প্রত্যাশার চাপে পড়ে

সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে অতিরিক্ত চাপে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন অনেকে। মডেল: সাব্বিরছবি: সুমন ইউসুফ

রোববার টোকিও অলিম্পিক শেষ হলো। করোনা মহামারির কারণে এবার অলিম্পিক গেমসের স্বাদ ছিল অন্যবারের চেয়ে ভিন্ন। বেশির ভাগ প্রতিযোগিতা হয়েছে দর্শকবিহীন মাঠে। সে কারণেই হয়তো অন্য আয়োজনের তুলনায় এবারের পারফরম্যান্সও ছিল খানিকটা দুর্বল। দর্শকের উৎসাহ যে শক্তি জোগায় ক্রীড়াবিদদের পারফরম্যান্সের ক্ষেত্রে, সেই শক্তির গুরুত্ব ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

এবারের অলিম্পিকের অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে একটু ভিন্নভাবে। রিও অলিম্পিকে চারটি সোনা পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জিমন্যাস্ট সিমন বাইলস নিঃসন্দেহে এই আয়োজনের অন্যতম তারকা। প্রতিযোগিতার মাঝখানেই মানসিক অবসাদ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কারণে বাইলস খেলায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। অলিম্পিকের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা বিরল।

মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত হয়ে জিমন্যাস্টিকসের একাধিক ইভেন্ট থেকে নাম কাটিয়ে বাইলস শেষমেষ একটি ইভেন্টে অংশ নেন। পান ব্রোঞ্জ পদক। হয়তো মানসিক চাপ ছাড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে দুর্দান্ত কিছু করে দেখাতেন। কিন্তু নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি না নিয়ে প্রতিযোগিতা থেকে সরে গিয়ে তিনি আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমার বিবেচনায়, বাইলসের এই কর্ম প্রশংসনীয়।

যুক্তরাষ্ট্রের জিমন্যাস্ট সিমন বাইলস

গত এক দশকে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে ভাবতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে—এ বিষয়ে আমরা এখন আগের থেকে অনেক বেশি অবগত। শরীর খারাপ হলে আমরা যে রকম ডাক্তারের কাছে যাই, ঠিক সে রকম অনেক দিন ধরে মন খারাপ থাকলেও যে সাহায্য বা চিকিৎসার প্রয়োজন—এই বিষয়টি আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো বুঝতে পারি। তবে দৈনন্দিন জীবনে কী করলে আমরা মানসিক সমস্যা এড়াতে পারি, সেটা বোঝার ব্যাপারে হয়তো আমাদের কিছুটা ঘাটতি আছে। সিমন বাইলসের ঘটনা এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারে।

আমরা সামাজিক প্রাণী। ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনে কী করব, সেখানে শুধু নিজস্ব চাহিদা নয়, অন্যদের চাহিদা ও প্রত্যাশা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে কারণেই আমাদের অনেক সময় এমন সব কাজ করতে হয়, যেগুলো হয়তো আমরা নিজেরা চাই না। কিন্তু আশপাশের মানুষকে খুশি করার জন্য আমাদের করতে হয়। সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য করতে হয়।

লক্ষ করলে দেখা যাবে যে অনেক ক্ষেত্রে জীবনের প্রায় শুরু থেকেই আমরা কী করব, সেটার ওপর আমাদের নিজেদের ইচ্ছার চেয়ে বেশি থাকে সামাজিক চাহিদার প্রভাবছাত্রজীবনে কোন বিষয়ে লেখাপড়া করব, পেশাগত জীবনে কোন কাজটা করব, ব্যক্তিগত জীবনে কীভাবে আমাদের সময় ব্যয় করব—দেখা যাবে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের নিজেদের জীবন নিয়ে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক প্রত্যাশা আমাদের সেই সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে দেয়।

খুব সতর্ক না থাকলে দেখা যায় যে আমরা আমাদের জীবনের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। এটাই যখন একটা দুর্বিষহ পর্যায় চলে যায়, তখন আমাদের নানা ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা দেখা দেয়।

আমি বলছি না যে নিজেদের জীবন আমরা কীভাবে চালাব, সে ব্যাপারে আমরা আশপাশের কারও মতামত একদমই গ্রাহ্য করব না। সেটা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু নিজের মন কী চাইছে, সেটা মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে সমাজ, বিশেষ করে বহিরাগত সমাজ যখন আমাদের কাছে কোনো প্রত্যাশা রাখে, তখন তারা সেই প্রত্যাশার ভার অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে পারে না। সামাজিক প্রত্যাশা আমরা কতটা পূরণ করতে পারব, সেটা আমাদের নিজেদের বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে যদি কোনো কারণে আমরা সেই প্রত্যাশা পূরণ না করতে পারি, তাহলে সমাজ সেটা বেশি দিন মনে রাখবে না। সমাজ নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ করার কাজটা যদি আমাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে, সেটার খেসারত অনেক দিন অথবা হয়তো আজীবন দিতে হবে।

অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে খেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া সহজ কাজ নয়। সারা পৃথিবী চেয়েছিল সিমন বাইলসের দিকে। অব্যাহতি নেওয়ার কারণে হয়তো সিমন বাইলসকে অনেক ধরনের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অনেক কটূক্তির শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও সিমন নিজেকে রক্ষা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হয়তো মনে রেখেছেন যে পৃথিবী কাল আরেক খেলোয়াড়কে নিয়ে মেতে যাবে। খেলায় অংশ নেওয়ার কারণে যদি নিজের কোনো ভয়ংকর মানসিক বিপর্যয় ঘটে, সেটা সামলাতে হবে সিমন বাইলসকেই।

আমাদেরও মনে রাখতে হবে, যেকোনো সামাজিক প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে যদি কোনো বিপর্যয় ঘটে, সেটা সামলাতে হবে আমাদের নিজেদেরই। সমাজ বা বাইরের পৃথিবী সেটার দায় কখনই নেবে না। আমাদেরই বুঝতে হবে নিজেদের সুস্থ রেখে আমরা কতটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব। নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্য সিমন বাইলসের মতো ‘না’ বলতে শেখা মাঝেমধ্যে খুব জরুরি।

সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করবেন।

লেখক: অভিনেতা