জলজ ফুলের স্বাদ
ফুল মানেই সৌন্দর্যের ডালি, মনের খোরাক, পবিত্রতার প্রতীক। ফলে যুগে যুগে কবিরা ফুল নিয়ে লিখে গেছেন বিস্তর কবিতা। কালিদাস থেকে দ্বিজ কানাই, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ সবাই সৌন্দর্যের সঙ্গে ফুলের রূপকল্প চিত্রিত করেছেন দুহাত খুলে। কিন্তু কোনো কবিই লেখেননি, পাকা রাঁধুনির হাতে পড়ে ফুলও হয়ে উঠতে পারে এক অনির্বচনীয় কবিতা, স্বাদ কোরকে তুলতে পারে স্বর্গীয় অনুরণন।
বর্ষাবিদায়ের ক্ষণ চলছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা থাকলেও শুরু হয়েছে শরৎকাল। সাধারণভাবে এ সময় জলমগ্ন বাংলাদেশে থাকে নিরাগ পানির জলজ সৌন্দর্য। খালে-বিলে, থরে-বিথরে ফুটে থাকে লাল, সাদা, বেগুনি রঙের শাপলা ফুল। তার ওপর ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি। মনমাতানো এ দৃশ্যের রাজা শাপলা ফুল খাদ্য হিসেবেও মনমাতানো। খাল-বিলের এই দেশে জলজ ফুল শাপলা খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় হবে, এটাই স্বাভাবিক। জলাভূমিতে অনায়াসে জন্মানো সাদা বা লাল রঙের শাপলার পাপড়ি থেকে কাণ্ড পুরোটাই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খাওয়া হয়। এর জনপ্রিয় রান্না সম্ভবত চিংড়ি মাছ দিয়ে।
তাজা শাপলার ভেতরের হলুদ অংশটুকু সাবধানে ফেলে দিন। ওপরের সবুজ পাপড়িগুলোও ফেলে দিতে পারেন। ফুলটি ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। চালের গুঁড়া অথবা বেসনে লবণ, হালকা হলুদ, রসুনবাটা আর ডিম ভেঙে দিয়ে ঘন ব্যাটার বানিয়ে নিন। এই ব্যাটারে শাপলা চুবিয়ে ডুবো তেলে ভেজে নিন। ঝাল খেতে চাইলে মরিচের গুঁড়া কিংবা কাঁচা মরিচ স্বাদমতো বেটে ব্যাটারে মিশিয়ে নিতে পারেন। শরতের অকালবৃষ্টি আর করোনাকালের জন্য বিস্তৃত বৈকালিক অবসরে একবার খেয়ে দেখতে পারেন। অথবা গরম ভাতের সঙ্গে গরম গরম বড়াও খেয়ে দেখতে পারেন।
আর একটি রান্নার প্রণালি বলে দিই আপনাদের। শাপলার ডাঁটা ছোট ছোট করে কেটে নিয়ে ওপরের আঁশ ছাড়িয়ে নিয়ে ধুয়ে হালকা সেদ্ধ করুন, যাতে ডাঁটা গলে না যায়। এরপর মসুর ডাল সেদ্ধ করে নিন। কড়াইতে তেল গরম করে শুকনো মরিচ, কালিজিরা ফোড়ন দিন। চাইলে এর মধ্যে গোটা কয়েক রসুনের কোয়া দিয়ে হালকা করে নেড়েচেড়ে সেদ্ধ শাপলাগুলো দিয়ে দিন। লবণ, হলুদগুঁড়া দিয়ে ধীরে ধীরে নাড়াচাড়া করুন যাতে শাপলা ডাঁটা গলে না যায়। শাপলা যেহেতু জলজ উদ্ভিদ তাই এটা রান্নার সময় পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সবকিছু ফুটে উঠলে সেদ্ধ করা ডাল মিশিয়ে অল্প আঁচে জ্বাল দিয়ে শুকনো শুকনো করে নিন। ঘ্রাণেই বুঝে যাবেন কখন আপনার শাপলার তরকারি হয়ে গেছে। নামিয়ে গরম ভাতের সঙ্গে খাবেন। এ রান্নাটির সঙ্গে আপনি চিংড়ি মিশিয়ে দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ছোট চিংড়ি ভেজে নিতে হবে আগে। তারপর মিশিয়ে দিতে হবে রান্নায়।
শুধু কি শাপলা? কচুরিপানার ফুলও সুখাদ্য, যদি আপনি রান্নাটা করতে পারেন। তবে এর জন্য আপনাকে নিতে হবে পরিষ্কার পানির খাল-বিলে ফুটে থাকা কচুরিপানার ফুল। এর চাটনি বেশ সুস্বাদু। বিভিন্নভাবেই চাটনি বানানো সম্ভব। আপনি নিজেই ভেবে বের করুন চাটনিটা তৈরি করবেন কীভাবে।
বর্ষাকালে কচুর ফুল ফোটে। তবে এই ভাদ্র মাসের ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতেও কচুর ফুল পাবেন। আঁটি হিসেবে বাজারে কিনতে পাবেন এ সময়। কচুর ফুল থেকে সবুজ রঙের ডাঁটা এবং ভেতরের পুষ্পমঞ্জরি বাদ দিন। তারপর হলুদ ফুল ছোট ছোট টুকরা করে কেটে সেদ্ধ করে নিন। এরপর পাঁচফোড়ন অথবা শুধু জিরা এবং কাঁচা মরিচ ফোড়ন দিয়ে সেদ্ধ কচুর ফুল কষিয়ে নিন। এর সঙ্গে অনেক কিছুই যোগ করতে পারেন আপনি। পারেন কাঁঠালের বিচি যোগ করতে, ছোট চিংড়ি মাছ যোগ করতে। কাঁঠাল বিচি যোগ করলে আগেই সেদ্ধ করে নেবেন। তারপর কষানোর সময় যোগ করে দেবেন। আর চিংড়ি যোগ করতে চাইলে ভেজে নেবেন।
একটি বিষয় স্মরণ রাখবেন, সেটি মসলার ব্যবহার। ফুলের মতো নাজুক জিনিসে ভারী মসলা, যেমন, রসুন, গরমমসলা ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না। জিরা, গোলমরিচের মতো হালকা মসলা ব্যবহার করুন। পাঁচফোড়নের ব্যবহারে খাবারের স্বাদ হবে একেবারে ভিন্ন রকম।
ফুল সুন্দর, খাদ্যও সুন্দর। সৌন্দর্যের উপাসনা করতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগবেন না। কবি কিংবা রাঁধুনি উভয়েই সৌন্দর্যের পূজারি। ন্দর্যে থাকুন। সুন্দর থাকুন।