অভিযান
কঙ্গোতে জিম্মি সেনাদের যেভাবে উদ্ধার করেছি
কঙ্গোর মানুষখেকো লেন্দু জনগোষ্ঠীর গেরিলারা ২০০৬ সালে এক চোরাগোপ্তা হামলায় জাতিসংঘের সাত শান্তিরক্ষীকে জিম্মি করে। নেপালি সেনাবাহিনীর সেই সদস্যদের উদ্ধার অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম নিজেকে নিয়োজিত করেন। দুর্গম পাহাড়ি অরণ্যে ৪৫ দিনের চেষ্টায় তিনি জিম্মিদের উদ্ধার করেন, গেরিলাদেরও ফিরিয়ে আনেন স্বাভাবিক জীবনে। সেই রোমহর্ষ উদ্ধার অভিযান নিয়ে সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে নেপালি জিম্মিদের উদ্ধার অভিযান: মানুষখেকোদের সঙ্গে জঙ্গলজীবন নামে বই বেরিয়েছে। বইটির প্রেক্ষাপটে উদ্ধার অভিযানের একপ্রস্থ এখানে।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে আমার কঙ্গো গমন। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত কঙ্গোয় আন্তগোত্র সংঘাতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের জীবন বিলীন হয়ে গেছে। জীবিতদের জীবনও বিপন্ন। এই অসহায় মানুষদের পাশে তখন ৯১টি দেশের আমরা ১৮ হাজার শান্তিরক্ষী।
কঙ্গো বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় ১৮ গুণ বড়। কঙ্গোর পূর্বাঞ্চল ওরিয়েন্টাল প্রদেশ। এই অঞ্চল তখন পৃথিবীর ভয়াবহতম মানব হত্যায় উন্মত্ত একটি এলাকা। সংঘাত-খুনোখুনির পেছনে অন্যতম কারণ ছিল, পৃথিবীর বৃহত্তম সোনার খনি মংবালুর মতো অজস্র খনি আর খনিজ সম্পদের উপস্থিতি। তা লুণ্ঠনে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লোলুপ দৃষ্টি উসকে দিচ্ছিল হানাহানি।
এ অঞ্চলেই রয়েছে লেন্দু জনগোষ্ঠীর বসবাস। আমার কঙ্গো পৌঁছানোর আগে সেখানকার ইন্দোকিতে লেন্দুরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে শান্তিরক্ষী বাহিনীর টহল দলের ৯ সদস্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। শুধু হত্যাই করেনি, ওই সব হতভাগ্য সৈন্যের দেহাবশেষ দেখার দুর্ভাগ্য যাদের হয়েছিল, তাদের জীবনে ওই দুঃসহ স্মৃতি কখনো মুছে যাওয়ার নয়। কারণ, লেন্দুরা মানুষখেকো। ওদের প্রচলিত বিশ্বাস, শত্রুকে খেতে পারলে তার বাকি বয়স এবং শক্তি তাদের শরীরে প্রবিষ্ট হয়।
এই লেন্দু গেরিলাদের নেতৃত্বে ছিলেন পিটার করিম। আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে তখন এক জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি। বয়স তাঁর ৩৫ থেকে ৪০ বছর। হালকা–পাতলা গড়নের বলে শোনা যায়। আসল নাম ‘করিম উদাগা’। বিখ্যাত রুশ জেনারেল ‘পিটার দ্য গ্রেট’-এর নাম থেকে ‘পিটার’ শব্দটি নিজের নামের আগে বসিয়ে নেন।
সে সময় তাঁর নেতৃত্বে গেরিলা যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬ হাজারের বেশি। পিটারের অনুগত সৈন্যরা যেমন বিশ্বাসী তেমনি দুর্ধর্ষ, যেমন হিংস্র তেমনি মরণজয়ী। তখন পর্যন্ত না জাতিসংঘ, না কঙ্গোর সেনাবাহিনী—কারও কাছে পিটার করিমের কোনো ছবি পর্যন্ত ছিল না।
জিম্মি সাত শান্তিরক্ষী
২০০৬ সালের ২৭ মে তৎকালীন কিসাঙ্গানি থেকে ইস্টার্ন ডিভিশন কমান্ডার জেনারেল ক্যামার্ট গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারেন পিটার করিম রাত্রিযাপনের জন্য লানার কলিবা নামের একটি জায়গায় আসবেন। তিনি ইথুরি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহাবুব হায়দার খানকে ওই রাতেই পিটার করিমকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। সেই আদেশ অনুযায়ী ইথুরি ব্রিগেড কমান্ডার তাঁর অধীন নেপালি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল ঝংকারের ওপর দায়িত্ব দেন পিটার করিমকে গ্রেপ্তারের অভিযান চালাতে।
পিটারকে গ্রেপ্তারের জন্য নেপালি সৈন্যরা ২৮ মে রাতের আঁধারে যখন গভীর অরণ্যের পথ পাড়ি দিয়ে ভোরের দিকে লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন লেন্দু গেরিলাদের অতর্কিতে প্রতি–আক্রমণের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। লেন্দুদের হাত থেকে নেপালি সৈন্যদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণে সহায়তা করতে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠানো হয়। হেলিকপ্টার গানশিপের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের একপর্যায়ে লেন্দুরা একজন নেপালি সৈন্যের লাশ ফেলে রেখে সাত নেপালি সেনাকে জিম্মি করে।
উদ্ধারে জড়িয়ে পড়া
এ ঘটনা শুধু কঙ্গোর শান্তিরক্ষা মিশনের ১৮ হাজার সৈন্যের মধ্যে কালো মেঘ তৈরি করেনি বরং জাতিসংঘের সমগ্র শান্তিরক্ষা মিশনকেও বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে। নেপালি শান্তিরক্ষীদের এই বিপর্যয়ের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি আমি নিজেও। বাস্তবে ফিরলে ভাবি, আমি নিজে কী করতে পারি। সামরিক জীবনে গেরিলাদের সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইলাম। তখনই সোজা ইথুরিতে আমার অফিসের পাশেই জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি চার্লস গোমেজের অফিসে গেলাম। ঘটনার পূর্বাপর আলোচনায় আমি তাঁকে লেন্দুদের হাতে বন্দী সাত নেপালিকে মুক্ত করতে আমার ইচ্ছার কথা জানাই। আমার অভিজ্ঞতার কথা জানালে তিনি আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সম্মতি দেন।
২০০৬ সালের ২৯ মে সকালে বিশেষ হেলিকপ্টার আমাকে গহিন অরণ্যে ঢাকা কোয়ান্ডোরামায় নামিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী ৪৫ দিনের জন্য আমি রবীন্দ্রনাথের ‘সূর্যহারা অরণ্যের’ জঙ্গলজীবনের পথে পা বাড়াই।
পিটার করিমের সাক্ষাৎ
কোয়ান্ডোরামায় দিন কাটছিল নানা শঙ্কায়। শান্তিরক্ষীদের উদ্ধারে সব প্রচেষ্টা যেন থমকে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এর–ওর মাধ্যমে পিটার করিমের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আমার। আরও পরে নির্ধারিত হয় সাক্ষাতের সময়। শর্ত—এই সাক্ষাতের কথা গোপন রেখে আমাকে যেতে হবে গহিন অরণ্যে।
একা আমি। নির্ধারিত সময় এবং নির্দিষ্ট পথ ধরে আমি এগোতে থাকি। পাহাড়ি সর্পিল পথ। পথের দুই ধারে ঘন সবুজ অরণ্য, কোথাও আবার সুউচ্চ বৃক্ষের সারি। কোথাও কোনো জনমানবের সাড়া নেই। চলতে চলতে আমি দ্বিমুখী রাস্তার সামনে এসে পড়ি।
কোন দিকে যাব? সোজা না বাঁয়ে? পথনির্দেশ করার কেউ নেই। আমি অপেক্ষায় থাকি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখি আমার সামনে থেকে অর্থাৎ সোজা রাস্তা ধরে মাঝবয়সী এক লোক এগিয়ে আসছেন। আমার থেকে শ খানেক গজ দূরে থেকে তিনি ইশারা করেন সোজা এগিয়ে যেতে। আমার চলা আবার শুরু হয়।
আরও কিছুদূর চলার পর সশস্ত্র এক গেরিলা দল আমাকে থামায়। আমি আমার ইউনিফর্মের হাতায় লাগানো বাংলাদেশের পতাকার ইনসিগনিয়া (ছোট সংস্করণ) দেখাই। তাঁরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সামনে যেতে বলে। কিছুদূর যেতে বেশ কিছু নারী যোদ্ধাও এদের সঙ্গে যোগ দেয়। ছোট একটি পাহাড়ে উঠি।
একজন হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি গাকপা। কর্নেল গাকপা। যাঁর কথার ওপর ভিত্তি করে আমার অজানা পথে আসা। যাঁর সঙ্গে পরিচয় এবং সাক্ষাৎ জিম্মি উদ্ধারে এসেই। তাঁকে বলা যায় পিটার করিমের ফিলোসফার ও গাইড।
কিছুদূরে দাঁড়ানো ছোটখাটো একজনকে নির্দেশ করেন গাকপা। কঙ্গোর সাবেক একনায়ক মবুতুর মতো চিতা বাঘের চামড়ার টুপি তাঁর মাথায়, হাতে বাঁকা দুই-আড়াই হাতের লাঠি। লাঠির শেষ প্রান্ত বর্শার ফলার মতো সুচালো। পরে কৌতূহল মেটাতে গিয়ে জেনেছি এই লাঠির প্রায় পুরোটাতেই রয়েছে তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি। বর্শার ফলার মতো অংশ ছুরির অগ্রভাগ।
তিনিই পিটার করিম। কাছে গিয়ে আমি ‘মো জেনারেল’ বলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে করমর্দন করি। মো জেনারেলের সোজা বাংলা, ‘আমার প্রিয় জেনারেল’। ‘মো জেনারেল’ কথাটি পিটারের বেশ পছন্দ হয়েছে তাঁর স্মিত হাসি দেখেই বুঝি। গাকপা পাশে দোভাষীর ভূমিকায়। পিটারের কথা আমার জন্য ইংরেজিতে আর আমার কথা পিটারের জন্য স্থানীয় সোহিলি ভাষায় অনুবাদ করে যান।
আলাপের একপর্যায়ে আমি নেপালি জিম্মিদের কথা তুলি। জিম্মিদের নিরাপদে সুস্থ শরীরে মুক্তি দিলে তা শুধু কঙ্গোয় নয় বহির্বিশ্বেও পিটারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে বলে জানাই। আরও বলি এতে কঙ্গোর সেনাবাহিনীতে পিটারের স্বদলে আত্তীকরণের বিষয়টিও সহজ হবে। তাঁর সম্মতি থাকলে বিষয়টি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনাও করতে পারি।
আমার বক্তব্য গাকপা খুব নিচু স্বরে পিটারকে অনুবাদ করে বোঝালেন। কথাগুলো শুনে পিটার মৃদু মাথা নাড়েন। আরও নানা বিষয়ে কথা বলি আমরা। আগে দ্বন্দ্ব–সংঘাতে লাখ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা আমি শোনাই পিটারকে। আমার ধারণা, গাকপা বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমার প্রতিটি শব্দ অনুবাদ করে যান। কথা শেষ করে সরাসরি পিটারের চোখে চোখ রাখি। পিটারের চোখে–মুখে আমি একধরনের বিষণ্নতার ছায়া দেখি। এতে আমার মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মে, আমি পিটারের মনোজগতে আজ কিছু একটা পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছি।
মুক্তি পেলেন জিম্মিরা
এরই মধ্যে জিম্মি উদ্ধার ইস্যুতে নানা পক্ষ কাজ শুরু করে। অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী। শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আমি একইভাবে দ্বিতীয়বারের মতো দেখা করি পিটার করিমের সঙ্গে। জিম্মিদের তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন। এ জন্য সরকারের নিশ্চয়তাপত্র চান তিনি। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাই বিষয়গুলো।
এভাবে অনেক দর-কষাকষির পর আসে সেই শুভক্ষণ। পিটার করিমের গেরিলা দলকে কঙ্গোর সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ-সংক্রান্ত একটি নিশ্চয়তাপত্র প্রদান করে। আগের ঘোষণা অনুযায়ী, পিটার করিমও ৭ জুলাই জিম্মি শান্তিরক্ষীদের হস্তান্তর করে।
চলতে থাকে পিটার করিমদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আলোচনা। কঙ্গো সরকারের পক্ষ কয়েক দফায় ওদের দইয়ের (পিটার করিমের হেডকোয়ার্টার) আস্তানায় গিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয়। সঙ্গে থাকি আমি। ২০০৬ সালে ২৭ জুলাই দীর্ঘ আলোচনার পর পিটার করিমেরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার এবং তাঁদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করতে সম্মত হন।
সেদিন পড়ন্ত বিকেলে আমরা হেলিকপ্টারে উড়াল দিই। পেছনে রেখে আসি দই। দই আমার জীবনের স্মৃতির মণিকোঠা থেকে কখনো মুছে যাওয়ার নয়।
লেখক: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর।