো অংশে কম নয়। ‘মান’ বলতে আমি এখানে কাঁচামাল বোঝাচ্ছি। যেমন আপনি যদি হীরার দিকে তাকান, হীরা পাওয়া যায় খনি থেকে। খনির ভেতরে কিন্তু আপনি সুন্দর, মসৃণ হীরা পাবেন না। সেটা আপনাকে তৈরি করে নিতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরাও সেই হীরার মতো। কাঁচামাল হিসেবে খুব ভালো, এখন তাদের মসৃণ করার পালা।
উপাচার্য হিসেবে আপনার লক্ষ্য কী?
শিক্ষকদের কাজ কিন্তু শুধু ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান দেওয়া নয়। বরং শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা। অনেকে মনে করে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা হলো ‘কাস্টমার’। এ কথার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। শিক্ষার্থীরা তো হবে আমাদের পণ্য (প্রোডাক্ট)। শিক্ষার্থীরা হবে আমাদের তৈরি সেই হীরা, যাদের আমরা মসৃণ করার দায়িত্ব নিয়েছি। যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, আমি চাই আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো নাগরিক হোক। শুধু দেশের জন্য নয়, বিশ্বের জন্যও। শিক্ষা তো মানবতার জন্যই। আমি আমাদের শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করতে চাই, যেন বিশ্বের মানুষ জানে, বাংলাদেশে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এখানে আমি থাকব মাত্র চার বছরের জন্য। অতএব আমাকে এমন একটি পরিকল্পনার কথা ভাবতে হবে, যেটা প্রায়োগিক।
আপনি বিশ্ব মানচিত্রে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অবস্থান তৈরি করতে চাইছেন। সে জন্য আসলে কী করণীয়?
আমি তিনটি বিষয়ের কথা বলব। প্রথমত, আন্তর্জাতিকীকরণ। জনবলের দিক থেকে আপনাকে আন্তর্জাতিক হতে হবে। আন্তর্জাতিক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মী। কেন আন্তর্জাতিকীকরণ দরকার? কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি আলোচনার জায়গা। আলোচনা করতে হলে আপনাকে সব দরজা খুলে দিতে হবে। আমি যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে কার পদ বড়, কে ছোট—এসবের পরোয়া করি না। যখন প্রথম এলাম, স্টুডেন্ট সার্ভিস একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। তারা লিখেছিল, ‘স্বাগত মাননীয় উপাচার্য’। আমি বলেছি, ‘মাননীয়’ শব্দটা সরিয়ে দিন। যতটা সম্ভব কম বিশেষণ ব্যবহার করুন। এই বিশেষণগুলোই পদবিভেদ তৈরি করে। আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের আমি বলি, আমাকে সুখবর দেবেন। আমাকে খারাপ খবরও দেবেন। খারাপ খবর না শুনলে তো মানুষ বুঝতে পারবে না কোথায় উন্নতি করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক মান। কিছু কিছু বিষয়ে আমরা জোর দিতে পারি। যেমন জনস্বাস্থ্য। এ বিষয়ে আমাদের আরও বেশি গবেষণা করা উচিত। এমআইটিতে একটি খুব বিখ্যাত প্রোগ্রাম আছে, যার নাম ‘পভার্টি ল্যাব’। কিন্তু এই গবেষণা তো এমআইটির চেয়ে এখানে ভালো হওয়ার কথা। কারণ, দারিদ্র্য দেখতে হলে এমআইটি থেকে উড়ে তাদের ভারত, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে আসতে হয়। ব্র্যাক এখন পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কোটি মানুষকে সহায়তা দিয়েছে। তার মানে ব্র্যাকের কাছে সাড়ে ১৩ কোটি মানুষের গল্প আছে। এটা শুধু গল্প নয়, একেকটি অভিজ্ঞতা। এই গল্প, এই অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানে রূপান্তর করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন দেখুন, সারা বিশ্বে গ্রামীণ ব্যাংক যতটা পরিচিত, ব্র্যাক ততটা নয়। কারণ, আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগেও ক্লাসরুমে আমাদের গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে পড়ানো হয়েছে। গল্পকে আপনি যখন সংক্ষেপ করবেন, সেটি একটি তত্ত্বে পরিণত হবে। তখন এই গল্পই হবে আপনার জ্ঞানের অংশ। তৃতীয় হলো, শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা। ক্যাম্পাসে পা রাখা এবং গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বের হয়ে যাওয়ার মাঝামাঝি সময়টাতে একজন শিক্ষার্থী কী কী অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে ভরছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু পড়ালেখা নয়, তাদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হতে হবে, শৃঙ্খলার শিক্ষা নিতে হবে। যেমন ধরুন, আজ সকালেও আমি যখন এসেছি, শিক্ষার্থীরা তখন লিফটে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একজন ছাত্রী বলল, ‘স্যার আপনি সামনে যান।’ আমি বললাম, ‘না।’ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারি, কিন্তু নিয়ম আমার জন্যও সমান। এটা হয়তো খুব ছোট্ট একটা বার্তা, কিন্তু এই বার্তাটা আমি তাদের দিতে চাই।
আমাদের অনেক তরুণই লক্ষ্য ঠিক করতে গিয়ে দ্বিধায় ভোগেন। তাঁদের জন্য আপনার কী পরামর্শ?
পড়ার বিষয় যেকোনো কিছুই হতে পারে। প্রকৌশল, ইংরেজি, বায়োটেকনোলজি। কিন্তু তাদের জানতে হবে, তারা আসলে কী করতে চায়। কোন বিষয়টি তোমাকে ভাবায়? কী স্বপ্ন তুমি দেখো? তোমার ভালো লাগাটা খোঁজো। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। কারণ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা কেউ বলতে পারবে না। সমাজের ওপর তুমি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে না। তুমি যা পারো, সেটা হলো তোমার চিন্তার পরিধিটা বড় করতে পারো। ভাবনার জায়গা থেকে আন্তর্জাতিক হও।
এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?
মূল চ্যালেঞ্জটি হলো মানসিকতার। আপনি দুই ধরনের মানুষ পাবেন। একধরনের মানুষ বলবে, ‘নাহ, এটা বোধ হয় সম্ভব নয়। আমরা পারব না।’ আরেক দল বলবে, ‘ঠিক আছে। চেষ্টা করেই দেখা যাক।’ আমাদের প্রয়োজন দ্বিতীয় ধরনের মানুষ—যাঁদের মধ্যে ‘পারব’ মানসিকতা আছে। এ ছাড়া আমাদের কিছু অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা আছে। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর চলে। কিন্তু এভাবে টিকে থাকা কঠিন। কীভাবে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর নির্ভরতা কমিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে, সে রকম একটি ভিন্ন অর্থনৈতিক মডেলের কথা আমরা ভাবছি।