তাঁরাই জ্বালান আলো
>
লাইটার ফাউন্ডেশন। তরুণদের সংগঠন। যাত্রা শুরু ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। প্রত্যেক সদস্য প্রতি মাসে চাঁদা দেন, টাকা জমান। সেই জমানো টাকা দিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এই তরুণের দল ভালো কিছু কাজ করেন। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের গড়ে দিয়েছেন ঘর, মুদি দোকান বা হাতে তুলে দিয়েছেন চিকিৎসা খরচ। লাইটার ফাউন্ডেশনের সদস্যরা আবার সহায়তা করেন বন্যাদুর্গতদের, শীতার্ত মানুষকে। আবার স্কুলে শহীদ মিনারও গড়ে দিয়েছেন। ‘লাইটার ব্লাড উইং’ নামে রক্তদাতাদের নেটওয়ার্ক তৈরির কাজেও হাত দিয়েছেন তাঁরা।
তরুণদের এই উদ্যোগ নিয়েই ছুটির দিনের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
লাইটার। নামটা শুনে প্রথমে খটকাই লাগে। তবে এই লাইটার অন্য একটা বার্তা দিতে চাইছে। লাইটার ফাউন্ডেশন নামের এই সংগঠন তরুণদের এক উদ্যোগ। এই উদ্যোগের শুরুতে তরুণদের বলা হলো, এসো এই লাইটার হাতে তুলে নাও। যে লাইটার আলো জ্বালায় আশার–স্বপ্নের।
লাইটার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যে তরুণেরা নজর কেড়েছেন, নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এখন পর্যন্ত যতটুকুই করেছেন, তাতে ভবিষ্যতের আরও বড় একটা ক্যানভাসের ছবি ভেসে ওঠে। লাইটারের প্রতীকে, ব্যানারে লাল-সবুজের ছড়াছড়ি। লাল-সবুজ তাঁদের ভাবনায়, স্বপ্নে, মননে, আদর্শে।
এ কারণে লাইটার প্রথমেই উদ্যোগ নিয়েছে, কোনো প্রতিদানের আশা না করে যে মানুষেরা হাতের মুঠোয় জীবনকে বাজি রেখে এই দেশকে একটা লাল-সবুজ পতাকা এনে দিয়েছেন, তাঁদের অন্তত কয়েকজনের মুখে হলেও হাসি ফোটাতে। গত বছর পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাকে সহায়তা করা হয়েছে লাইটারের পক্ষ থেকে। লাইটারের স্বপ্নগুলো ছোট্ট, কিন্তু আবার অনেক বড়ও। ছোট্ট সামর্থ্যের দিক দিয়ে। তারা জানে, বাংলাদেশের প্রত্যেক অসহায় মুক্তিযোদ্ধার দায়িত্ব নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং বাস্তবতা হলো, অল্প কজনের দায়িত্বভারই নিতে পারে তারা। কিন্তু এই স্বপ্নটার ব্যাপ্তি আবার বড়ও। লাইটার জানে, এই উদাহরণ ছড়িয়ে দিতে পারলে এগিয়ে আসবে আরও অনেকে। প্রত্যেকে নিজের অবস্থান থেকে দায়িত্ব নিলেই না বিশাল বড় পাহাড় বোঝাটাকেও মনে হবে যৎসামান্য। নিজেদের স্বপ্নগুলোকে একেকটা অধ্যায়ে ভাগ করেছে তারা। যে অধ্যায়গুলোর নাম তারা দিয়েছে—মিশন!
মিশন একুশ
স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল বায়ান্নতে। লাইটার সেই বীজটাই আবার বুনে দিতে চায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে। তাদের লক্ষ্য, বেছে বেছে দেশের এমন সব প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল খুঁজে বের করা, যেখানকার শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়গুলোকে জানে না।
লাইটার চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মদনহাটে এম কে রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বানিয়ে দিয়েছে শহীদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারি পুরো দিনটা তারা কাটিয়েছে সেখানকার শিক্ষার্থীদের ভাষা নিয়ে উৎসব করে। সেই উৎসবের মধ্য দিয়েই তারা জানিয়ে দিয়েছে, বায়ান্ন কী, কেন বাংলা ঠিকভাবে জানা দরকার। এই উদ্যোগ তারা চালিয়ে নিতে চায় প্রতিবছরই।
মিশন স্বাবলম্বীকরণ
তাৎক্ষণিক কিছু অর্থ সাহায্য সাময়িক সংকট কাটাতে পারে। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। লাইটার তাই চায় এমন কিছু করতে, সেই অসহায় মানুষটিকে যেন পরে আবার হাত পাততে না হয়। এ বছরের মার্চ মাসে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের পরিবারকে স্বাবলম্বী করেছে লাইটার। জুয়েল দেব চড়া সুদে একটি রিকশা কিনেছিলেন। কিস্তির টাকা আর সংসারের খরচ মেটাতেই টানাটানি। ‘ঋণের টাকায় রিকশা কিনে আমি যখন দিশেহারা, তখনই তারা আমার পাশে দাঁড়ায়। গত বছর তারা আমাকে একটি রিকশা কিনে দিয়েছে। এখন নিজের রিকশা হওয়ায় খুবই স্বস্তিতে রয়েছি।’ বলেন জুয়েল দেব।
জুয়েলের এখন ‘নিজের রিকশা’ আছে। তাঁর এক বছরের ছোট্ট মেয়েটির মুখে হাসির ঝিলিক, নিজের চোখেও আনন্দাশ্রু। কে জানে, ওপারে বসে হয়তো হাসছেন জুয়েলের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা বাবা সুভাষ বসুও!
মিশন ১৯৭১
গত বছরের ডিসেম্বরে লাইটার সিদ্ধান্ত নেয় দেশের সেসব সূর্যসন্তানকে খুঁজে বের করার, যাঁরা এখনো জীবনযুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধকালীন সেক্টর ৪-এর অন্তর্ভুক্ত মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় জরিপ করে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নেন লাইটারের সদস্যরা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল নিশ্চিত করে তাঁদের পরিচয়। ‘মুক্তিযোদ্ধা’—এই অহংকারমাখা উপাধি ছাড়া তাঁদের আর কোনো সম্বল নেই! জীবনসায়াহ্নে এসে একটুখানি নিশ্চয়তা চান তাঁরা তাঁদের পরিবারের জন্য।
সফর আলী জীবনের তাগিদে রিকশা চালাতেন। কিন্তু হাতটা প্রায় পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিল বলে সেই উপায়ও আর থাকল না। লাইটার শুধু তাঁর চিকিৎসাই করায়নি, সীমিত সাধ্যে করে দিয়েছে মুদি দোকান। সফর আলীর শ্যালক আজিজ মিয়ার সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে। তিনি বলেন, ‘সংগঠনটি আমার দুলাভাইকে একটি দোকান করে দিয়েছে। তার জন্য এটি খুবই উপকারে এসেছে।’
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে ফেরেন অজিত রঞ্জন। নিজের বসতবাড়ি বলতে যা ছিল, সেটাকে বসবাসের অযোগ্যই বলা চলে। লাইটার বানিয়ে দিয়েছে আধা পাকা ঘর। তিনি বললেন, ‘আমার ঘরটি ভাঙা ছিল। ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই দুঃসহ অবস্থায় ছিলাম। লাইটার ফাউন্ডেশন থেকে আমাকে একটি ঘর তুলে দেয়। শুধু তাই নয়, এরপর থেকে নিয়মিত খোঁজখবরও রােখ তারা। কিছুদিন আগেও পূজা উপলক্ষে ওরা আমাকে উপহার দিয়ে গেছে।’
মুক্তিযোদ্ধা নিমাই রায় ছিলেন চা-শ্রমিক। লাইটার নিমাই রায়কে একটি মুদি দোকান তৈরি করে দিয়েছে। ৬০ বছর বয়সে এসে এখন আর শরীরের ওপর অকথ্য নির্যাতন হবে না তাঁর। দীপক চক্রবর্তী, যত দুশ্চিন্তা সব তাঁর পরিবারকে নিয়ে, ‘আমার কিছু হলে মেয়ের কী হবে, স্ত্রীর কী হবে!’ মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন, বাবার একটাই আশা—মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হবেন। লাইটার দীপক চক্রবর্তীর মেয়ের পড়াশোনার যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
হরেন্দ্র নিজে ঠেলা চালান, দিনমজুরি খাটেন। স্রেফ একটা ‘ঠিকানা’ চাওয়া ছিল! লাইটার বানিয়ে দিয়েছে তাঁর নিজের ঘর। এসবই তারা করেছে প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে।
প্রতিবছর এমন করে অসহায় মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করে লাইটার জানতে চাইবে তাঁদের স্বপ্নের কথা, চাওয়ার কথা। লাইটার দেখেছে, খুব সরল এই মানুষগুলোর চাওয়াও কত সরল, ছোট।
চলতি বছর লাইটারের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টর, চট্টগ্রাম জোনের ১০ অসহায় মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নপূরণ। আর তাই ঢাকার কলাবাগান মাঠে দেশের সেরা শিল্পীদের নিয়ে কনসার্টের আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে সংগঠনটি। নাম কনসার্ট ফর ফ্রিডম ফাইটার্স। এটি হবে ডিসেম্বর মাসেই।
স্বপ্নটা অনেক বড়
সংগঠনটির বয়স মোটে এক বছর দুই মাস, এরই মধ্যে কত কিছু করে ফেলেছে। লাইটার ফাউন্ডেশন গত বছরের সেপ্টেম্বরে গাইবান্ধার এরেন্দাবাড়ি ইউনিয়নের সবচেয়ে দরিদ্র ৫১০টি বন্যার্ত পরিবারের কাছে ছুটে গেল বেঁচে থাকার রসদ নিয়ে। এই তো কয়েক দিন আগে গাইবান্ধার সাঘাটায় ৬০০ বন্যার্ত পরিবারের মাঝে পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক কেজি লবণ, ছয়টি মোমবাতি, দুটি ম্যাচ এবং ১০টি করে স্যালাইন দিয়ে এসেছে তারা। উত্তরবঙ্গে শীতে কাঁপতে থাকা অসহায় হতদরিদ্র মানুষগুলোর পাশেও দাঁড়িয়েছে লাইটার। গত বছরের অক্টোবরে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সংগঠন ‘সমানুপাতিক’-এর শীতের ফেসবুক ইভেন্টে যুক্ত হয়ে ‘রজনীগন্ধা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা’র ১৫০ জনকে কম্বল দেওয়া হয়েছে। ‘কনসার্ট ফর কম্বল’-এ ১১০টি কম্বল দেয় লাইটার। সে কম্বলগুলো পৌঁছে গিয়েছিল উত্তরবঙ্গে।
সামনে আরও অজস্র পরিকল্পনা লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের। ‘লাইটার ব্লাড উইং’ নামে রক্তদাতাদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে একটি স্কুল স্থাপন করতে চায় তারা। ২০১৬ সালে অন্তত ১০টি পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে চায়। দেশজুড়ে স্কুলগুলোতে বানাতে চায় শহীদ মিনার।
ভাবনার শুরু ফেসবুকে
সংগঠনটির উদ্যোক্তা মুক্তার ইবনে রফিক জানালেন শুরুর গল্প, ‘এমনিতে আমাদের অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে নানান সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত ছিলাম। প্রায়ই দেখা হতো, ফেসবুকে ভাবনার আদান-প্রদান হতো। একসময় ভাবনায় এল, একই মানসিকতার সবাই আমরা একসঙ্গে কাজ করছি না কেন? তারপর ঝটপট ফেসবুকে গ্রুপ খুলে ফেললাম। নিজেরাই নীতিমালা ঠিক করলাম, গ্রুপের নাম চূড়ান্ত করলাম। অনলাইনে স্বেচ্ছাসেবী ফরম ছাড়লাম। পেলাম অভূতপূর্ব সাড়া। পাঁচ শরও বেশি ফরম জমা পড়ল। সেখান থেকে আমরা যাচাই-বাছাই করে সদস্য সংগ্রহ করলাম। ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হলো আমাদের।’
লাইটারের বেশির ভাগ সদস্যই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বর্তমান সদস্যসংখ্যা ২১০ জন। সবাই মাসে ১০১ টাকা করে চাঁদা দেন। তবে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন হলে সবাই নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী অনুদান দেন বা সংগ্রহ করেন। সংগঠনটির কর্মী নাহিদ হাসান জানালেন, ‘যেকোনো প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা ফেসবুকে ইভেন্ট পেজ খুলি। আমাদের সংগঠনের সবাই মূলত শিক্ষার্থী।
কেউ হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে, কেউ বাবা-মা কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছে চেয়ে, কেউবা আবার নিজ নিজ ফেসবুকের বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে টাকা তুলি।’
আরেক কর্মী আমজাদ হোসেন বললেন, ‘নিজেদের সব কাজ ও আর্থিক হিসাবে স্বচ্ছতা রাখতে গুগল ডকে করে প্রতিটা টাকার হিসাব জমা দিই। আমরা ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকার সাহায্যও পাই ফেসবুক বন্ধুদের কাছ থেকে! কেউ বিকাশে পাঠান, কেউ আবার আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠান। আর প্রবাসী বাংলাদেশিরা মানিগ্রাম বা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে করে পাঠান বেশির ভাগ সময়।’
কতটুকু তারা পেরেছে, কতটুকু পারবে—সেই প্রশ্ন ভবিষ্যতের শিকেয় তোলা রইল। তবে এভাবে লাইটাররা হাতে হাতে ধরে এগোলে অন্ধকারের আগল ভেঙে জাগবে প্রভাত, আলো আসবেই। আলো আসতেই হবে। আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে!
ফেসবুক পেজ-(www.facebook.com/lighterfoundationbd)
ওয়েবসাইট-(www.lighterbd.org)