মহামারিতে মহামতিরা যা করেছিলেন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত মার্চ মাসের ১১ তারিখ কোভিড-১৯ রোগকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকেই ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিনে থাকার মতো বিধি-নিষেধ। নতুন করোনাভাইরাসে সৃষ্ট এই রোগ বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রায় আকস্মিক ও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। চলছে এখন ঘরবন্দী জীবন যাপন।
তবে এমন মহামারি কিন্তু আগেও বারবার এসেছে। বারবার এমন মহামারির ছোবলে লন্ডভন্ড হয়েছে মানুষের জীবন। কিন্তু রোগ কখনো জীবনকে থমকে দিতে পারেনি। যেমন ধরুন বিশ্বখ্যাত সুরকার মোৎসার্টের কথা। ১৭৬৭ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে গুটিবসন্তের আক্রমণে সাময়িকভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি তাঁর সুরের সাধনা।
আসুন, জেনে নেওয়া যাক এমন কয়েকজন মহামতির কথা, যাঁরা কিনা মহামারির দিনগুলোতেও থেমে যাননি। বরং আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন বিশ্বমঞ্চে।
জিওভান্নি বোকাচ্চো
এই কবি ও লেখকও মহামারির কবলে পড়েছিলেন। ১৩৪৮ সালে যখন ইতালির ফ্লোরেন্সে ছড়িয়ে পড়েছিল প্লেগ, তখন বোকাচ্চোর বাবা ও সৎমা এর শিকার হয়েছিলেন। বোকাচ্চো অবশ্য গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। ওই সময়টায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন জিওভান্নি বোকাচ্চো। লিখেছিলেন কয়েকটি নভেলার একটি সংকলন ‘দ্য ডেকামেরন’। তাতেও ফুটে উঠেছিল মহামারির সময়কার বাস্তবতা। ছোটগল্পের ইতিহাসে যে কয়েকজন লেখককে পথিকৃতের আসনে বসানো হয়, জিওভান্নি বোকাচ্চো তাঁদের অন্যতম। বলা হয়ে থাকে, প্লেগ থেকে বাঁচতে গ্রামে পালিয়ে গিয়ে ‘দ্য ডেকামেরন’ নামে ছোটগল্পের পূর্বপুরুষদের নিয়ে বোকাচ্চো যে সংকলন তৈরি করেছিলেন, তার পরের ৬০০ বছর বরেণ্য লেখকেরা তাকে একটা অবয়বের মধ্যে এনে তার পালে শুধু হাওয়া দিয়ে গেছেন।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
একটা সময় মানুষের সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু ছিল বুবোনিক প্লেগ। কয়েক বছরের নিয়মিত বিরতিতে বারবার ফিরে ফিরে আসত এই প্লেগ। জগদ্বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি, নাট্যকার ও অভিনেতা উইলিয়াম শেক্সপিয়ার একাধিকবার পড়েছিলেন মহামারির ফেরে। কিন্তু কোনোবারই তিনি থমকে যাননি। গবেষকদের বক্তব্য, ১৫৯২-৯৩ সালের মহামারির সময় বেশ কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন শেক্সপিয়ার। ধারণা করা হয়, ১৬০৩-৪ সালের মহামারিতে তিনি লিখেছিলেন ‘মেজার ফর মেজার’। গবেষকদের বক্তব্য, সম্ভবত ১৬০৬ সালে যখন আবার বুবোনিক প্লেগ মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, তখন বাড়ি বসে কাটানো সময়টা শেক্সপিয়ার ব্যয় করেছিলেন ‘কিং লেয়ার’-এর পেছনে। ওই বছর শেষ হওয়ার আগেই আরও কিছু সৃষ্টি সম্পন্ন করেছিলেন শেক্সপিয়ার। ধারণা করা হয়, ১৬০৬ সালেই শেষ হয়েছিল ‘ম্যাকবেথ’ ও ‘অ্যান্টোনিও অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’ লেখার কাজ।
থমাস ন্যাস
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের সময়কার আরেক বিখ্যাত নাট্যকার ছিলেন থমাস ন্যাস। ১৫৯২ সালে যখন লন্ডনে বুবোনিক প্লেগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ন্যাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে চলে গিয়েছিলেন গ্রামাঞ্চলে। ওই সময়েই তিনি লিখেছিলেন ‘সামার’স লাস্ট উইল অ্যান্ড টেস্টামেন্ট’। এই নাটকে তিনি তুলে ধরেছিলেন মহামারির সময়কার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। যুক্তরাজ্যেই ১৬০১ সালে এই নাট্যকার মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
আইজ্যাক নিউটন
১৬৬৫ সালের কথা। আইজ্যাক নিউটন তখনো বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেননি। তাঁর বয়স ছিল মোটে বিশের কোটায়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন তখন নিউটন। ওই সময়ও ইংল্যান্ডে আঘাত হেনেছিল বুবোনিক প্লেগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বাতিল হয়ে যাওয়ায় জীবন বাঁচাতে নিউটন চলে গিয়েছিলেন তাঁদের পারিবারিক এস্টেটে। বলা হয়ে থাকে, কোয়ারেন্টিনের এই সময়টাতেই নিজের মেধার শিখরে পৌঁছেছিলেন আইজ্যাক নিউটন। লিখে ফেলেছিলেন ক্যালকুলাসের আগমনী সংগীত। নিজের ঘরে বসে প্রিজম নিয়ে খেলাধুলা করতে করতে আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন আলোক তরঙ্গের নানা তত্ত্ব। মজার ব্যাপার হলো, এই সময়টাতেই মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে দিয়েছিলেন নিউটন। আর তা থেকেই পরে আসে এ–সংক্রান্ত বিখ্যাত তত্ত্ব।
এডভার্ড মুংখ
‘দ্য স্ক্রিম’, ‘ম্যাডোনা’, ‘ভ্যাম্পায়ার’, ‘দ্য ড্যান্স অব লাইফ’ প্রভৃতি চিত্রকর্মের জন্য বিখ্যাত নরওয়ের এই চিত্রশিল্পী। তিনি ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মোকাবিলা করেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই মহামারি মোকাবিলা করেছিলেন মুংখ। স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এই মহামারিতে বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ধারণা করা হয়, স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তিস্থল ছিল চীনে। ১৯১৮ সালের শুরুর দিকে এই ফ্লু উত্তর আমেরিকায় দেখা দেয় এবং পরে ইউরোপে ছড়ায়। স্পেনের মাদ্রিদে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর এর নাম হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। এডভার্ড মুংখ ১৯১৯ সালের শুরুর দিকে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শারীরিকভাবে একটু সামলে ওঠার পর পরই তিনি আঁকতে বসে যান। ওই সময়টায় নিজের আত্মপ্রতিকৃতি আঁকায় মনোযোগ দিয়েছিলেন মুংখ। তখনকার ছবিগুলোতে মুংখকে দেখা গিয়েছিল কৃশকায় রূপে। তাঁর মুখভঙ্গি ছিল ভীত। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবে ছবি আঁকা চালিয়ে গিয়েছিলেন মুংখ। অবশেষে ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে বিশ্বে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে।
মহামারিতে মহামতিরা অনেক কিছু করেছিলেন। এই করোনাকালে আপনি কী করছেন, যা করোনাকালকে অতিক্রম করে আপনাকে স্মরণীয় করে রাখবে?
তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য আটলান্টিক, মেন্টাল ফ্লস, দ্য গার্ডিয়ান, স্মিথসোনিয়ান ম্যাগ ডটকম, ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ও শেক্সপিয়ার অ্যান্ড বিয়ন্ড ডট ফোলজার ডট এডু