মনের ডায়েটের কথা শুনেছেন কখনো
ডায়েটের কথা শুনলেই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে নিয়ম মেনে অল্প করে খাওয়া। আর ঘাম ঝরানোর শারীরিক কসরত। তবে আমরা যা খাচ্ছি, কেবল তার ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয় ডায়েট। আমরা কী শুনছি, কী দেখছি বা পড়ছি, কাদের সঙ্গে চলছি, বন্ধুদের আড্ডায় কী নিয়ে যুক্তিতর্ক আর গল্প করছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাদের অনুসরণ করছি—সেসবও কিন্তু ডায়েটেরই অংশ। কারণ, আমাদের চিন্তাভাবনার জগতের এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে আমাদের পারিপার্শ্বিক মানুষের প্রভাব। আর চিন্তাভাবনার সঙ্গে জড়িত এই ডায়েটকেই বলে মেন্টাল ডায়েট।
তাই ডায়েট শুধু খাবারের ওপর নির্ভর করে না। আর এটুকু বুঝতে পারলেই আপনার কাছে ডায়েটের সংজ্ঞা পরিবর্তন হতে বাধ্য! ব্যস্ততায় মোড়া জীবনে আমরা বেশির ভাগ সময়ই নিজের দিকে তাকানোর সময় পাই না। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাকে আমরা প্রতিনিয়ত পাশ কাটিয়ে যাই। কাজের চাপে ভুলে যেতে হয় নিজের একান্ত অনুভূতিগুলো। আমাদের কাছে শারীরিক সুস্থতা যতটা প্রাধান্য পায়, মানসিক সুস্থতা যেন ততটাই অবহেলিত। আর ধীরে ধীরে এভাবেই দানা বাঁধে উদ্বেগ, বিষণ্নতা, অবিশ্বাস আর আত্মসন্দেহের প্রবণতা।
খাদ্যভ্যাসে পরিবর্তন এনে, ব্যায়াম করে শরীরকে সুস্থ রাখা যায়—এ কথা কমবেশি সবাই আমরা জানি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শরীরের মতোই মনকে সুস্থ রাখতে প্রয়োজন চিন্তায় লাগাম টানা। নেতিবাচক চিন্তা, দুশ্চিন্তাকে দূর করে মনকে শান্ত রাখাটাই এখানে মুখ্য। মন-মস্তিষ্কে যাতে ইতিবাচকতার চর্চা হয়, সৃজনশীলতার ফলন ঘটে, সে জন্য যা কিছু করা হয়, সেটিই মেন্টাল ডায়েট। মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা অর্জন করার পদ্ধতিই মেন্টাল ডায়েট।
চলুন জেনে নিই নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখার কয়েকটি উপায়
১. আমরা কী চিন্তা করছি, বেশির ভাগ সময়ই তা আমাদের চারপাশের মানুষ, আলোচনা, কী পড়ছি, কী দেখছি—এই সবকিছু দ্বারা প্রভাবিত। যখন চিন্তা করছেন খেয়াল করুন কী ভাবছেন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি যা ভাবছেন, সেটি কি আপনার জন্য কোনো উপকারী চিন্তা? যদি সেই চিন্তায় কোনো ইতিবাচক ফল না আসে, তাহলে বাদ দিন। ‘আমরাই আমাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করি’—এটা মেনে নিন। হয়তো ভাবছেন, চিন্তা কি নিয়ন্ত্রণ করা যায়? চিন্তা করতে না চাইলেও তো চিন্তা এসে ভর করে। কিন্তু আপনার মনে কী চলছে, এ ব্যাপারে যদি আপনি সতর্ক থাকেন, তাহলেই চিন্তার লাগাম টেনে ধরতে পারবেন। মাঝে মাঝে চিন্তা করার সময় চিন্তাগুলো কাগজে লিখে রাখুন। কোনো এক অলস বিকেলে সময় করে সেগুলো পড়ে দেখলে নিজেই অবাক হবেন!
২. মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে মন ভালো রাখার বিকল্প নেই। মন ভালো থাকলে সব কাজই আনন্দের মনে হয়। মন ভালো রাখতে তাই বেছে নিন নিজের পছন্দের কোনো শখ। সিনেমা দেখা, বই পড়া, ছবি আঁকা, গান শোনা, ঘুরে বেড়ানো, উইন্ডো শপিং—স্বল্প সময়ের জন্য হলেও হারিয়ে যেতে পারেন অন্য এক দুনিয়ায়। অনেক সময় কাছের বা দূরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেও খুব সহজেই ‘ইমোশনাল রিলিফ’ হয়। ঘুরে আসতে পারেন নতুন কোনো জায়গার, নতুন কোনো পরিবেশ থেকে। এতে মানসিক ক্লান্তি অনেকটাই বিলীন হয়ে যায়। পাওয়া যায় নিজেকে নিয়ে ভাবার সুযোগ, জীবনটাকে নতুন পরিপ্রেক্ষিতে দেখার সু্যোগ।
৩. মাথার চিন্তা কোনোভাবেই দূর করতে পারছেন না? নিজের সঙ্গে খেলতে পারেন একটি মজার খেলা। যেসব চিন্তা আপনাকে দুঃখ দিচ্ছে বা অসুখী করে তুলছে, সেগুলো ভাবা থেকে বিরত থাকুন। বদলে ইতিবাচক কোনো কিছু ভাবুন। মনকে বশে আনা দায়। তবে অসম্ভব নয়। চেষ্টা করলে ঠিক পারবেন। আপনার মন যতই খারাপ চিন্তা করতে চাইবে, ততই এটিকে আপনি রূপান্তরিত করুন ইতিবাচক, সৃজনশীল কোনো চিন্তায়। অথবা সেই সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখুন শিক্ষামূলক কোনো কাজে। প্রথম দিকে কাজটি মোটেও সহজ হবে না। তবে হার না মেনে চালিয়ে যান এই অনুশীলন। ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠবেন নিজের চিন্তার নিয়ন্ত্রণে।
৪. মনকে সুস্থ রাখতে ইতিবাচক চিন্তার কোনো বিকল্প নেই। তবে টেলিভিশন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পর্দায় ভেসে আসা ঘৃণা বা বিদ্বেষমূলক খবর চাইলেও আমরা না দেখে থাকতে পারি না। এ ক্ষেত্রে মানসিক শান্তি ফিরে পেতে কমিয়ে আনতে পারেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার। এতে আপনি অনেকাংশেই মুক্ত হয়ে যাবেন নেতিবাচক খবরের প্রভাব থেকে। অবার অন্যের প্রতি রাগ, হিংসা বা বিদ্বেষ পুষে রাখাও আমাদের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এসব ক্ষেত্রে ক্ষমাশীল হোন।
৫. মেন্টাল ডায়েটের অন্যতম পথ মনোযোগী হওয়া। শুনতে অবাক লাগলেও ভেবে দেখুন, আমরা দিনের বেশির ভাগ কাজই করি স্বয়ংক্রিয়ভাবে। চেয়ারে বসা, মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে ঢুঁ মারা, পানি খাওয়া, হাঁটা, এমনকি রান্নার মতো কাজও আমরা করে ফেলি অবচেতন মনে। মনোযোগ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, বর্তমানে থাকা। যে কাজ করছেন, সে কাজটিই একাগ্রতার সঙ্গে করা। আর এভাবেই মনের অজান্তে চলে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত চিন্তা আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। একাগ্রতা বাড়াতে মেডিটেশন বা যোগব্যায়ামও করতে পারেন। মন দিয়ে অন্যের কথা শোনার অভ্যাস করুন।
মেন্টাল ডায়েট যেন একটা চিন্তার ছাঁকনি! এটি দেখতে থাকে আপনার চিন্তাভাবনাকে আর সিদ্ধান্ত নেয় কোন চিন্তাটি প্রাধান্য পাবে। আর দিন শেষে আপনি যে চিন্তাটি বেছে নেন, আপনি যেন এগিয়ে যান সেই পথেই। তাই সুস্থ্ ও সুন্দর মনের জন্য ‘মেন্টাল ডায়েট’-এর বিকল্প নেই।
সূত্র: হেলথ শটস, জিজিস অ্যাডভেঞ্চার ও কিডিপিডিয়া।