চাকা আবিষ্কারের আগে মানুষ আরও কত কিছু জানত
পুরো বিশ্ব চলছে চাকার ওপর। এই কথাটিতে কেউ দ্বিমত করবেন বলে মনে হয় না। শুধু চাকার বদৌলতে গোটা মানবসভ্যতা এক লাফে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। চাকাকে যন্ত্রকৌশলের আদি পুরুষ বলে ধারণা করা হয়। যাতায়াত ব্যবস্থাতে চাকার অবদান সাদা চোখেই অনুধাবন করা যায়।
মানুষ চাকা উদ্ভাবন করেছে নাকি আবিষ্কার—এ নিয়ে ঢের বিতর্ক আছে। তবে পৃথিবীতে চাকার আবির্ভাব খুব বেশি দিনের নয়। খ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে তিন হাজার বছর আগে চাকার খোঁজ মেলে। অর্থাৎ এখনকার সময় হিসাবে নিলে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে পাওয়া যায় প্রথম চাকা।
মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য গড়ে দিয়েছে চাকা। মানবসভ্যতায় চাকার অভাবিত অবদানের কারণে অনেকেই মনে করেন, এটিই হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন আবিষ্কার। কিন্তু আদতে তা নয়। এমন কিছু জিনিস চাকার আগেই এই ধরণিতে এসেছে, যা জানলে অবাক হতে হয়। আসুন, জেনে নেওয়া যাক এমনই কিছু প্রাচীন আবিষ্কারের খবর:
১. জামাকাপড়
চাকার অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয় পরিধানের কাপড়। যে কাপড়ের ছবিটি দেখা যাচ্ছে, সেটি পাওয়া গেছে মিসরে। কমপক্ষে ৫ হাজার ১০০ বছরের পুরোনো এটি। জার্মানিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রাচীন যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ১ লাখ বছর আগে মানুষের ভিন্ন প্রজাতি নিয়ানডারথাল পশুর চামড়া কাপড় হিসেবে পরিধান করত। ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের বস্ত্রের ইতিহাস প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার বছরের পুরোনো।
২. অলংকার
গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চাকা আবিষ্কারের বদলে অলংকারের প্রতিই প্রাচীন মানুষ বেশি আগ্রহী ছিল। মরক্কোতে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন অলংকারগুলো প্রায় ৮২ হাজার বছরের পুরোনো। এগুলো মূলত শামুকের খোল দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়া ক্রোয়েশিয়ায় নিয়ানডারথাল মানবের গুহায় পাওয়া গেছে ১ লাখ ৩০ হাজার বছরের পুরোনো ইগলের নখের নেকলেস। রাশিয়াতে এক প্রাচীন কবর খুঁড়ে অলংকারে সজ্জিত দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। সেখানে অতিকায় হাতির (ম্যামথ) দাঁতের তৈরি অলংকার পাওয়া গেছে।
৩. মদ
কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে, মানুষ প্রথম শস্যদানা উৎপাদন শুরু করেছিল রুটি বানানোর জন্য নয়, বরং নেশাজাতীয় পানীয় তৈরির জন্য শস্যদানার উৎপাদন শুরু হয়েছিল। মানবসভ্যতায় নেশাজাতীয় পানীয়ের প্রভাব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু এর বয়স নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। চীনের জিহাউ অঞ্চলে একটি পাত্রে সবচেয়ে প্রাচীন মদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর বয়স প্রায় ৯ হাজার বছর।
৪. নৌকা
পশুতে টানা গাড়ি উদ্ভাবনের আগে মানুষ নৌকা ও ভেলা তৈরি করে তাতে চলাচলে অভ্যস্ত ছিল। নেদারল্যান্ডসে পাওয়া গেছে ১০ হাজার বছরের পুরোনো ভেলা, যা ‘প্যাসে ক্যানু’ নামে পরিচিত। একেই মনে করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো নৌকা।
৫. দিনপঞ্জি
সময়ের হিসাব রাখা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। আর এর জন্য দিনপঞ্জির বিকল্প নেই। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক বলছেন, স্কটল্যান্ডে পাওয়া গেছে সবচেয়ে প্রাচীন দিনপঞ্জি। এর বয়স প্রায় ১০ হাজার বছর। এসব গবেষকের মতে, এই দিনপঞ্জিতে চান্দ্রমতে ক্ষণগণনার ব্যবস্থা ছিল।
৬. মানচিত্র
বিশ্বে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে প্রাচীন মানুষদের প্রয়োজন ছিল মানচিত্রের। প্রয়োজনের খাতিরেই তাই চাকার আগেই মানচিত্র আবিষ্কার করেছিল মানুষ। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে, স্পেনের একটি গুহায় পাওয়া গেছে ১৪ হাজার বছরের পুরোনো একটি মানচিত্র। তাতে নাকি খোদাই করা আছে নদী, পাহাড় ও নানা ধরনের পথের দিকনির্দেশ।
৭. রন্ধনপ্রণালি
আগুন আবিষ্কারের পরপরই মানুষ রান্নায় ঝুঁকে পড়ে। গবেষকেরা বলছেন, মাংস বা লতাপাতা আগুনে রান্না করে খেলে, তা চিবোতে এবং হজম করতে শক্তিক্ষয় কম হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ রান্নায় মনোনিবেশ করেছিল। ধারণা করা হয়, প্রায় ৫০ হাজার বছর আগেই রান্নার চল শুরু করে মানুষ। এর সপক্ষে তথ্য-প্রমাণও মিলেছে।
৮. মৃৎশিল্প
চাকার আবির্ভাবের হাজার বছর আগ থেকেই মানুষ বিভিন্ন পাত্র বানাতে শেখে। পানি রাখা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন নানা কাজে এসব পাত্র ব্যবহার করা হতো। চীনে সবচেয়ে পুরোনো সিরামিকের তৈরি পাত্র পাওয়া গেছে। এর বয়স প্রায় ২০ হাজার বছর। অনেক গবেষক বলেন, কুমারদের কারণেই প্রথম চাকা উদ্ভাবিত হয়েছিল। কারণ, মৃৎশিল্পের বিকাশের পেছনেও চাকার অবদান অপরিসীম।
৯. তির-ধনুক
ডেনমার্কে পাওয়া প্রস্তরযুগের সময়কার জিনিসপত্রে তির-ধনুক খোদাই করা ছিল। এগুলো ৯ হাজার বছরের পুরোনো। মূলত পশু শিকারের প্রয়োজন থেকেই তির-ধনুকের আবির্ভাব। পশু শিকারের জন্য প্রাচীন মানুষের কাছে তির-ধনুক ছিল সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণের পর কিছু গবেষকের দাবি, ৬৪ হাজার বছর আগেও তির-ধনুকের অস্তিত্ব ছিল।
১০. বাদ্যযন্ত্র
চাকার আগেই মানুষ সংগীতের অনুরাগী হয়েছিল। এ জন্য প্রয়োজন ছিল বাদ্যযন্ত্র। ৪৩ হাজার বছরের পুরোনো বাঁশি পাওয়া গেছে জার্মানিতে। একেই মনে করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বাঁশি। পাখির হাড় ও ম্যামথের (অতিকায় হাতি) দাঁত দিয়ে এই বাঁশি তৈরি করা হয়েছিল। বেশ চিকন এই বাঁশিতে নাকি সুরও উঠত বেশ।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, গার্ডিয়ান, বিবিসি, নেচার ডট কম, সায়েন্সম্যাগ ডট অরগ, মেন্টাল ফ্লস, ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও ও নিউইয়র্ক টাইমস