২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বক্সিং-কন্যা রুকসানা

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিততে লড়ছেন রুকসানা
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিততে লড়ছেন রুকসানা

এত দিন ছিলেন ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়ন। এবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাবও জিতে নিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কিক বক্সার রুকসানা বেগম।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব জয়ের লড়াইয়ে নামার এক দিন আগে স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রুকসানা বলেছিলেন, ‘এই লড়াই হয়তো কিক বক্সিং সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দেওয়ার কারণ হবে। কেননা, অনেকে আমার দিকে তাকিয়ে ভাবেন, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পরিবারের এতটুকুন একটা মেয়ে। আর আমার প্রশিক্ষক তো প্রায়ই মজা করেন আমাকে নিয়ে।’
মনের মধ্যে চেপে থাকা জিদটা বোঝা গিয়েছিল ওই সাক্ষাৎকারেই। শনিবার (২৩ এপ্রিল) যখন রিংয়ে নামলেন, তখন রীতিমতো চোখেমুখে যেন আগুন ঝরছিল রুকসানার। প্রতিপক্ষ ছিলেন সুইডিশ চ্যাম্পিয়ন সুজানা স্যালমি জার্ভি। পাঁচ রাউন্ডের প্রতিটিতে তাঁকে হারিয়ে মুয়ে থাই (কিক বক্সিংয়ের একটি বিশেষ ধরন) বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব জিতে নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রুকসানা বেগম। প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর একাগ্রতার বিজয়ে রচিত হলো আরেকটি নতুন ইতিহাস। ভ্রু কুচকানো মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে গেল রুকসানার বার্তা—‘শারীরিক গড়ন কোনো বিষয় নয়; মনপ্রাণ এক করে চাওয়াটাই বড় ব্যাপার।’
লন্ডনের দ্য রাউন্ড চাপেল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড কিক বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের (৪৮ কেজি ওজনশ্রেণি) বিশ্ব খেতাব জয়ের ওই লড়াই।
২০১০ সাল থেকে ব্রিটিশ মুয়ে থাই (৪৮ থেকে ৫০ কেজি ওজনশ্রেণি) শিরোপা টানা ধরে রাখা রুকসানার এটাই প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব জয়। প্রায় চার বছর ধরে ব্রিটিশ জাতীয় মুয়ে থাই দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা রুকসানা ২০১৩ ও সর্বশেষ ২০১৫ সালের মার্চে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাবের জন্য লড়েছিলেন।

মুয়ে থাই উচ্চমাত্রার শারীরিক কসরতনির্ভর একটি খেলা, যা কিক বক্সিংয়েরই একটি ধরন। থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী এই খেলায় হাত-পায়ের আক্রমণ চলে সমানতালে। কিল-ঘুষি-লাথি দিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে হয়।

৩২ বছর বয়সী এই বক্সিং-কন্যা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ের বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুই দফা পরাজয়ের অভিজ্ঞতা থেকে এবার নিজেকে বেশ পরিণত মনে হচ্ছিল। তাই মনোবলটাও ছিল প্রবল এবং হারের কথা মোটেও ভাবিনি।’
লন্ডনের সেভেন কিংস এলাকায় জন্ম নেওয়া রুকসানার বাংলাদেশে আদি বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে। আওলাদ আলী ও মিনারা বেগম দম্পতির তিন ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে রুকসানা দ্বিতীয়। পেশায় কিক বক্সার হলেও রুকসানা পড়াশোনা করেছেন স্থাপত্য বিষয়ে।
বক্সার হয়ে ওঠা
বয়স তখন সতেরো কি আঠারো। পূর্ব লন্ডনের একটি ব্যায়ামাগারে ভর্তি হন রুকসানা। সেখানে শখের বশেই একসময় বক্সিং প্রশিক্ষণ শুরু করেন। সুযোগ পান সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, খ্যাতিমান প্রশিক্ষক বিল জাডের কাছে থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী মুয়ে থাই শেখার। শখের খেলাই হয়ে উঠল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। রুকসানা বলেন, শুরুতে কয়েক বছর তিনি বক্সিং শেখার বিষয়টি গোপন রাখেন। ২০০৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনস্টার থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর বিষয়টি পরিবারকে জানান। আক্রমণাত্মক এমন খেলার প্রতি আগ্রহের কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা খুশি হতে পারেননি।

‘ধীরে ধীরে বাবা-মা বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। তাঁরা আমাকে সমর্থন করেন, আমার জন্য মঙ্গল কমনা করেন। “ফাইট”-এ যাওয়ার আগে মা বুকে জড়িয়ে দোয়া করেন, যাতে ‍আমার কোনো ক্ষতি না হয়।’ তবে রুকসানা কখনো নিজের ফাইট দেখাতে বাবা-মাকে নিয়ে যান না। এর কারণ হিসেবে বললেন, মারামারির ওই মুহূর্তগুলো বাবা-মা সহ্য করতে পারবেন না।

বিজয়ী রুকসানা
বিজয়ী রুকসানা

স্বাস্থ্যরক্ষাই বড় কাজ
রুকসানার নিত্যদিনের কাজের মধ্যে স্বাস্থ্য রক্ষা করাই বড় চ্যালেঞ্জ। শরীরের ওজন রাখতে হয় ৪৮ থেকে ৫০ কেজির মধ্যে। এ জন্য শুধু নিয়ম মোতাবেক খাওয়াদাওয়াই নয়, চলে ঘাম ঝরানো নানা কসরত। সপ্তাহে ছয় দিন দুই ঘণ্টা করে চলে ব্যায়াম। আর ফাইটের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তাঁকে ওই ব্যায়াম করতে হয় দিনে দুবার।

আরও যত ব্যস্ততা
রুকসানা কিক বক্সিংয়ের ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। সপ্তাহে প্রতি সোমবার তিনি পূর্ব লন্ডনের চ্যাডওয়েল হিথের ডেন জিমে স্কুলছাত্রীদের জন্য বিনা মূল্যে ‍মুয়ে থাই প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। প্রতি রোববার চলে নারীদের প্রশিক্ষণ। তিনি ফাইট ফর পিস নামে একটি চ্যারিটির মুয়ে থাই প্রশিক্ষক এবং স্পোর্টিং ইকুয়াল নামে আরেকটি দাতব্য সংগঠনের অ্যাম্বাসেডর।

বাংলাদেশের স্মৃতি
১৬ বছর বয়সে রুকসানা সর্বশেষ বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। দাদা দেশে বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেই বাড়ি দেখতেই পরিবারের সঙ্গে তাঁর যাওয়া। তখনকার স্মৃতি হাতড়ে রুকসানা বলেন, ‘দাদা আমাকে একটা বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষগুলো অসাধারণ। আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে যে আদর পেয়েছি, তা ভোলার নয়।’