জুলিয়েটের বাড়িতে
>ইতালির ভেরোনা শহরের পরতে পরতে মিশে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য। প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও স্থাপনার জন্যই এদিগে নদীতীরের এ শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। তবে ইতালির এ শহর আরও জীবন্ত রোমিও-জুলিয়েটের অমর প্রেমকাহিনির জন্য।
ভেরোনা শহরে পা রেখেও যেন বইয়ের পাতাতেই ভাসছিলাম। কারণটা, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬ সাল)। খ্যাতিমান এই ইংরেজ সাহিত্যিকের প্রসঙ্গ এলেই অবধারিতভাবে যেমন তাঁর অমর সৃষ্টি রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট-এর (প্রকাশকাল ১৫৯৭) কথা চলে আসে, তেমনি সেই নাটকের প্রসঙ্গে আসে ভেরোনার নাম। শুধু রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট-এর কথাই বলছি কেন, শেক্সপিয়ারের দ্য টু জেন্টেলম্যান অব ভেরোনা (প্রকাশকাল: ১৬২৩) নাটকের পটভূমিও এই শহর।
ইরাসমাস স্টুডেন্ট নেটওয়ার্কের (ইএসএন) হয়ে ৪০ জনের বিশাল একটি দল গিয়েছিলাম ভেরোনায়। গাইড হিসেবে ছিলেন ভেরোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। তিনি রীতিমতো ভেরোনা বিশেষজ্ঞ। তাঁর বর্ণনায় আমাদের সামনে মূর্ত হলো অন্য এক ভেরোনা।
ভেরোনায় বেড়াতে আসা মানুষদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা—জুলিয়েট হাউস। আমাদের ঘোরাঘুরির শুরুটাও তাই সে বাড়ি দিয়েই। মূল জুলিয়েট হাউস দেখতে অন্য দশটা সাধারণ বাড়ির মতোই। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে বাড়িটি তিনতলা, কিন্তু আদতে চারতলা।
নিচতলায় প্রবেশ করেই একটা বড় হলঘর। এখানে আছে এক পাশে জুলিয়েট, আরেক পাশে রোমিওর ভাস্কর্য। যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতেই অপেক্ষা করছেন তাঁরা। আমার মনে উঁকি দিচ্ছিল অন্য এক প্রশ্ন। প্রশ্নটা গাইডকে করেই ফেললাম, ‘আচ্ছা, নাটকে তো ছিল কাল্পনিক বাড়ি, এ বাড়ি এল কোথা থেকে!’ গাইড জানালেন, বাড়িটি সত্যিই সে সময়ের ‘ক্যাপেলো’ পরিবারের ছিল। অনেকে মনে করেন, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কোনো একসময় ভেরোনাতে এসেছিলেন। এই বাড়িটাকে মনে রেখে হয়তো তিনি তাঁর অমর সৃষ্টি কল্পনা করেন।
১৯০৫ সালে ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ভেরোনা কমিউনিটি বাড়িটি কিনে নেয়। সেই থেকে এটা দর্শনীয় স্থান।
জুলিয়েট ব্যালকনি কিংবা চিঠির দুনিয়া
নিচতলা থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় যেতে হলো। বাড়িটি সম্পর্কে আগেভাগে কিছু তথ্য জেনে নিয়েছিলাম বলেই ভেবে নিয়েছিলাম, এ তলাতেই হয়তো সেই জুলিয়েটের শোবার ঘর দেখতে পাব। কিন্তু শত বছরের পুরোনো কিছু চেয়ার-টেবিল আর কাঠের চুল্লি ছাড়া পুরো কক্ষটা প্রায় খালি। দেয়ালে ঝোলানো আছে ইউরোপীয় সংস্কৃতির শত বছর আগের তৈলচিত্র, শেক্সপিয়ারের ছবি-সংবলিত তথ্য। দোতলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হলো, জুলিয়েট ব্যালকনি। রোমিওর ডাকে সাড়া দিতে এখানেই এসে দাঁড়াত জুলিয়েট।
দোতলার একটি কক্ষে চিঠির কারবার। সেখানে যাঁরা এই চিঠি–সংক্রান্ত কাজ করেন, তাঁদের বলা হয় ‘জুলিয়েট সেক্রেটারিজ’। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরুণ–তরুণীরা এখনো জুলিয়েটের কাছে চিঠি লিখে প্রেম–সম্পর্কিত উপদেশ চান। এই চিঠির সংখ্যাও নেহাত কম নয়, প্রতিবছর প্রায় পাঁচ হাজার। যার তিন ভাগের দুই ভাগ চিঠিই লেখেন মেয়েরা। প্রেম–সম্পর্কিত নানান সমস্যার সমাধান, উপদেশ বা ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে এসব চিঠির উত্তর দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। জুলিয়েটের কাছে লেখা চিঠি এতই জনপ্রিয় যে লেটারস টু জুলিয়েট নামে হলিউডে আস্ত একটা রোমান্টিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।
শুধু চিঠিই নয়, অনেকে এখানে আসে নিজেদের মনের মানুষকে পাওয়ার জন্যও। প্রিয় মানুষের উদ্দেশে চিঠি বা চিরকুট লিখে জুলিয়েট হাউসের উঠানের চারপাশের দেয়ালে সেঁটে দেওয়ার রেওয়াজ আছে। আবার কেউ কেউ লাভ লকের ওপর দুজনের নাম লিখে মানত করে এখানের গ্রিলে আটকে রেখে যান। এমনকি পুরো উঠানের চারপাশের দেয়ালের প্রতিটা ইটের ওপরও একজন অন্যজনের উদ্দেশে লিখে রেখেছেন প্রেমময় কথা।
জুলিয়েটের শোবার ঘর
দোতলা থেকে প্যাঁচানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় তিনতলায়। এখানেই আছে জুলিয়েট বেডরুম, মানে জুলিয়েটের শোবার ঘর। আছে কাচের বাক্সে রাখা জুলিয়েট ও রোমিওর পোশাক, সেই সময়কার পালঙ্কসহ পুরোনো কিছু আসবাব। মজার ব্যাপার হলো, পুরো বাড়িতে শুধু জুলিয়েট শয়নকক্ষেই বিছানার দেখা মিলল। অন্য সব ঘর ফাঁকা, মনে হচ্ছিল কোনো আর্ট গ্যালারিতে এসেছি। চতুর্থ তলাটা যেন ছোটখাটো এক জাদুঘর। কাচের বাক্সে সংরক্ষণ করা আছে সেই সময়কার এই বাড়ির বাসিন্দাদের ব্যবহৃত সিরামিকের বাসনপত্র। সিঁড়িসহ এই তলার দেয়ালে সেই সময়কার ইতালীয় তৈলচিত্রগুলো মুগ্ধ করল।
জুলিয়েট স্পর্শ
জুলিয়েটের বাড়িতে এসে জুলিয়েটের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করাটা বোকামি। বাড়ির উঠানেই জুলিয়েটের পিতলের ভাস্কর্য। অনেকে এই ভাস্কর্যের বরাত দিয়ে বলে থাকেন, আদতেই হয়তো জুলিয়েট নামের কোনো তরুণী ছিলেন এই বাড়িতে। জুলিয়েটের ভাস্কর্যকে নিয়ে ভেরোনাতে একটা মিথ প্রচলিত আছে। যদি কেউ এই জুলিয়েটের ভাস্কর্যের ডান অংশে স্পর্শ করে, তাহলে সে শিগগিরই সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে পাবে। কে না চায় সত্যিকারের ভালোবাসা পেতে। তাই সেখানেই দেখা গেল দর্শনার্থীদের দীর্ঘ সারি! পাক্কা ১১ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আমারও সুযোগ হলো জুলিয়েটের কাছে যাওয়ার।
জুলিয়েট হাউস আমাদের বিদায় জানাতে হবে। কিন্তু এক অদৃশ্য বাঁধনে সবার মন বাঁধা পড়ল, আমাদের আরও কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করল। শুনেছিলাম, এ বাড়িতে কোনো ছেলে প্রবেশ করে বেরিয়ে আসে রোমিও হয়ে, মেয়ে হয়ে যায় একজন জুলিয়েট। শোনা কথা সত্যিই হয়তো! বাড়ির পরিবেশে রোমান্টিকতার আবহ আমাদের মোহাবিষ্ট করে রাখল।