ত্রাণ কাঁধে নিরন্ন মানুষের কাছে যাচ্ছেন শাকির
গত মাসেই এক দফা বন্যায় ভাসল সিলেট অঞ্চল। তখনো দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সিলেটের শাহ সিকান্দার আহমদ। সবাই তাঁকে চেনে শাকির নামে। এবারের আকস্মিক বন্যার সময়ও অসহায়ের পাশে আছেন তিনি। ত্রাণ কাঁধে নিজেই যাচ্ছেন নিরন্ন মানুষের হাতে পৌঁছে দিতে। তাঁর গল্প জানেন সজীব মিয়া
সিলেটের আকাশ তখন ছেয়ে আছে জমাট কালো মেঘে। টানা বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ বন্যায় নাকাল মানুষজন। সকালে অফিসে যাওয়ার পথে শহরতলিতে বন্যার পরিস্থিতি শাকির নিজেই দেখেছেন। নগরীর মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন, সে খবরও তাঁর জানা। জায়গায় জায়গায় বিদ্যুৎ নেই। চারপাশে পানি অথচ খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। রাতে ডাকাত পড়ার মতো ভয়াবহ খবরও ফেসবুকে চাউর হয়েছিল। বৃষ্টি না থামলে, এভাবে বন্যার পানি বাড়লে মানুষের কী হবে? এই প্রশ্নে শাকিরের মন যখন তোলপাড়, তখনই স্থানীয় দৈনিকের একটি প্রতিবেদনে দৃষ্টি আটকে যায়। তাতে বলা হয়েছে, ‘সিলেট নগরের কিছু এলাকায় চিড়া, মুড়ি, মোমবাতির সংকট দেখা দিয়েছে। ক্রেতারা বিভিন্ন দোকান ঘুরে পাচ্ছেন না এসব পণ্য।’ মনটা আরও ভার হয়ে যায়।
সিলেটের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে চাকরি করেন শাকির। পেশায় কম্পিউটার অপারেটর। সামান্য বেতনের চাকরি। তবে হৃদয়টা সামান্য নয়। সেদিনের মতো কাজ থেকে ছুটি নেন তিনি। রেইনকোট গায়ে চাপিয়ে মোমবাতি আর চিড়ার সন্ধানে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েন। পরিচিত বিভিন্ন দোকানে ঘুরতে থাকেন। পকেটের টাকায় ঘুরে ঘুরে মোমবাতি সংগ্রহ করেন। সেসব পৌঁছে দেন পরিচিত কয়েকজনের বাসায়। এরপর চলে যান আম্বরখানা। গত মাসে সিলেটে যখন বন্যা দেখা দিল, তখন ত্রাণ বিতরণ করেছেন শাকির। সে সময়ের তিন বস্তা চিড়া রেখেছিলেন আম্বরখানার একটা দোকানে। দুই বস্তা চিড়া পৌঁছে দিলেন দুই জায়গায়। তারপর এক বস্তা নিয়ে ছুটলেন বাগবাড়ির বর্ণমালা স্কুল এলাকায়। সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন অনেক বানভাসি মানুষ।
পথেই খবর পেলেন, বন্যার পানি শাকিরদের বাসার নিচতলায় পৌঁছে গেছে। পানি তোলার মোটরটাও ডুবে গেছে। পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন। তারপরও বাসায় না ফিরে বাগবাড়ির বর্ণমালা স্কুল এলাকায় গেলেন শাকির। সেখানে দেখেন পানি থই থই। তীব্র স্রোত বইছে। মানুষগুলো অসহায় যেন। নারী ও শিশুদের স্কুল ভবনে পৌঁছে দিতে সামান্য পথ ভ্যানে পাড়ি দিতে হচ্ছে। ভ্যানচালকেরা অসময়ের সুযোগের ‘সদ্ব্যবহার’ করছেন। ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করছেন। দেখে চেনা এক ভ্যানচালককে ডেকে আনলেন শাকির। অল্প টাকায়, অনেক সময় বিনা পয়সায়, একে একে পার করলেন বেশ কয়েকজন নারী ও শিশুকে। তারপর চিড়া-গুড়ের প্যাকেট তুলে দিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বন্যার্তদের হাতে।
মানুষ বড় অসহায়
১৮ জুন থেকে রোজই ত্রাণ বিতরণে যাচ্ছেন শাকির। সিলেটে ভয়াবহ বন্যায় মানুষের দুর্ভোগের খবর ছড়িয়ে পড়লে ফেসবুকে অনেকেই শাকিরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কারণ, শাকির যে আপাদমস্তক স্বেচ্ছাসেবক, সে খবর জানেন অনেকেই। কেউ কেউ সহায়তাও করতে চান। সত্যিই সহায়তা প্রয়োজন, এমন মানুষদের খুঁজে বের করেন শাকির। শুরুতে পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি, গুড় দিতেন। এখন দিচ্ছেন এক সপ্তাহ চলার মতো খাদ্যসামগ্রী। শাকির বলেন, ‘আমি অনেককে চিনি, যাঁদের ঘরে খাবার নেই। সহায়তা প্রয়োজন, কিন্তু কাউকে বলতে পারেন না। এমন মানুষদের কাছেই ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছি এখন।’
সিলেট নগরী ছাড়াও কোম্পানীগঞ্জ, ছাতকসহ বিভিন্ন উপজেলায়ও ত্রাণ নিয়ে গেছেন শাকির। নিজে সাঁতার জানেন না, কিন্তু মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ঝুঁকি নিয়ে বুকপানিতেও কাঁধে বয়ে নিয়ে যান ত্রাণসামগ্রী।
প্রথম আলোর ভাইয়া
প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে শাকির যুক্ত হয়েছিলেন স্কুলে পড়ার সময়। মুরারিচাঁদ কলেজে (এমসি) স্নাতক পড়ার সময় পুরোদমে যুক্ত হন সাংগঠনিক কাজে। সাধারণ সদস্য থেকে একসময় সিলেট বন্ধুসভার সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শাকির বলেন, বন্ধুসভার বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন, ত্রাণ বিতরণ—কত কাজের সঙ্গেই না যুক্ত থাকতে হয়েছে। এসব কাজে নানা জনের সঙ্গে মিশেছি। এলাকার যারা নাম জানে না, তারা আমাকে বলে—প্রথম আলোর ভাইয়া।’
শাকির এখন অসহায়ের পাশে দাঁড়ায়। সিলেটের এখানে-সেখানে গাছের চারা লাগান। মানুষকে বই উপহার দেন। তাঁর এসব কর্মকাণ্ড দেখে অনেকে বলেন, ‘ছেলেটা পাগল।’ অথচ শাকির বলেন, ‘আমার কিন্তু শুনতে ভালোই লাগে। নিজেকে মনে হয় সুন্দর পাগল! পাগল বলেই তো ১৫ হাজার গাছের চারা রোপণ করতে পেরেছি।’
নিজের সম্পর্কে এটুকু বলে ফোনের অপর প্রান্তে হাসতে থাকেন শাকির।