মাসু আঁকে, মাসু পড়ে, মাসু পুরস্কারও জেতে
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে মাসুদা খানের ছবি আঁকার ভিডিওগুলোয় দর্শকসংখ্যা বেশ ভালো। ভার্চ্যুয়াল জগতে অনেকেই তাঁকে চেনেন ‘মাসু আকে’ নামে। মাসু কখনো গাছ আঁকেন, কখনো চোখ, ফুল, কিংবা বাতাস। তবে আজ কথা হবে মাসুদার এক বিশেষ অর্জন নিয়ে। তিনি সম্প্রতি জিতেছেন ‘দ্য গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’, যা বিশ্বব্যাপী ‘জুনিয়র নোবেল প্রাইজ’ হিসেবেও পরিচিত।
গবেষণা এনে দিল পুরস্কার
‘হ্যালো! মাসু আঁকে একটা ডিম!’—এই বলে ছবি আঁকার প্রথম টিউটরিয়াল ভিডিওটি বানিয়েছিলেন মাসুদা খান। আঁকাআঁকি নিয়ে নিজের ফেসবুক পেজের নাম দিয়েছিলেন “জলতরঙ্গ: মাসু আকে’স আর্ট জার্নাল”। সেই ডিম আঁকা দিয়ে শুরু করে এখন মাসুদার ছবি আঁকার ভার্চ্যুয়াল স্কুলে অনুসারীর সংখ্যা এক লাখ। তাঁর পেজে ঢুঁ মারলে মনে হবে, মেয়েটির সারা দিন কাটে বুঝি রংতুলি আর ক্যানভাসের আড়ালে।
কিন্তু মাসুদার দিনের অনেকটাই দখল করে রাখে ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট আর প্রজেক্ট জমা দেওয়ার তাড়া। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক করছেন মাসুদা খান। জানুয়ারি মাসে তাঁর স্নাতকের একটি কোর্সের জন্য তৈরি করা গবেষণাপত্র ‘সিডিএ অন দ্য রোহিঙ্গা ক্রাইসিস: ইউনুস ভার্সেস সুকি’ জমা দিয়েছিলেন ‘দ্য গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ আয়োজনে। এই আয়োজনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হলো সম্প্রতি। জানা গেল, মাসুদার গবেষণাপত্রটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ২ হাজার ৪৮৯টি সাবমিশনের মধ্য থেকে এশিয়া বিভাগের ‘লিঙ্গুয়েস্টিকস’ (ভাষাতত্ত্ব) শাখায় সেরা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন আরও একজন। আর্কিটেকচার অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগে নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তাসনীম জারিন।
‘দ্য গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’ আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি. হিগিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অধীনে আয়োজিত হয়। ২০০৮ সাল থেকে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এতে ২৫টি শাখায় স্নাতক শিক্ষার্থীদের তৈরি গবেষণাপত্রের মূল্যায়ন করা হয় এবং ইউরোপ, আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সেরা গবেষকদের পুরস্কৃত করা হয়। শুরুতেই ঘোষণা করা হয় ‘হাইলি কোমেন্ডেড’ বিভাগের বিজয়ীদের নাম। প্রতিবছর এই আয়োজনে জমা পড়া গবেষণাপত্র থেকে সেরা ১০ শতাংশ গবেষকের কাজ এই বিভাগে স্বীকৃতি পায়।
স্কুল বদলেছেন ১৩ বার!
মাসুদার জন্ম ইতালিতে। তাঁর মা-বাবা ইতালিপ্রবাসী। ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ইতালিতে ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় ইতালীয় ভাষাতেই কথা বলতেন। বাংলা আর ইংরেজি জানতেন না বলে বাংলাদেশে এসে স্কুলে ভর্তি হলে তৃতীয় শ্রেণিতে ফেল করে বসেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বললেও পড়তে পারতেন না একেবারেই। পরে মামির কাছে কোনোরকমে বর্ণমালা শিখে পত্রিকা আর রাস্তার সাইনবোর্ড পড়ে পড়ে একসময় বাংলা শিখে ফেলেন মাসুদা। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মাসুদা এ লেভেল, ও লেভেল পাস করেন প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে। মাঝে একটা সময় ভারতে বোর্ডিং স্কুলেও ভর্তি করা হয় তাঁকে। হিসাব মিলিয়ে মাসুদা বলেন, ‘আমি জীবনে ১৩টা স্কুল বদলেছি।’
এত জায়গা বদলের মধ্য দিয়ে স্কুল, এ লেভেল, ও লেভেলের গণ্ডি পেরোনোর পর তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। ইতালিপ্রবাসী মা তাঁকে সে দেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। পরিকল্পনা ছিল, সেখানে গিয়ে রান্নার ওপর ডিপ্লোমা করবেন মাসুদা। কিন্তু সব পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত, তখন তাঁর মনে হলো—একটা ক্যাম্পাসজীবন লাগবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা লাগবে। তাই কাউকে না জানিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন, ইংরেজি বিভাগে টিকেও যান। তাঁর আগ্রহ দেখে পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, দেশেই স্নাতক করবেন মাসুদা।
মাসুদা খানের আরও একটা পরিচয় আছে। ‘মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ ২০২০’ প্রতিযোগিতার সেরা ১০-এর তালিকায় ছিলেন তিনিও। র্যাম্পে হেঁটেছেন খালি পায়ে! এ ছাড়া মডেল হিসেবে তাঁকে দেখা গেছে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির ভিডিওতেও। এর আগে শিল্পী হিসেবে তাঁর আঁকা ছবি স্থান পেয়েছিল উন্মাদ ম্যাগাজিনের ৪০ বছর পূর্তির বিশেষ প্রদর্শনীতে। বৈচিত্র্যময় অর্জনে ভরা তাঁর জীবন। ছবি আঁকার খাতার মতো এই অর্জনগুলোও রঙিন।