‘প্রেম হবে হবে অবস্থা’ বলে সাধারণের মধ্যে খুনসুটি মিশ্রিত একটি কথা প্রচলিত আছে। এই ‘হবে হবে’ সময়টায় ছেলেমেয়ের অবয়বে আড়ষ্টতা আর মিহি বোকামির যে ছায়া ফুটে ওঠে, তা তারা দুজন ছাড়া অন্যরা কিন্তু ঠিকই পড়তে পারেন। ভিতু খরগোশ নাকি শিকারি দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে আর ভাবে, তাকে কেউ দেখছে না। এই নব্য প্রেমিক-প্রেমিকাদের অবস্থাও সে সময় অনেকটা এমন হয়।
তনিকা (ছদ্মনাম) একদিন বন্ধুমহলে এমন বোকামি গোপন করতে গিয়ে বলেছিল, ‘আরে ও তো টুটুল ভাই, মেজো ভাইয়ার বন্ধু!’ সহজাত আড়ষ্ঠতা তনিকা আড়াল করতে পারেনি। ফুটে উঠেছিল তার চোখেমুখে। ফুটে উঠবেই না কেন, তথ্য–প্রমাণ নিয়েই তো বন্ধুরা তাকে ‘কাঠগড়ায়’ দাঁড় করিয়েছে। একে একে সেসব উপযুক্ত তথ্য–প্রমাণ হাজির করা হলো। কোনো দিন কোনো বিপণিবিতানে তাদের দেখা গেছে, দেখা গেছে স্টার সিনেপ্লেক্সের টিকিট কাউন্টারের সামনে, পয়লা ফাল্গুনে ফুচকার প্লেট হাতে পলাশির মোড়ে। পাশে বসা একজন তো গোয়েন্দার মতো বলে উঠল, সেদিন যে তোর হোয়াটসঅ্যাপে কল এল, ছবি ভেসে উঠল টুটুল ভাইয়ার, কিন্তু নাম দেখাল শুধুই ‘টুটুল’।
অবস্থা বেগতিক দেখে সহজ স্বীকারোক্তিতে ব্যাপারটা স্বীকার করে নিল তনিকা। জানাল ‘কিছু একটা’ গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে। সেই সঙ্গে এটাও বলে নিল, কথাটা যেন তার ভাইয়ের কান পর্যন্ত না পৌঁছায়। জানতে যেন না পারে পরিবারের অন্য সদস্যরাও।
আমাদের চারপাশে তনিকা আর টুটুলের মতো এমন অসংখ্য গল্পের জন্ম হয়। যে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র, ‘ভাইয়ের বন্ধু’ আর ‘বন্ধুর বোন’। কোনো সম্পর্ক চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগোয়; কোনোটা অঙ্কুরেই হারিয়ে যায়। কেউ কেউ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গিয়ে দেয় চড়া মূল্য, ছিন্ন করতে হয় গোড়ার অনেক সম্পর্ক।
সেই আমলের একজনের বিয়ের গল্পটা বলি। শুনেছি তা এক সহকর্মীর মুখে। সেই নারীর বিয়ের পাত্র ছিলেন তারই বড় ভাইয়ের বন্ধু। ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টন খেলতেন দুজনে। সেই সূত্রে বাসায় অবাধ যাতায়াত। নিবিড়ভাবে দুজনকে চেনাও। সে চেনাজানা আনুষ্ঠানিক প্রেম পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবু ছেলের পরিবারের পক্ষ থেকে যখন বিয়ের প্রস্তাব এল, তখন একটি শব্দই উচ্চারণ করেছিলেন, ‘রাজি’। তবে কি দুজনের মনের গভীরে কিছু টান পড়েছিল? একই গুঞ্জরন শুনেছিলেন কি দুজনই?
তাদের সেই সময়টায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার ছিল না। হুটহাট কারও সঙ্গে পরিচয় কিংবা যোগাযোগ গড়ে ওঠাও ছিল কঠিন। সে ক্ষেত্রে ভাইয়ের বন্ধুদেরই কাছে পাওয়া যেত, পুরুষ হিসেবেও নিবিড়ভাবে চেনার সুযোগ হতো। কারও কারও ক্ষেত্রে হয়তো আপন ভাইয়ের মতোই গড়ে উঠত সে সম্পর্ক। আবার কারওটা মোড় নিত ভালো লাগায়, ভালোবাসায়।
গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মো. জোবায়ের মিয়াও এই কথা বললেন, অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুর বোনকে নিজের বোনের মতোই দেখা হয়। পারিবারিকভাবে কাছে আসার ফলে বোঝাপড়া ভালো হয়। রসায়নটা জমে উঠলে অনেক সময় প্রেম, ভালোবাসা থেকে বিয়ের দিকেও গড়ায়।
তবে বিপত্তি বাধে পরিবারের সম্মতির বিষয়টি সামনে এলে। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্পর্কটা যদি দুই পরিবার স্বাভাবিকভাবে নেয়, স্বাভাবিকভাবে নেয় ‘বন্ধু’ নামের পক্ষটি। তাহলে তো সে সম্পর্ক ইতিবাচক দিকেই গড়ায়। ডা. মো. জোবায়ের মিয়ার ভাষায়, ‘সে সম্পর্কের স্থায়িত্ব আরও বাড়ে।’
কিন্তু বিয়ের প্রশ্নে দুই পরিবার যদি সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে না নেয়; কোনো এক পরিবার কিংবা বন্ধুটিও যদি মনে করে, সরলতার সুযোগ কিংবা কাছে আসার সুযোগে কাজে লাগিয়ে সম্পর্কটা গড়ে তোলা হয়েছে। তাহলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায় পারিবারিক সম্পর্কও।
তাই বন্ধুর বোনের সঙ্গে কিংবা ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করে এগোলে ভালো হয়। যদিও পাদটীকা দিয়ে বলতে হয়, এতশত ভেবে প্রেম হয় না! তবু বন্ধুত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে কিছুটা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতেই পারে। সিদ্ধান্তটা যদি বিয়ের দিকে গড়ায়, সে ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও আভিজাত্যের মতো সামাজিক বিষয়গুলোও দুজনের মাথায় রেখে এগোতে হয়।
এবার আবার ফেরা যাক তনিকা আর টুটুলের কথায়। তনিকা যে বন্ধুদের গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলেছিলেন, বন্ধুরা পইপই করে তা পালন করেছিল। কিন্তু মাস কয়েক পরই তনিকার ভাই, মানে টুটুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেনে গিয়েছিলেন, তার জন্য নির্মম সত্যটি। বাগড়া দিয়ে বসেছিলেন। বন্ধুত্বের সম্মান রক্ষা করতে তনিকার জীবন থেকে টুটুলকেও সরে যেতে হয়েছিল।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, বিচ্ছেদ যেখানে নিশ্চিত, সেখানে আসলে খাপ খাইয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বিচ্ছেদের সেই সময়টায়, যার যার ব্যক্তিগত কাজে সময় দেওয়াটা ভালো। এতে সহজে নিজেকে স্বাভাবিক করা যায়। সম্পর্কের সুতো হয়তো পুরোপুরি ছিঁড়ে ফেলা যায় না, কিন্তু বিচ্ছেদের ব্যথা ভুলে যেতে বন্ধুত্বটা আগের মতো না রাখাই ভালো।