চা–বাগানের অদম্য মেয়েরা
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো পরিবারের প্রথম নারী, যাঁরা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারছেন না, তাঁদের অনুপ্রাণিত করার জন্য দেওয়া হয় আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ বৃত্তি। এ বছর এই শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছেন ১০ জন। এই ১০ জনের সবাই মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার চা-শ্রমিকের সন্তান। প্রথম আলো ট্রাস্ট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির উদ্যোগে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের এই শিক্ষার্থীরা অদ্বিতীয়া বৃত্তি পাবেন। এই শিক্ষার্থীদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয় এইউডব্লিউ। পড়ুন ১০ অদ্বিতীয়ার জীবনের গল্প
সংসারের আয় দৈনিক ১২০ টাকা : মনি পাল
পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আর চা-বাগানে কাজ করতে পারেন না আমার বাবা অনিল কুমার রেলী। মা সারথী রানী রেলী চা-শ্রমিকের কাজ করে দিনে ১২০ টাকা মজুরি পান। এই অল্প আয়ে সংসার চালানো খুব কঠিন। স্বপ্ন ছিল আমি এইউডব্লিউতে পড়ব। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন আমি একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে দরিদ্র ভাইবোনদের সাহায্য করতে চাই। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টে জীবন কেটেছে। অদ্বিতীয়া বৃত্তির জন্য মনোনীত হয়ে আমার খুব উপকার হলো।
বিসিএস ক্যাডার, নয়তো গুগলের কর্মী হব : অঞ্জলি রানী ভৌমিক
স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। কিন্তু এইচএসসি পাসের পর ভর্তি কোচিং করার মতো পারিবারিক অবস্থা আমাদের ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইভায় যেদিন বাদ পড়লাম, মনে হয়েছিল জীবনটা শেষ হয়ে গেল। দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পেয়েও আমার মা-বাবা ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে কখনো কার্পণ্য করেননি। এখন আমার ভাই টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ে, বোন পড়ে দশম শ্রেণিতে। মা-বাবার অনুপ্রেরণাতেই আমি এইউডব্লিউতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। ভবিষ্যতে বিসিএস ক্যাডার হতে চাই, নয়তো গুগলে চাকরি করতে চাই।
মা-বাবার কষ্টটা ছোটবেলা থেকে বুঝতাম : বৃষ্টি অধিকারী
মৌলভীবাজারের লংলা চা-বাগানে বড় হয়েছি। মা-বাবার স্বল্প আয়ে যে ছয়জনের একটি পরিবার চালানো কঠিন, সেটা আমি ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম। তাই সব সময় মন দিয়ে পড়ালেখা করেছি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বৃত্তিসহ আমাদের গ্রামের ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই। স্কুল শেষে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। তখন টিউশনি করেছি। অনেক কষ্টে এইচএসসি পেরোনোর পর যখন ভর্তি কোচিং করতে পারলাম না, তখন মনে হয়েছিল পড়ালেখা বোধ হয় আর করা হবে না। এইউডব্লিউ আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে।
ভেবেছিলাম পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে: বন্যা উরাং
ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছিলাম। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে বাদ পড়ে যাই। শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। তিন ভাইবোন ও আমাকে পড়ালেখা করানো মা-বাবার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। একসময় তাঁরা ভাবলেন আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন। এমন সময় এক বান্ধবীর কাছে এইউডব্লিউর খবর পেলাম। পরীক্ষা দিলাম। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। ভাগ্যিস সুযোগ পেয়ে গেলাম। নইলে হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো।
হাইস্কুল ছিল অনেক দূরে: আফরিন মৌ
আমার হাইস্কুলা ছিল অনেক দূরে। প্রথমে পায়ে হেঁটে, তারপর গাড়িতে করে যেতে হতো। প্রাইভেট পড়ার মতো অবস্থা ছিল না। দশম শ্রেণিতে ওঠার পর আমাদের প্রধান শিক্ষক বিনা খরচে কোচিং করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। হোস্টেলে থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমাদের বাগানে যিনি ম্যানেজার ছিলেন, তিনিই আমাকে এইউডব্লিউর খবর দেন। আগামী পাঁচ বছর আমার পড়ালেখার খরচ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে, এটা অনেক বড় পাওয়া। সঙ্গে অদ্বিতীয়া বৃত্তি আমাকে সাহস দেবে।
বিয়ে ভেঙেছিলাম বলে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল : প্রিয়াংকা গোয়ালা
কলেজে পড়ার সময় হঠাৎ একদিন আমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসে। আত্মীয়স্বজনের কথা শুনে মা-বাবাও রাজি হয়ে যান। আমি তো পড়ালেখায় ভালো, তবু কেন আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে! এসব ভেবে খুব কাঁদতাম। এক দিকে মা-বাবা নিচ্ছিলেন আমার বিয়ের প্রস্তুতি, অন্যদিকে আমি এইউডব্লিউতে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে থাকি। বাড়িতে কাউকে জানাইনি। একসময় মা পাশে দাঁড়ালেন। সাহস পেলাম। বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলাম বলে আমার পুরো পরিবারকে ওরা বাড়ির চারপাশে পেট্রল ছিটিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি পিছপা হইনি। এইউডব্লিউ পড়া শেষ করে আমার একটা নৈশ স্কুল খোলার স্বপ্ন, যেখানে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে আমি মানুষের জন্য কিছু করব।
গর্ব করে বলতে চাই, আমি চা-শ্রমিকের সন্তান: প্রিয়াংকা মাহালী
আমরা পাঁচ বোন। বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার পর আর চা-বাগানে কাজ করতে পারেন না। মা কাজ করে পরিবারের খরচ চালান, আর আমি সেলাই করে নিজের পড়ালেখা চালাই। আমার স্বপ্ন, বড় হয়ে ইংরেজির অধ্যাপক হব। কারণ, আমাদের চা-বাগানে কমবেশি অনেকেই এগোতে পারে না ইংরেজিতে দক্ষ নয় বলে। এইউডব্লিউতে ভর্তি হতে পারা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। মা-বাবা আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আগামী প্রজন্মের জন্য আমি এমন কিছু করতে চাই, যেন গর্ব করে বলতে পারি, আমি চা-শ্রমিকের সন্তান।
মাকে বহুবার কাঁদতে দেখেছি: সোমা গোস্বামী
চা-বাগানে এক যৌথ পরিবারে আমার জন্ম। আট সদস্যের পরিবারে বাবা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমাদের সমাজে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে অনেক ভেদাভেদ আছে। তবু মা-বাবা কখনো আমাদের খেলাধুলা-পড়ালেখায় বাধা দেননি। আত্মীয়স্বজনের কথা শুনে মাকে বহুবার কাঁদতে দেখেছি। এমনও হয়েছে, স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা যাতায়াত ভাড়া দিতে পারেননি বলে সবাই আমাকে ফেলে চলে গেছে। আমি একা একা গিয়েছি। কিন্তু পড়া থামাইনি। কলেজের উপবৃত্তিতে যখন নাম এল না, ভেবেছিলাম আর পড়া হবে না। তখন প্রথম আলোর একজন সাংবাদিক আমাকে সাহায্য করেছিলেন, তাই পড়ালেখাটা এগিয়ে নিতে পেরেছি। পড়ালেখা শেষ করে আমি সমাজের জন্য কাজ করতে চাই।
চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করতে চাই: বিন্টি তাঁতী
মা, ভাই, কাকা, কাকি, কাকাতো দুই ছোট বোন আর আমি একসঙ্গে থাকি। সাত মাস বয়সে আমার বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। মা চা-পাতা তুলে আমাদের মানুষ করেছেন। বাবার অনুপস্থিতি কাকু কখনো বুঝতে দেননি। সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। বাগানের অন্য অনেক মেয়ের মতো আমাকেও তিনি বিয়ে দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু কাকু চান আমি পড়ালেখা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হই। আমি আমার পরিবারের জন্য, চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করতে চাই।
বাগানের মেয়েদের বিনা খরচে কোচিং করাই: মনি মুন্ডা
স্কুলে ভীষণ ভালো ছাত্রী হয়েও আমি যখন উচ্চমাধ্যমিকে পদার্থবিজ্ঞানে ফেল করলাম, কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। আমি তো কাউকে বলতে পারছিলাম না, বাড়িতে পড়ার পরিবেশ তেমন একটা ছিল না। হাইস্কুল প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে, তাতে আমার উপকারই হয়েছিল। রাস্তায় যেতে যেতে পড়তাম। আমরা চার বোন। বাবা খুব সাহায্য করতেন, সাহস দিতেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর পড়ালেখা করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। মা বলতেন, ‘সবাই সপ্তাহে এক-দুই দিন কলেজে যায়। তোর কেন প্রতিদিন যাওয়া লাগে?’ দ্বিতীয়বার এইচএসসি দিয়ে কীভাবে পাস করলাম, কীভাবে এইউডব্লিউতে পড়ার সুযোগ পেলাম, এখনো অবিশ্বাস্য লাগে। এখন পড়াশোনার পাশাপাশি আমি আমাদের বাগানের ছেলেমেয়েদের বিনা খরচে কোচিং করাই।