২০২১ সাল শুরু হলো এ দেশের নারী আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানমের প্রয়াণের সংবাদের মধ্য দিয়ে। আমরা দেখেছি এই সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সব গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
আয়শা খানম ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকেই প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক–রাজনৈতিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সক্রিয় সংগঠক ছিলেন। পরে তিনি নারী আন্দোলনে যুক্ত হন। নারী আন্দোলনের কর্মী-সংগঠক হিসেবে দীর্ঘদিনের সাধনায় আয়শা খানম নিজেকে একটা ভিন্ন উচ্চতায় জাতীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন।
পত্রিকা অফিসের আগ্রহ থেকে সংগঠনের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী হিসেবে আমার দেখা আয়শা আপাকে নিয়ে এই লেখায় কিছু বলা। ২ জানুয়ারি মধ্যরাতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আমার চিরচেনা আয়শা আপার নীরব-নিথর দেহ নানা পরীক্ষা করার পরে যখন শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেল যে এবার তাঁকে আর ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না, আজও না, কোনো দিনও না; তখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাঁর মেয়ে কোভিড–সংক্রান্ত জটিলতা উপেক্ষা করে ফুসফুসে ক্যানসারের সঙ্গে অসাধারণ মনোবল নিয়ে যুদ্ধরত মায়ের সঙ্গে সময় কাটাবে বলে এসেছে সপ্তাহ তিনেক হলো। ওর দিকে তাকাতে পারছি না।
সিনেমার রিলের মতো ঝাপসা চোখের সামনে নানা ছবি ভেসে যেতে থাকল। মেয়ে উর্মি ঢাকায় এলে চারদিকে আয়শা আপার সঙ্গী বইয়ে ঠাসা ঘর নতুন প্রাণ পেত। উর্মির বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, আমাদের নিয়ে গল্প, খাওয়াদাওয়ার মধ্যে কাজপাগল আয়শা আপার কত দিন একটু ভিন্ন স্বাদের হতো। সবাইকে নিয়ে কন্যার উপস্থিতি উপভোগ করাতেই তাঁর আনন্দ ছিল। উর্মিকে নিয়ে মহিলা পরিষদে অন্তত এক দিন আসার ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। রোকেয়া সদনের মেয়েদের জন্য আনা উর্মির উপহার সঙ্গে নিয়ে আসতেন।
আজীবন লালিত একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী ও কন্যার মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাঁর সংগ্রামের অন্যতম উৎস ছিল একটি সংবেদনশীল মমতাময়ী মন।
সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যার অমর্যাদা, অমানবিকতা, অন্যায্যতার দুঃখ-কষ্ট, বেদনা তাঁর মন ছুঁয়ে যেত। একজন নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে একদিকে কাঠামোগত এসব বৈষম্য দূর করার জন্য যেমন লড়াই করেছেন নানাভাবে, অন্যদিকে তাঁর সংবেদনশীল মন, অপাত্য স্নেহ-মমতা দিয়ে তাঁর সংস্পর্শে আসা মেয়েদের কাছে টেনে নিয়ে দুঃখ-কষ্ট লাঘবের সব রকম চেষ্টা করতেন।
নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে মহিলা পরিষদ পরিচালিত রোকেয়া সদনে সাময়িক আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া মেয়েরা যাতে সেখানে পারিবারিক আবহে বসবাস করতে পারে, তারা যেন নিজেদের এখানে অবাঞ্ছিত মনে না করে, তাঁর এ রকম পরামর্শ ছিল সবার জন্য। এ ক্ষেত্রে কোনোরকম ত্রুটি তাঁর নজর এড়াত না। সে জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি তিনি রূঢ় হতেও দ্বিধা করতেন না। এই রূঢ়তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থেকে উৎসারিত। এই মেয়েদের প্রতি শুধু দায়িত্ব পালন নয়, দায়িত্বের সঙ্গে মানবিকতার সংমিশ্রণে দায়বোধ তাঁকে তাড়িত করে বেড়াত সব সময়। আর তাই আয়শা আপাকে মাঝেমধ্যেই দেখা যেত সদনের মেয়েদের ডেকে একান্তে কথা বলতে। অথবা তারা নিজেরাই নির্দ্বিধায়-নির্বিঘ্নে চলে আসত আয়শা খালা বা আয়শা নানুর সঙ্গে কথা বলতে, তাদের আবদার জানাতে। তাদের পছন্দগুলো নিজে থেকে জেনে নিয়ে বা তাদের চাহিদা অনুযায়ী পূরণ করতেন। কখনো কখনো তাদের সেই চাহিদা আমাদের কাছে বাস্তবসম্মত মনে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি সেই চাহিদা পূরণ করতেন। তাই
তাঁর চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে টেলিফোনে শান্তার বুকফাটা আর্তনাদ, ‘নানু কেন চলে গেল?’
আয়শা আপার সংবেদনশীল মনের ছোঁয়া সংগঠনের কমবেশি সবাই উপলব্ধি করতেন। অফিসে কর্মরত স্টাফদের সাধ্যে কুলালে পুষ্টিকর খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব নিতে পারলে তিনি খুশি হতেন, যা ছিল বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে।
নোটবুকে না লিখে টুকরো কাগজে নোট নেওয়ার জন্য অথবা খাতা কাগজে মার্জিন না রাখলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মতো অপ্রিয় কথা শুনতে হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনাচরণে তাঁর নান্দনিক রুচিবোধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের অনেকেরই হিমশিম খেতে হতো।
ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলন গড়ে তোলার স্বার্থে নারীর অধিকারের জন্য যাঁরা যেখানে কাজ করছেন, সবার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং বিশেষত নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার সহজাত প্রবণতা ছিল তাঁর মধ্যে। বহু ধারার সংগঠনকে একত্র করে গঠিত সামাজিক প্রতিরোধ কমিটিকে প্রায় দুই দশক ধরে সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। তাঁর অর্থপূর্ণ দীর্ঘ সাবলীল সংবেদনশীল বক্তব্যের জন্য তিনি সুবক্তা হিসেবেই সমাদৃত ছিলেন।
তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে একসময় প্রগতিশীল রাজনীতি, নারী আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলনে যাঁদের সঙ্গে একমঞ্চে দীর্ঘদিন পথ হেঁটেছেন। তাঁদের মধ্যে কারও চিন্তাভাবনা আয়শা আপাকে ক্ষুব্ধ, আহত করত। বক্তৃতা-বিবৃতিতে সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটালেও আমাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁর হতাশা–বেদনা ব্যক্ত হতো। বর্তমানে দূরত্ব তৈরি হলেও অতীতের ঘনিষ্ঠতা তিনি সযত্নে মনের কোণে লালন করতেন। সংবেদনশীল, স্মৃতিকাতর আয়শা আপা কখনো কখনো তা মেলে ধরতেন আমাদের সামনে ভালোবাসায়, আবেগে।
১০/২ সেগুনবাগিচায় ‘সুফিয়া কামাল ভবন’, যেটা তাঁর জীবনবৃত্তান্ত তৈরির সময় স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে লিখতেন এবং এ দেশের নারী আন্দোলনেরও স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বিবেচনা করতেন। এই ভবনের জন্য তাঁর আবেগ ছিল ভিন্ন। ভবনের নিচতলায় সুফিয়া কামাল মিলনায়তনের দেয়ালজুড়ে রোকেয়া, প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, সুফিয়া কামাল, মনোরমা বসুর বিশাল বিশাল প্রতিকৃতি প্রতিদিন তাঁর চিন্তা–চেতনাকে অনুপ্রাণিত করত, সেটা প্রায়ই তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেত।
এই তো আমার দীর্ঘদিনের পথচলার সাথি আয়শা আপা, যাঁর মমত্ববোধ এবং স্নেহপরায়ণতা আর সবার মতো আমার জন্যও বরাদ্দ ছিল, যা আমাকে ঋণী করেছে, ঋদ্ধ করেছে।
অনেক ভালোবাসা–শ্রদ্ধা আয়শা আপার জন্য।