কাকতাড়ুয়াদের কথা
সিলেটের তরুণদের সংগঠন কাকতাড়ুয়া। সমাজের নানা অসংগতি রুখতে ছয় বছর ধরে সচেতনতা তৈরির কাজ করে চলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির সদস্যরা। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছে সম্মাননাও। সংগঠনটির বিভিন্ন কর্মসূচির কথাই রইল এই রচনায়।
সংগঠনের নাম কাকতাড়ুয়া কেন?
উত্তরটা যেন ঠোঁটের ডগায় তৈরি রেখেছিলেন ফয়সাল খলিলুর রহমান। প্রশ্ন শুনে চট করে বললেন, ‘বাস্তবের কাকতাড়ুয়া যেমন ফসলের খেত থেকে কাক তাড়ায়, আমরা সমাজ থেকে নানা অসংগতি দূর করতে কাজ করি।’
কাকতাড়ুয়ার প্রতিষ্ঠাতা ফয়সাল খলিলুর রহমান। ২০১৩ সালে তিনি ও তাঁর বন্ধু শুভ সরোয়ারের উদ্যোগেই সংগঠনের গোড়াপত্তন। তাঁদের সঙ্গে কাকতাড়ুয়া নিয়ে এই আলাপ বছর কয়েক আগে, সিলেটে বসে। তখনো তাঁরা সিলেটে বাংলা বানান শুদ্ধি নামের একটি কর্মসূচিই চালাতেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভুল বানানগুলো রংতুলি হাতে ঠিক করে দিতেন। ধীরে ধীরে বিস্তৃতি বাড়ে সংগঠনের কার্যক্রমের, যুক্ত হন নতুন অনেক সদস্য। ২০১৭ সালে সামাজিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সংগঠনটি পেয়েছে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ সম্মাননা।
২২ আগস্ট সংগঠনটির এগিয়ে চলার কথাই কাকতাড়ুয়ার আহ্বায়ক ও এমসি কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী পাপলু দের সঙ্গে ফোনালাপে জানলাম। শুরুতেই তিনি বললেন, ‘কাকতাড়ুয়াকে এখন আমরা স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্রবিষয়ক সংগঠন বলি।’
এমন পরিচিতির কারণও সহজেই বোঝা গেল কাকতাড়ুয়ার উদ্যোগে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো দেখে। কাকতাড়ুয়ার তরুণদের হাতেই তৈরি হয়েছে মাদক ও যুবসমাজের অবক্ষয়বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তাঁরা ক্যামেরা হাতে নির্মাণ করছেন মুঠোফোনে প্রতারণা, ইভ টিজিং, ধর্ষণ, ফলে ফরমালিন মেশা, শহরের যত্রতত্র ময়লা ফেলাসহ বিভিন্ন সামাজিক অসংগতি ও সমস্যাবিষয়ক চলচ্চিত্র। এসব চলচ্চিত্র দিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করছেন তাঁরা।
শুধু সমস্যার কথাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা প্রচার করতে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে যুদ্ধদিনের কথা ধারণ করে প্রচার করছেন। নির্মাণ করছেন ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ভিডিও। এগুলো কাকতাড়ুয়ার ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করা হয়েছে।
এসব সৃষ্টিশীল কাজে প্রায় ১০০ সদস্য প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। যাঁরা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট সরকারি কলেজ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মদনমোহন কলেজসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তরুণ এই সদস্যরা প্রতি মাসে ৫০ টাকা চাঁদা দিয়ে আয়োজন করেছেন সব ব্যতিক্রমী কর্মসূচি।
শুরুটা বানান শুদ্ধি অভিযানে
২০১৪ সালের কথা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রভাতফেরি শেষে কাকতাড়ুয়ার সদস্যরা সমবেত হয়েছিলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকেই তাঁরা শুরু করেন বানান শুদ্ধির অভিযান। ২০ জন সদস্য মিলে রংতুলি হাতে ভুল বাংলা বানানগুলো শুদ্ধ করে দিয়েছেন। এরপর প্রায় প্রতি মাসেই কাকতাড়ুয়ারা সিলেট শহরের অলিতে–গলিতে ঘুরে বেড়ান। এখন পর্যন্ত সিলেট নগরীর ৩১৫টি প্রতিষ্ঠানকে বানান শুদ্ধির জন্য অনুরোধ করেছেন। এর মধ্যে ২০২টি প্রতিষ্ঠানে বানান শুদ্ধ করতে কাকতাড়ুয়ার দল হাজির হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, দলটি সিলেটের বিভিন্ন ছাপাখানা ও আর্টিস্টদের কাছেও শুদ্ধ বাংলা লেখার প্রচারণা পৌঁছে দিয়েছে।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ আর বানান শুদ্ধির কাজ ছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়েন কাকতাড়ুয়ার সদস্যরা।
গান গেয়ে দুর্গতদের পাশে
সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওর এলাকা শাল্লা। পাহাড়ি ঢলে প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলাকার মানুষ। ২০১৮ সালের মে মাসে অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছিল। হঠাৎ বন্যায় এলাকার মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছিল। পাপলু দে বলছিলেন, ‘বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারলাম, পত্রিকার পাতায় যে করুণ অবস্থার কথা সবাই জানছি, বাস্তব অবস্থা তার চেয়েও ভয়ংকর।’
তাঁরা জানলেন, প্রান্তিক কৃষকদের পাশাপাশি বড় কৃষকদেরও সব ফসল ডুবে গেছে। হাওরের এমন দুর্দিনে কাকতাড়ুয়ার সদস্যরা উদ্যোগী হলেন। বৈঠক করে ঠিক করলেন, গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহের। সপ্তাহখানেক ধরে সিলেট শহরের অলিগলি ঘুরে ঘুরে তরুণ দল গান গাইল। দুর্গতদের অবস্থার কথা প্রচার করে তুলল অর্থ। তাঁদের উদ্যোগের সঙ্গে সিলেটের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হলেন। শুধু সিলেটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে হাওরের জন্য গান গেয়েছেন সংগীত বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী। টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটিও গিটার হাতে রাস্তায় বসে গেছে সে সময়।
সংগৃহীত হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা। সেই টাকা নিয়ে কাকতাড়ুয়ার সদস্যরা হাজির হন দুর্গত মানুষের পাশে। খামে টাকা ভরে তা তুলে দেন ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের হাতে। হাওরের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সেই সুখস্মৃতি এখনো সতেজ পাপলু দের কথায়।
তারকার সন্ধানে
সিলেটের সৃষ্টিশীল তরুণদের দলে ভেড়াতে কাকতাড়ুয়ার আয়োজন ‘সিলেটের তারকা’। যাঁরা চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্রে আগ্রহী, যাঁরা নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তিতে পারদর্শী, তাঁদের নিয়েই এই প্রতিযোগিতা। প্রথমে আগ্রহীদের নিবন্ধন করানো হয়। এরপর চলে কয়েক পর্বে অডিশন। চূড়ান্ত পর্বে একজন মেয়ে ও একজন ছেলেকে ঘোষণা করা হয় সিলেটের তারকা। কাকতাড়ুয়ার সদস্যসচিব ও সিলেট সরকারি কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নওরীন ইসলাম বলছিলেন, ‘দুজন তারকা নির্বাচন করা হলেও আগ্রহীদের আমরা সদস্য হিসেবে সংগঠনে নিই। নতুন সদস্য নেওয়ার ক্ষেত্রে এই আয়োজন বেশ কাজের। আমরা শুরুতেই জেনে যাই কার কোন বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে, কোন বিষয়ে আগ্রহ আছে।’
এই আগ্রহী তরুণেরাই তো সত্যিকারের কাকতাড়ুয়া। নওরীনের কথায়, সমাজের অসংগতি দূর করতে তো দক্ষ আর আগ্রহী তরুণদেরই প্রয়োজন। কাকতাড়ুয়ার এমন উদ্যমী তরুণদের হাত ধরেই সমাজ থেকে দূর হবে অসংগতি, সচেতনতার বার্তা পাবে মানুষ, দুর্গত মানুষ পাবে ভরসার আশ্রয়।