মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার
এখনো পিছিয়ে নারীরা
মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারে পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে। আর্থিক সক্ষমতা কমসহ বিভিন্ন কারণে নারীরা পিছিয়ে আছে।
রাজধানীর অদূরে সাভারের নামাপাড়ার প্লাস্টিক কারখানার কর্মী আসিয়া। তাঁর স্বামী ওই এলাকার একটি পোশাক কারখানার কর্মী। স্বামীর একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন কেনার শখ ছিল। নিজে টাকা জমিয়ে স্বামীকে সেই ফোন কিনতে সহায়তা করেন। নিজেরও একটি ফোন কেনার ইচ্ছা। কিন্তু তাতে স্বামীর বাগড়া। বাসায় একটি টাচ্ (অ্যান্ড্রয়েড) ফোন আছে, আর দরকার কী—এমন যুক্তি স্বামীর। আসিয়ার কথা, ‘নিজের টাকা জমাইয়ে ফোন কিনতে চাইছিলাম। স্বামীর ইচ্ছা না, কিনতে পারলাম না।’
সামর্থ্য থাকলেও আসিয়ার মতো অনেক নারী শুধু পারিবারিক বাধার কারণে মুঠোফোন কিনতে পারেন না। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তারপরও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ এই মাধ্যমের মালিকানার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী অনেক পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক, এমনকি নিরাপত্তার বিষয়টি প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০’ প্রতিবেদনটিতে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এ প্রতিবেদন বের হয় চলতি বছরের মার্চ মাসে। এটি তৈরি করে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা ৮৬ ভাগ পুরুষ মুঠোফোন ব্যবহার করেন। নারী মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬১ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ব্যবধান ২৯ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের ব্যবধান আরও বেশি। এ ব্যবধান ৫২ শতাংশ। দেশের ৩৩ শতাংশ পুরুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। সেখানে অর্ধেকেরও কম, অর্থাৎ ১৬ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।
বাংলাদেশের নারীদের মুঠোফোন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা হলো পরিবারের সম্মতি না পাওয়া। দেশের অন্তত ২২ শতাংশ নারী বলেন, পরিবার চায় না তাই তাঁরা মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারেন না। বাংলাদেশসহ এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা বেশি পাকিস্তান ও আলজেরিয়ায়। পাকিস্তানে এ হার ৩৫ শতাংশ, আলজেরিয়ায় ১১ শতাংশ।
স্মার্টফোন, ফিচার ফোন ও বেসিক ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবধান রয়ে গেছে। বাংলাদেশে ৩৬ শতাংশ পুরুষ যেখানে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, সেখানে নারীদের মধ্যে এ ফোন ব্যবহারের হার ২১ শতাংশ। ফিচার ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ব্যবধান অপেক্ষাকৃত কম। এখানে পুরুষ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩১ শতাংশ, নারী ২৬ শতাংশ। আর বেসিক ফোন ব্যবহারকারী পুরুষ ১৯ শতাংশ, নারী ১৩ শতাংশ।
এই প্রতিবেদন তৈরিতে যেসব বাজার জরিপ করা হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, নারী ব্যবহারকারীদের তাঁদের মুঠোফোন কেনার ব্যাপারে কমই নিয়ন্ত্রণ আছে। নারীদের আর্থিক সক্ষমতার অভাব এখানে বড় কারণ। প্রতিবেদনে এই নিরিখে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের উদাহরণ এসেছে। দেশে ৮৩ শতাংশ পুরুষ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী তাঁদের নিজেদের ফোন কিনেছেন। অন্যদিকে, মাত্র ৪৯ শতাংশ নারী কিনেছেন তাঁদের ব্যক্তিগত স্মার্টফোনটি।
*বাংলাদেশে ৮৬ শতাংশ পুরুষ মুঠোফোন ব্যবহার করেন। * নারী মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬১ শতাংশ। নারী-পুরুষের ব্যবধান ২৯ শতাংশ। * ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের ব্যবধান আরও বেশি।
২০১৭ সালে বাংলাদেশের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহার জানতেন। দুই বছর পর ৭৩ শতাংশ পুরুষ এ বিষয়ে জানেন। ২০১৭ সালে নারীদের মধ্যে মাত্র ৩৪ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারতেন। দুই বছর পর মুঠোফোনে নারী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে। পুরুষের তুলনায় নারীদের সচেতনতার মাত্রা বেশি।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান মুঠোফোন ও ইন্টারনেটে নারীদের প্রাপ্যতা পুরুষের তুলনায় কম হওয়ার দুটো মূল কারণের উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো শ্রমবাজারে নারীর কম অংশগ্রহণ ও আর্থিক সক্ষমতার অভাব।
মুঠোফোন ব্যবহারে নারী-পুরুষের ব্যবধান অনেক। কেনার স্বাধীনতাও সংকুচিত। সেখানে আর্থিক সক্ষমতা একটি প্রতিবন্ধকতা। তবু মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে নারীদের সচেতনতা কিন্তু অনেকে বেড়েছে। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সচেতনতার মাত্রা প্রায় সমান। দিন দিন নারীদের সচেতনতার মাত্রা বেড়েছে। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নারীদের এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
মুঠোফোন কেনার ক্ষেত্রে মোট ১৩ ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে একটি পড়ালেখার অভাব। এ ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী অনেক এগিয়ে আছেন। ৪৪ শতাংশ পুরুষ পড়ালেখা না জানাকে একটি প্রতিবন্ধকতা বলেছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা মাত্র ১৭ শতাংশ। শিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ফোনটি কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সে সম্পর্কে নারীরা পুরুষের তুলনায় কম জানেন। এই না জানাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ৩১ শতাংশ নারী, পুরুষ ১৯ শতাংশ।
মুঠোফোন ব্যবহারে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে উদ্বেগ অনেক বেশি। কোনো পুরুষ ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা বলেই মনে করেন না। অথচ ৪ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যা। অজানা-অচেনা লোকের ফোনে কোনো পুরুষকেই বিরক্ত হতে হয় না। অথচ ১ শতাংশ নারী এভাবে বিরক্তির শিকার। তথ্যসংক্রান্ত নিরাপত্তার সংকটে পুরুষদের মধ্যে ২ শতাংশ থাকলেও নারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৩ শতাংশ। পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা দেশের কোনো পুরুষের জন্য মুঠোফোন কিনতে বা ব্যবহার করতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না। অথচ এ সংকটে দেশের ১১ শতাংশ নারীকে পড়তে হয়।
মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় নারীদের। নারীদের মধ্যে ১৪ শতাংশ মনে করেন, ইন্টারনেট ব্যবহার করার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পান না তাঁরা। পুরুষদের মধ্যে এমনটা মনে করেন ১২ শতাংশ। মুঠোফোনে যেসব তথ্য দেওয়া হয়, সেখানে ভাষাকে একটি বড় সমস্যা বলে মনে করেন নারী-পুরুষ উভয়ই। পুরুষদের মধ্যে এ সংখ্যা ৩ শতাংশ, নারী দ্বিগুণ। ইন্টারনেট ব্যবহারে অজানা ব্যক্তির উপদ্রবকে মাত্র ১ শতাংশ পুরুষ সমস্যা বলে মনে করলেও নারীদের মধ্যে এ সমস্যায় পড়েন ৬ শতাংশ।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) অনলাইনে নারীদের যৌন হেনস্তা ও পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কাজ করছে। আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, চলতি বছর অনলাইনে হেনস্তার ১৮টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে একজন অভিযুক্তই ৩০০ ভিডিও ধারণ করেছে।
নীনা গোস্বামী জানান, মুঠোফোন ব্যবহার নিয়ে অনেক নারীকেই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। স্ত্রী বেশি কথা বলেন, সন্তানের দিকে নজর দেন না বা নিজের মা-বাবার সঙ্গে বেশি কথা বলেন—এমন সব অজুহাত এনে নির্যাতনে ঘটনা ঘটে। অথচ পরিবারের পুরুষটি দিব্যি দীর্ঘ সময় মুঠোফোনে বা ইন্টারনেটে থাকছেন। এ নিয়ে অভিযোগ করলেও নিপীড়নের শিকার হতে হয় নারীদের।
নীনা গোস্বামী জানান, মুঠোফোন ব্যবহার নিয়ে অনেক নারীকেই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। স্ত্রী বেশি কথা বলেন, সন্তানের দিকে নজর দেন না বা নিজের মা-বাবার সঙ্গে বেশি কথা বলেন—এমন সব অজুহাত এনে নির্যাতনে ঘটনা ঘটে। অথচ পরিবারের পুরুষটি দিব্যি দীর্ঘ সময় মুঠোফোনে বা ইন্টারনেটে থাকছেন। এ নিয়ে অভিযোগ করলেও নিপীড়নের শিকার হতে হয় নারীদের।