বেড়াই বর্ষায়
>এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রুপালি জল কতো দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ—বুলিয়ে দিয়েছে চুল—চোখের উপরে
তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কতো খেলিয়াছে...
জীবনানন্দ দাশের এই কবিতা এখন ফেসবুকে কত কত স্ট্যাটাস হয়ে ফিরে আসে। সঙ্গে বৃষ্টিভেজা একটা ছবি—পূর্ণতা আসে ঘনঘোর বর্ষার।
একটা সময় বেড়ানো মানেই ছিল শীতকাল। আর এখন! পালাবদল হয়েছে বেড়ানোর দিনক্ষণের। কী শীত, কী গরম—ছুটি পেলেই দে ছুট।
বাংলার রূপ যে বর্ষাতেই সবচেয়ে সুন্দর, সে বন্দনা আছে শত লেখকের গল্প, কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ থেকে হুমায়ূন আহমেদ, কার লেখায় নেই বাদলা দিনের বন্দনা। তবে লেখকের দেখার চোখ এখন অনেক সাধারণের মধ্যে প্রভাবিত। আর তাই বর্ষাকাল হয়ে উঠছে ভ্রমণকাল। পাহাড় যেমন এখন সবুজে ঘেরা, সমুদ্রও যেন আরও বেপরোয়া। শীতের মরা ঝরনাগুলো বর্ষায় ফিরে পায় যৌবন।
বর্ষায় গ্রামগুলো যেন হয়ে ওঠে একেকটি অপূর্ব পর্যটন কেন্দ্র। তেমনই এক পরিকল্পনা নিয়ে বাদলা দিনে আমাদের বেরিয়ে পড়া ঢাকার কাছে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে। গ্রামের সরু মেঠোপথ দিয়ে প্রতিদিন না হোক একবেলা তো চলাই যায়। ঢাকা থেকে বেশ ভোরেই বেরিয়েছিলাম আমরা। সকালের নাশতায় নরম সেঁকা রুটি আর পাঁচফোড়ন দেওয়া সবজি খেতে খেতেই সকালের সূর্য উঠল সিরাজদিখান বাজারে। বাজারের পাশেই ইছামতী নদী। নাশতা সেরে নৌকা ভাড়া করলাম। এখানে যেসব নৌকা আছে, সেগুলো অবশ্য বেড়ানোর জন্য নিয়মিত ভাড়া দেওয়া হয় না। তাই রাজি করানো হলো মাঝিকে।
নদীর সঙ্গেই নিমতলা বিল। হালকা স্রোতের নদী থেকেই দেখলাম বিলের জলে ফুটে আছে তারার মতো শাপলা। পানকৌড়ি উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। কচুরিপানা ঠেলে বিলের ভেতর পৌঁছাল নৌকা। সাদা ও নীল শাপলার ফাঁকে ফাঁকে নানা রকম শেওলা পানিতে। ছোট ছোট ডিঙিনৌকা নিয়ে রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শাপলা তুলছে বিক্রেতারা। নৌকা বোঝাই শাপলা নিয়ে ঘাটে যাচ্ছে তারা। স্মার্টফোনে আবহাওয়ার অ্যাপ দেখাচ্ছিল সেদিন বৃষ্টিযোগ রয়েছে। কিন্তু বিলের মধ্যে সকালের তাতানো রোদ অ্যাপের তথ্যকে ভুল প্রমাণ করল। তবে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আবার রোদের সঙ্গে মেঘের লুকোচুরি শুরু হলো। দূরের নৌকা থেকে ভেসে আসা ‘আমি তো ভালা না...’ গানটা শুনছিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এল বৃষ্টির ঝাপটা। চুল থেকে নখ ভিজিয়ে দিয়ে আবার সে উধাও।
শাপলার বিল থেকে বেরিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য ভাসান চরের পদ্মহেম ধাম। ইছামতী নদী ধরেই এগোতে থাকি আমরা। দুই পাশে লম্বা লম্বা ধঞ্চেগাছে হলদে ফুলের ছোপ। সবুজ গাছপালা আর চমৎকার নকশার টিনের ঝালর দেওয়া বাড়ি। আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আমরা যে ঘাটে এসে থামলাম, সেখানে তিন দিক থেকে এসে মিলেছে ইছামতী।
রোদের তেজ আরও বেড়েছে, তবে ভাসান চরের লালন সংগীত প্রতিষ্ঠান ‘পদ্মহেম ধাম’ বেশ ছায়ায় মোড়ানো। অনেকখানি জায়গা নিয়ে ঝুরি এলিয়ে থাকা বটগাছের নিচে বসলেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। পাখির ডাক শুনতে শুনতে একদল বালকের মার্বেল খেলা দেখেছিলাম। এর মধ্যে আরেক পশলা বৃষ্টি। একদিকে রোদ, আরেক দিকে বৃষ্টির এই দিনে ছেলেবেলার আওড়ানো ছড়াটাই মনে এল বারবার—‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে, খ্যাঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে।’
বৃষ্টি পেয়ে কাঁচা মাটিতে ফুটে থাকা বুনো ফুলের সঙ্গে একটা সোঁদা গন্ধ এসে নাকে লাগছে। বুনো ফুলের গাছের ভেতর দিয়ে সরু সিঁথির মতো কাঁচা মাটির পথ পেরিয়ে পদ্মহেম ধামের কাঠের দোতলায় এসে বসলাম। পাশের বাড়ি থেকে তুলে আনা কয়েকটা মরিচ দিয়ে ধামের গাছ থেকে পাড়া কামরাঙা মাখিয়ে কাঁঠাল পাতায় তুলে নিলাম। দলের একজন গেল বাজারে। বাজার করে এনে পরিচিত এক বাড়িতে খুদের চালের বোওয়া ভাত (মুন্সিগঞ্জের জনপ্রিয় খাবার) আর কয়েক রকম ভর্তা তৈরি হলো। সেই ফাঁকে নদীতে গোসল সারলাম আমরা। ফুল তোলা সাদা টিনের থালায় শুঁটকি দিয়ে বোওয়া ভাত। আহা কী তৃপ্তি!
খাওয়ার পর দেখলাম চকচকে এক আকাশ। গাঢ় নীল পটভূমির সেই আকাশে তুলার মতো নরম মেঘ। আর নিচে থাকা লালশাকের জমি যেন এক টুকরা লালগালিচা। তেজ কমতে থাকা রোদে ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশ আর জমিনের এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ঝমঝম বৃষ্টি। যেন ষোলোকলা পূর্ণ হলো।
বর্ষার এই সময়, পাহাড়-ঝরনা-সমুদ্রের রূপ যেমন পর্যটক মনকে টানে, তেমনি বাংলাদেশের যেকোনো গ্রাম, যেখানে একটি নদী আছে, তা আপনাকে টানবেই। এ কথা হলফ করেই বলা যায়। একদিন বা একবেলা সময় বের করে শুধু কাটিয়ে এলেই হয়।
ফেরার পথে বিলের পানিতে দেখলাম আগুনরঙা সূর্য। কয়েক মিনিটের মধ্যে যা ঢিমে আঁচের মতো করে তলিয়ে গেল অন্ধকারে। পূর্ণদৈর্ঘ্য একটি চলচ্চিত্রের মতোই যেন নাটকীয় সমাপ্তি।