কনটেন্ট বানিয়ে তাঁরা কোটিপতি
ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য কনটেন্ট বানিয়ে বিশ্বজোড়া পরিচিতি পেয়েছেন এবং আয় ভালো, এমন পাঁচ কনটেন্ট নির্মাতার গল্প শোনাচ্ছেন মো. জান্নাতুল নাঈম
জ্যাক কিংয়ের ডিজিটাল জাদু
সুকুমার রায়ের লেখায় আমরা পড়েছি—‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল’। এমনই আশ্চর্য সব জাদু দেখিয়ে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় তাক লাগিয়েছেন জ্যাক কিং। তবে জ্যাক কিংকে ঠিক জাদুকর বা জাদুশিল্পী বলা যাচ্ছে না। কারণ, তাঁর সব জাদুই আদতে ভিডিও বা সম্পাদনার খেল। জ্যাক এমনভাবে ছোট ছোট ভিডিও ধারণ বা সম্পাদনা করেন যে দেখে সাধারণের চোখ ধোঁকা খায়। আর এই ভিডিওর ভেলকি দেখিয়েই তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এই মার্কিন ‘ইলিউশনিস্ট’।
মাত্র সাত বছর বয়সে সাধারণ ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে একটা চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলেছিলেন জ্যাক। তখন কেউ কি ভেবেছিল, ভিডিও বানিয়ে এই ছেলে সাড়ে ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (প্রায় ৫৬ কোটি টাকা) মালিক হবে!
ছোটবেলা থেকেই জ্যাকের ভিডিও সম্পাদনার প্রতি ঝোঁক। একসময় অন্যকে এডিটিং শেখাতেই ভিডিও বানানো শুরু করেন ইউটিউবে। তবে সেটা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সারা দুনিয়ার কাছে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে একটা ছোট্ট ভিডিওর মাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যায়, দুটা বিড়াল স্টার ওয়ার্স ছবির মতো লাইটসেবর হাতে মারামারি করছে। ২০১১ সালে প্রকাশিত হওয়া সেই ভিডিও ৩ দিনের মধ্যেই ১০ লাখের বেশি ভিউ পেয়ে যায়। এরপর থেকে নানা রকম জাদু দেখাতে থাকেন জ্যাক। বাড়তে থাকে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা। এখন ইউটিউবে তাঁর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লাখের বেশি। ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুসারী ২ কোটি ৪৫ লাখ। টিকটকেও তিনি বেশ জনপ্রিয়।
চাকরি হারিয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক
‘আপনি এখনো এখানে? এ অফিসে আর আপনাকে দেখতে চাই না’, বসের মুখে এমন কড়া কথা শুনে অফিস ছেড়েছিলেন হুদা কাত্তান। মন খারাপ করে কিছুদিন ভেবেছেন, কী করা যায়। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেন, ‘যেটা করতে ভালোবাসি, সেটাই করব।’
ব্যস, এভাবেই জন্ম নিল বিখ্যাত ব্র্যান্ড—‘হুদা বিউটি’। অর্থনীতিতে স্নাতক হুদা কাত্তান এই কসমেটিক ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী। স্নাতক শেষ হওয়ার এক বছরের মাথায় চাকরি হারিয়েছিলেন। এরপর কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করেন মেকআপ ব্লগিং। দুই বছরের মধ্যে তাঁর বেশ একটা ভালো সংখ্যক ভক্ত দাঁড়িয়ে যায়, যাঁরা মেকআপ–সংক্রান্ত টিউটোরিয়াল দেখতে পছন্দ করেন। ইনস্টাগ্রামেও বাড়তে থাকে হুদার অনুসারী। এই অনুসারীদের গ্রাহক বানানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তাই কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে, দুই বোনের কাছ থেকে ছয় হাজার ডলার (প্রায় পাঁচ লাখ টাকা) ধার নিয়ে শুরু করেন ফলস আইল্যাশের ব্যবসা। এরপর একে একে বাড়িয়েছেন পণ্য, ব্যবসার প্রসার হয়েছে বিভিন্ন দেশে। মার্কিন এই ইনস্টাগ্রাম তারকার অনুসারীর সংখ্যা এখন পাঁচ কোটির বেশি। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫১০ মিলিয়ন ডলারের (৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি) মালিক এই ইনফ্লুয়েন্সার।
ছোট ডায়ানা, বড় তারকা
ছোট্ট সোনামণিরা চোখের সামনে খেলছে, ছুটছে। কখনো আবার খেলনা না পেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। এ রকম স্মৃতিগুলো ফ্রেমে বন্দী করে রাখতে চান অনেকেই। ইউক্রেনের দম্পতি এলেনা ও ভ্লাদও তা-ই চাইতেন। মেয়ে ডায়ানা জন্ম নেওয়ার পর ২০১৫ সালে ইউটিউব চ্যানেল খোলেন এলেনা। ডায়ানার বেড়ে ওঠার স্মৃতি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তবে সেই ভিডিও শুধু কাছের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। বছর ঘুরতেই তাঁদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেছেন ১০ লাখ মানুষ। চ্যানেলটির নাম ‘কিডস ডায়ানা শো’। ইতিমধ্যে চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৯ কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়েছে।
শিশুদের জন্য পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই চ্যানেলটির কনটেন্টগুলো বেশ মজার। ডায়ানা ও তার ভাই রোমার কর্মকাণ্ডই এটির মূল আকর্ষণ। নানা রকম মজার খেলাধুলা, অ্যানিমেশনসহ বিভিন্ন গল্পে সাজানো হয় ভিডিওগুলো। তাই শিশুরাও খুব আনন্দ নিয়ে দেখে। এ ছাড়া এই চ্যানেলের গানগুলো শিশুদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। শিশুদের জন্য গাওয়া ডায়ানার গান ‘লাইক ইট’ এরই মধ্যে ১৭০ কোটি বার দেখা হয়েছে। ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনাকে পেশা হিসেবে নিতে ২০১৭ সালেই চাকরি ছেড়েছিলেন ডায়ানার মা-বাবা। পরে পকেট ডট ওয়াচ নামের একটি শিশুতোষ মিডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে চ্যানেলকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। ধারণা করা হয়, প্রায় ২৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা) মালিক কিডস ডায়ানা শোয়ের স্বত্বাধিকারী।
বিশ্ববিদ্যালয় ড্রপআউট, এখন বিশ্বের এক নম্বর ইউটিউবার
বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ততটা টানত না। তাই ড্রপআউট হয়েছিলেন ফিলিক্স শেলবার্গ। ছেলের এমন সিদ্ধান্তে মা-বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘পড়ালেখা না করলে কাজ করো।’ অগত্যা হট ডগ বিক্রির কাজে নেমেছিলেন এই তরুণ। আঁকাআঁকিতে ভালো হাত ছিল। নিজের আঁকা ছবিগুলো বেচে কিছু টাকাপয়সা হাতে আসায় ছেড়ে দেন সেই কাজও। একটা চলনসই কম্পিউটার কিনে শুরু করেন ভিডিও সম্পাদনার কাজ।
ফিলিক্স শেলবার্গ নামটা আপনার কাছে অপরিচিত ঠেকতে পারে। কিন্তু ইউটিউব সম্পর্কে যাঁদের একটু জানাশোনা আছে, পিউডিপাইকে তাঁরা নিশ্চয়ই চেনেন। তাঁকে বলা হয় বিশ্বের এক নম্বর ইউটিউবার। গেমিং ভিডিও বানিয়েই মূলত পেয়েছেন এই তুমুল জনপ্রিয়তা। পিউডিপাই গেম খেলেন, সঙ্গে ধারাভাষ্য দেন, কখনো উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠেন, আর এসবই বুঁদ হয়ে দেখেন লাখো দর্শক।
ভিডিও গেমের মধ্যে মাইনক্রাফট ফিলিক্সের বেশ প্রিয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের গেম খেলে সেগুলোর ভিডিও তৈরি করেন। কৌতুকনির্ভর ভিডিও বানিয়েও ভালো সাড়া পেয়েছেন এই সুইডিশ তারকা। ২০১০ সালে প্রথম ইউটিউব চ্যানেল খোলেন। ১০ লাখ সাবস্ক্রাইবার পান ২০১২ সালের শুরুতে। সে বছরই সেটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে পিউডিপাই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সাবস্ক্রাইব হওয়া চ্যানেলের তকমা পায়। এখন পিউডিপাইয়ের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১১ কোটি ১০ লাখ। তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ডলার (প্রায় ৪৩১ কোটি টাকা)।
ফেসবুক থেকে টিভি সিরিজে
ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ ভাইন দিয়ে শুরু হয়েছিল লোগান পলের কনটেন্ট নির্মাণ। কলেজে যাওয়ার আগেই তাঁর বেশ ভালোসংখ্যক অনুসারী তৈরি হয়ে যায়। তাই মাথায় চেপেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই নিজের ‘অফিস’ হিসেবে বেছে নেওয়ার ভূত। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষে এসেও ড্রপআউট হয়ে পাড়ি দেন লস অ্যাঞ্জেলেসে। প্রথম দিকে লোগান কমেডি স্কেচের ভিডিও করতেন। এই ভিডিওগুলো ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাড়তে থাকে তাঁর জনপ্রিয়তা। ২০১৫ সালে তাঁর একটি ভিডিও ৩০ কোটির বেশি ভিউ পায়। এই জনপ্রিয়তা তাঁকে অভিনয়ের জগতে পা রাখতে সহায়তা করে। তাঁকে ফক্স টিভি সিরিজ উইয়ার্ড লোনার্স-এ পল টুইনসের চরিত্রে দেখা গেছে। এ ছাড়া তিনি ফ্রিডম সিরিজের স্টিচার্সেও অভিনয় করেছেন। পল বক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত। এখন ফেসবুকে তাঁর ফলোয়ার প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ। প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের (প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা) মালিক তিনি।