নেটওয়ার্কিং সম্পর্কে আমার ধারণা যেভাবে বদলে গেল
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম দিন থেকেই শুনেছি, ‘নেটওয়ার্কিং’ একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থী হওয়ায় ক্লাসরুম থেকে বন্ধুদের আড্ডা, সব জায়গায় আলোচনার এক বিশাল জায়গা নিয়ে নিল ‘নেটওয়ার্কিং’ শব্দটি। কোনো সেমিনারে গেলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হবে, কোনো সম্মেলনে গেলে পেশাজীবীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা যাবে—এসব তখন বন্ধুরা প্রায়ই বলত। আমি কিন্তু খানিকটা বিরক্তই হয়েছিলাম, কারণ নেটওয়ার্কিং বলতে আমি বুঝতাম, পরবর্তী সময়ে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়া, কথা বলা। এই যে ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ মাথায় রেখে হেসে কথা বলতে হবে, হাত মেলাতে হবে, এই ব্যাপারই নেটওয়ার্কিংকে আমার কাছে মেকি করে তুলেছিল।
ধারণাটি যে ভুল, বুঝলাম মার্কিন লেখক ও উদ্যোক্তা কিথ ফেরাজ্জির লেখা নেভার ইট অ্যালোন বইটি পড়ে। বইটিকে আদতে ‘নেটওয়ার্কিং গাইড’ বলা যায়। তবে লেখক মনে করেন, একে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রভাবক হিসেবে দেখাই বেশি যুক্তিযুক্ত। তিনি ‘বিজনেস কার্ড’ আদান-প্রদান আর হাত মেলানোর গণ্ডিতে নেটওয়ার্কিংকে সীমাবদ্ধ করেননি। বরং নতুন একজন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, আন্তরিক পরিচয়পর্বের মধ্য দিয়ে জীবনের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন মতামত সম্পর্কে জানতে পারার মধ্যেই যে নেটওয়ার্কিংয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি নিহিত, সে ধারণা ব্যক্ত করেছেন সহজ ভাষা ও প্রাসঙ্গিক উদাহরণের মাধ্যমে।
স্বার্থের জন্য নয়, সাহায্যের জন্য যোগাযোগ
বইয়ের প্রথম ভাগের নাম ‘দ্য মাইন্ড সেট’। আমার মতো যাঁরা নেটওয়ার্কিং শব্দটির অতি ব্যবহার থেকে একটি ভুল ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছেন, তাঁদের জন্যই যেন এ অংশটি লেখা। এখানে লেখক স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে নিজের কাজে আসবে’—এমন বিনিময় প্রথা মাথায় রেখে কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করা নিছক বোকামি। কারণ, তাতে আন্তরিকতার লেশমাত্র থাকে না। ফেরাজ্জির মতে, অন্যকে সফল হতে সাহায্য করাই প্রকৃত নেটওয়ার্কিং। কেননা, সাহায্য ও সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক শুধু যে অন্যের কাছে আপনার ব্যক্তিত্ব প্রকাশে সহায়তা করবে তা নয়; পাশাপাশি আপনি নিজেও আপনার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবেন। এ ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছানোর তিনটি ধাপের কথা বলতে গিয়ে ফেরাজ্জি বলেছেন, ‘তোমার আগ্রহের ক্ষেত্রগুলোতে যাঁরা ইতিমধ্যে সফল হয়েছেন, তাঁদের “পার্সোনাল বোর্ড অব ডিরেক্টরস” হিসেবে বিবেচনা করো।’ লেখকের বিশ্বাস, নিজের কাজ নিয়ে আমরা যদি এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করি, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কাজগুলোকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করি, তাঁদের মূল্যবান পরামর্শের মাধ্যমে নিজের দক্ষতা আরও বাড়িয়ে তুলি, তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো হবে আরও সহজ।
নেটওয়ার্কিংয়ে ‘কী কী করতে নেই’—এ নিয়েও বেশ স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন তিনি। সহজ ভাষায় বারবার বলেছেন, ‘যা-ই বলবে তা যেন হয় অর্থবহ।’ শুধু কথা বলার জন্য অনর্থক কোনো বিষয়ের অবতারণা করা, পরচর্চা করাকে নিরুৎসাহিত করেছেন তিনি।
কথা বলার শিল্প
কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে তাঁর সম্পর্কে জেনে নেওয়া, তাঁর আগ্রহের বিষয়গুলো কী তা জানাকে লেখক বলেছেন ‘হোমওয়ার্ক’ বা বাড়ির কাজ। আলোচনার জন্য এই হোমওয়ার্ক ব্যাপারটি খুব জরুরি। কেননা এর মাধ্যমে আলোচনা হয় অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক। এ ছাড়া সদ্য পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে পরবর্তী সময়ে যোগাযোগের উপায় জেনে নেওয়া, নিজের প্যাশন বা আগ্রহের কথা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা, পরবর্তী সময়ে তাঁকে পুরোপুরি ভুলে না গিয়ে তাঁর সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক ও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, কানেক্টর অর্থাৎ সাংবাদিক, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক, পাবলিক রিলেশন নিয়ে কাজ করা, বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মানুষকে সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার মাধ্যমে কার্যকরভাবে নেটওয়ার্কিং করার বিভিন্ন পরামর্শও উঠে এসেছে বইয়ের এ অংশে।
পড়তে পড়তে আমার নিজের একটি প্রশ্নের চমৎকার উত্তর পেয়েছি আমি। সব সময় ভাবতাম, যে বিশিষ্ট ব্যক্তিটিকে আমি আমার আইডল মনে করি, তাঁর ব্যস্ততা বা অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে তাঁর অবস্থান তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও–বা কোনো উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, তবু হয়তো পরবর্তী সময়ে তাঁর কাছে পৌঁছানো আর সম্ভব হবে না। ঠিক এমন পরিস্থিতির উদাহরণ টেনেই লেখক বলেছেন, আমি যাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই, তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গেও কথা বলতে হবে ‘আর্টফুলি’, অর্থাৎ তাঁর সঙ্গে আচরণ হতে হবে যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ। ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে হয়তো আমরা কোনো সুযোগ হারাতে পারি।
বইটির নাম কেন নেভার ইট অ্যালোন, সেটি বোঝা যায় এর পরের অংশে। ফেরাজ্জির মতে, এক বেলা একা খাবার খাওয়ার অর্থ নেটওয়ার্কিংয়ের একটি দারুণ সুযোগ হারানো। কেননা খাবারের টেবিল হয়ে উঠতে পারে নতুন কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার, পূর্বপরিচিত মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর, আলোচনা করার একটি চমৎকার জায়গা।
কথায় কথায় বন্ধুত্ব
পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কী করে একটি দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্ক রাখা যায়, তা নিয়ে লেখা হয়েছে বইটির তৃতীয় অংশ ‘টার্নিং কানেকশনস ইনটু কমপ্যাট্রিয়টস’ (যোগাযোগকে বন্ধুত্বে রূপান্তর)। ব্যক্তিগত জীবনের কোনো কাজে সহায়তা করা, নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা, গেট টুগেদার পার্টির আয়োজন করার মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার নানা খুঁটিনাটি বিষয়ের কথা তুলে ধরেছেন ফেরাজ্জি। এ অংশের বেশির ভাগ পরামর্শ খানিকটা একঘেয়ে মনে হলেও নিজের পেশার বাইরের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা যে সামাজিক ও পেশাগত জীবনে আমাদের জন্য কতটা জরুরি, তা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। তাঁর ভাষায় বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টিকে বলা হয় ‘সোশ্যাল আরবিট্রেজ’ (সামাজিক সম্পদ)।
নেভার ইট অ্যালোন–এর সর্বশেষ অধ্যায়ের নাম ‘ট্রেডিং আপ অ্যান্ড গিভিং ব্যাক’। পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে নিজেকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করার কথাই এ অংশের মূল বিষয়বস্তু। আর এ ক্ষেত্রে ফেরাজ্জির যে পরামর্শটি আমার সবচেয়ে মূল্যবান মনে হয়েছে, তা হলো বক্তব্য-বাচনভঙ্গি-আচরণে থাকতে হবে নিজস্বতা; যা ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলবে। বর্তমান সময়ে আমাদের কথায়-চলাফেরায় যে অনুকরণপ্রিয়তার প্রবল আধিপত্য দেখা দিয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে এই ধারণা দ্রুত ছড়িয়ে পড়া খুব দরকার। লেখার মাধ্যমে নিজের ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়া, বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো, মেন্টরশিপের চর্চা করার কথা এ অংশে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন লেখক।
নেভার ইট অ্যালোন দিন শেষে একটি ‘কানেক্টেড টাইম’ বা ‘সংযুক্ত সময়’ এর কথা বলে; যে সময়ে পারস্পরিক পরিচয় ও আন্তরিক সম্পর্কই মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পুরো বইয়ে কিথ ফেরাজ্জি তাই মেন্টরশিপ, নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা, পেশাগত বিভেদ ভুলে যাওয়ার কথা বলেছেন একাধিকবার। নেটওয়ার্কিংয়ের প্রচলিত সংজ্ঞা ভেঙে লেখক এর সৌন্দর্য ও শক্তির কথাই ব্যক্ত করেছেন তাঁর লেখনীতে।