রাগ কমালে বাড়বে আয়ু
জাপানে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর নাম চিতেতসু ওয়াতানাবে। ১১২ বছর বয়সে তিনি জাপানের নিগাতা শহরে মারা যান। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে স্থানীয় একটি পত্রিকা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল দীর্ঘজীবন বেঁচে থাকার রহস্য কী? উত্তরে ওয়াতানাবে বলেছিলেন, ‘রাগ না করা আর সব সময় হাসিমুখে থাকা!’
আসলেই কি তাই? রাগ না করলেই দীর্ঘায়ু পাওয়া যাবে? হাসিই কি বহু বছর বেঁচে থাকার একমাত্র কৌশল?
বিষয়টি এত সরল নয়। তবে এ কথা সত্যি যে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল আর হাসিমুখ আপনাকে প্রাত্যহিক অনেক মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখবে। আর যেসব প্রাণঘাতী রোগের উৎস মানসিক চাপ যেমন হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ সেগুলোর থাবা থেকে সহজেই দূরে থাকা যাবে।
রাগ রোগ নয়
‘রাগ’ কিন্তু কোনো রোগ নয়, বরং প্রকৃত সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক একটি আবেগ বা ইমোশন। সুস্থ মনের স্বাভাবিক উপাদান এই রাগ। কোনো উসকানির কারণে সামান্য বিরক্তি থেকে শুরু করে প্রবল উত্তেজনা, রাগে আগুন হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারানো পর্যন্ত এই আবেগের বিস্তৃতি। মানুষের ষড়্রিপুর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে এই আবেগকে রাখা হলেও মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় এবং শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে এটি একটি সাধারণ স্বাভাবিক আবেগ। কিন্তু যদি এই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, যদি এই আবেগ অপরিমিত পরিমাণে প্রকাশ পায় বা যৌক্তিক কারণ ছাড়াই মানুষ রাগ করে তখন দেখা দেয় নানা সমস্যা। মনঃসামাজিক সমস্যা থেকে শুরু করে শারীরিক বিভিন্ন রোগের পরোক্ষ কারণ আসলে রেগে যাওয়া, মানসিক চাপ সামলাতে না পারা।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার ওয়েস্ট ফরেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ চিকিৎসক ক্রিস আইকেন এক গবেষণায় বলেন, ‘তীব্র রাগের দুই ঘণ্টার মধ্যে হৃদ্রোগের আশঙ্কা দ্বিগুণ হয়ে যায়। গঠনমূলক উপায়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ হৃদ্যন্ত্রের জন্য ভালো।’ যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় তীব্র রাগ স্ট্রোকের (মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধা বা রক্তক্ষরণ) ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়া অতিমাত্রায় রাগ ‘ইমিউনিগ্লোবিউলিন-এ’–এর ওপর প্রভাব ফেলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় বলে বিভিন্ন গবেষায় দেখা গেছে। রাগ থেকে অতি উদ্বেগ, বিষণ্নতাসহ নানা রকম মানসিক রোগও হতে পারে। রাগ কখনো কখনো দুর্ঘটনার কারণও হতে পারে।
রাগের অনিয়ন্ত্রিত প্রকাশ নয়
রাগ যাতে ক্ষতিকর আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ না পায়, সে জন্য মার্কিন বিজ্ঞানী চার্লস স্পিয়েলবার্গার তাঁর গবেষণায় বলেছেন, রাগকে পুরোপুরি চেপে রাখা যাবে না, আবার একবারে দমন করা যাবে না। কারণ, অবদমিত রাগ থেকে হতে পারে নানা মানসিক ও শারীরিক সমস্যা—যেমন বিষণ্নতা, উচ্চ রক্তচাপ, খিটখিটে মেজাজ, ব্যক্তিত্বের সমস্যা। রাগের প্রকাশ হওয়া উচিত গঠনমূলক (কনস্ট্রাকটিভ), দৃঢ় (অ্যাসারটেটিভ), কিন্তু মোটেই আক্রমণাত্মক (অ্যাগ্রেসিভ) নয়। যে বিষয়টি নিয়ে রাগ হচ্ছে সেটিকে কেবল নিজের দিক থেকে না দেখে আরেকজনের দৃষ্টিতেও দেখতে হবে, এতেই কিন্তু বিষয়টি উপস্থাপিত হতে পারে ভিন্নমাত্রায়, বদলে যেতে পারে আপনার রাগের প্রকাশভঙ্গি আর আচরণ। এর অর্থ হচ্ছে রাগ কিন্তু সম্পূর্ণ চেপে রাখা যাবে না, জার্মান এক গবেষণায় দেখা গেছে যাঁরা রাগ চেপে রাখেন, মনের মধ্যে পুষে রাখেন তাঁদের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তচাপ ওঠানামা করে, তাঁদের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দেয়!
মুখে হাসি সব সময়
সদ্য পরলোকগত দীর্ঘায়ু ব্যক্তি ওয়াতানাবে কিন্তু এও বলেছেন যে রাগ না করার পাশাপাশি মুখে হাসি ধরে রাখতে হবে। জাপানে মরিগোচি কেজেনকাই হাসপাতালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের হাসিমুখ ছোট শিশুদের চর্মরোগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। হাসি কখনো কখনো শরীরের ব্যথা কমায়, মানসিক চাপ (স্ট্রেস) দমন করে—রক্তচাপ আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
সব সময় হাসিমুখে থাকুন। সামাজিক দক্ষতা বাড়ান, রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন। এতে শারীরিক–মানসিক নানা রোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন। দীর্ঘায়ু হয়ে ওয়াতানাবের মতো নাম লেখাতে পারবেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
আহমেদ হেলাল
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
>রাগ নিয়ন্ত্রণ যেভাবে
জরুরি কথা হচ্ছে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন, কিন্তু রাগ চেপে বা পুষে রাখবেন না। রাগ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার অর্থ কিন্তু রাগ নিয়ন্ত্রণ করা নয়। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার প্রকৃত মানে হচ্ছে রাগের ঘটনার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। আবার প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যুক্তিগ্রাহ্য রাগের প্রকাশও করতে হবে।
● চট করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন না। বিকল্প চিন্তা করার কৌশল রপ্ত করুন। কোনো একটি ঘটনা দেখেই যেন আপনার মন একপেশে সিদ্ধান্ত না নেয়। ঘটনার পরম্পরা আর পারিপার্শ্বিকতাকে বুঝে আবেগের প্রকাশ ঘটান।
● যেকোনো বিষয় যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করুন।
● রাগের কারণ ঘটলে নিজের শরীরকে কিছুটা শিথিল করে ফেলুন—বড় করে শ্বাস নিন, কোনো গঠনমূলক ছোট বাক্য, যেমন ‘ঠিক আছে’, ‘শান্ত হও’ বারবার উচ্চারণ করতে পারেন।
● প্রতিদিন মুক্ত বাতাসে হাঁটুন, বড় করে শ্বাস নিন।
● মাঝে মাঝে প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটান এবং তাদের নিয়ে অবসরে বেড়িয়ে আসুন।
● অভিভাবকেরা কখনোই শিশুদের সামনে রাগ করবেন না।
● নিজেকে সময় দিন। নিজেকে নিয়ে ভাবুন, সারা দিনে কী করলেন বা কী করবেন, সেটা মনের মধ্যে সাজিয়ে নিন।
● হাসার অভ্যাস করুন।
● যেকোনো ধরনের মাদক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ মাদক গ্রহণ করলে আবেগ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা কমে যায়।
● বিষণ্নতা, অবসেসন, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, শিশু–কিশোরদের কন্ডাক্ট ডিস–অর্ডার ইত্যাদি মানসিক সমস্যার কারণে অস্বাভাবিক রাগ হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নিন।